আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির
প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে – অন্ধকারে জমিদারের
চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে।
ওরা খুব বেশি ভালো ছিল না; তবুও
আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায়
অন্ধ শতচ্ছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে
পৃথক আরেক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল। (দাশ, ২০১৫ : ২৮৪)
‘১৯৪৬-৪৭’ – জীবনানন্দের এই কবিতার শিরোনামের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এক উদ্ভ্রান্ত, বিমূঢ় সময়ে দাঁড়িয়ে লেখা এ-কবিতা, যেখানে নিস্তেল অন্ধকারে ডুবে থাকা সমকালের গ্রামজীবনের ছবি তাঁর কাছে সামন্ততান্ত্রিক বাংলার চেয়ে শ্রেয় নয় কখনো। আর তাই এই অস্পষ্ট, সংশয়দীর্ণ, হিংসায় উন্মত্ত সমাজের চেয়ে সেই গ্রাম্য সন্ততির প্রপিতামহেরা ‘পৃথক আরেক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল’ বলে মনে হয় তাঁর। আসলে মার্ক্সীয় সমাজদর্শনে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষক ছিল জমির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ পার হয়ে ধনতন্ত্রের আগমনের যে-যাত্রাপথ সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানা ক্রমশ মুখ্য হয়ে ওঠে। আর তাই সমাজতান্ত্রিক বাস্তববতাদের প্রবক্তা মাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপনাসের পাভেলকে বলতে হয় ‘ব্যক্তিগত মালিকানা দূর হোক, উৎপাদনের সমস্ত উপায় আসা চাই শ্রমিকের হাতে, জনতার হাতে ক্ষমতা চাই, সবাইকে খেটে খেতে হবে’। (গোর্কি, ২০১৭ : ২৬২) মার্ক্সবাদ চায় সমাজতন্ত্রের পথে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। ইউরোপের মতো আমাদের দেশে এই সামন্তপ্রথার ক্রমবিস্তার, শাসন-শোষণ কিংবা মানবিক মুখ যেমন আমরা দেখেছি, তেমনই ধনতন্ত্রের আবির্ভাবে সামন্ততন্ত্রের (Feudalism) ক্রমবিলয়ের বেদনাময় ছবিও আমাদের সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামন্তপ্রথা বা জমিদারতন্ত্র (feudalism) যে-সর্বদা উৎপীড়ক নয়, পল্লীগ্রামের প্রজাদের দুরবস্থার বাইরেও প্রজাদরদী জমিদারেরা আছে তার পরিচয় সাহিত্যের পাঠক নাটকে-গল্পে-উপন্যাসে পেয়েছে বারংবার। ‘নীলদর্পণ’-এর পাঠক নবীনমাধবের মতো প্রতিবাদী, প্রজাহিতৈষী জমিদারকে ভুলতে পারে কি? বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎসাহিত্যের পরে সামন্তসমাজের সবথেকে বিশ্বস্ত ছবি খুঁজে পেতে হলে আমাদের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৮-১৯৭১) কথাসাহিত্যের কাছে ফিরে যেতে হয়। লাভপুরের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের সন্তান তারাশঙ্করের কথাসাহিত্য রাঢ় বাংলার সমাজবাস্তবতাকে (অর্থাৎ সমাজের দোষ-ত্রুটি, ধনী-নির্ধনের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি) নিখুঁতভাবে তুলে এনেছিলো। জমিদারপ্রথার প্রতি বিশেষ পক্ষপাত নয়, বরং নির্মোহভাবে তার দোষ-ত্রুটি বা গুণের ছবি এবং নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব তিনি এঁকেছেন। যদিও দুই কালের দ্বন্দ্বে তাঁর কাছে বড় হয়েছে এক মানবিক মূল্যবোধ। এইসূত্রে তাঁর ‘রায়বাড়ি’, ‘জলসাঘর’ কিংবা ‘ধাত্রীদেবতা’কে সহজেই মনে পড়ে।
তারাশঙ্করের দুটি আখ্যানে সামন্ততন্ত্র
তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯) মূলত রাজনৈতিক উপন্যাস হলেও জমিদারী প্রথার ভেঙে পড়ার ছবি এতে স্পষ্ট। ১৯৩৪-এ এর সংক্ষিপ্ত রূপের নাম ছিল ‘জমিদারের মেয়ে’। জমিদারীর মালিক কৃষ্ণদাস বাঁড়ুজ্জের আকস্মিক মৃত্যুতে শিবনাথ জমিদারীর মালিক, কিন্তু সে নাবালক হওয়ায় দায়িত্ব নিলেন পিসিমা শৈলজাদেবী। পিসিমা খুব শক্তহাতে জমিদারী চালাতেন। প্রজাদের কাছ থেকে যেমন সময়মতো খাজনা আদায় করতেন, তেমনি কৌশল করে প্রজাদের ঘাড় ভেঙে ঋণের বোঝাও মেটাতেন। শিবনাথের বিয়েতে বিশাল আয়োজন করতে গিয়ে যে বিশাল ঋণ হয় তা মেটাতে পাকস্পর্শের দিন বর-বধূকে বারান্দায় বসিয়ে সামনে কাঁসারা থালা রেখে প্রজাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। লেখকের বর্ণনা এইরকম :
“প্রকাণ্ড একখানা কাঁসার পরাত বর-বধূর পায়ের নিকট একটা তেপায়ার উপর রক্ষিত ছিল, দেখিতে দেখিতে টাকায় সেটা ভরিয়া গেল। রাত্রি নয়টার সময় শেষ প্রজাটি চলিয়া গেল। তখন নয় বৎসরের নববধূটি চেয়ারের হাতলের উপর ঘুমাইয়া ঢুলিয়া পড়িয়াছে।
পিসীমা বলিলেন, পরাত তোলো কেষ্ট সিং।
বাড়ির মধ্যে শিবনাথের মা টাকা গণিয়া থাক থাক সাজাইয়া তুলিলেন। গণনা করিয়া দেখা গেল, সাত শত উনপঞ্চাশ টাকা উঠিয়াছে।” (বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪১৮ : ৩০)
তবে এমন টাকা আদায়ই নয়, শিবুর মাস্টারমশাইকে তার ম্যাট্রিক পাশের পর সোনার হাতঘড়ি উপহার দেওয়া কিংবা শিবুকে এক পাঠানের কাছ থেকে ঘোড়া কেনা দেওয়া – এই আভিজাত্যও দেখা যায়। তবে কালের নিয়মে এসবেরই ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে। উপন্যাসের সাতাশ পরিচ্ছেদে দেখা যায় সেই অবক্ষয়ের ছবি। মা জ্যোতির্ময়ী মৃত, পিসিমা কাশীবাসী, বউ গৌরী পিত্রালয়ে; এদিকে অনাবৃষ্টির জন্য দেশে খরা ও দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে :
‘এতবড় কাছারিবাড়িতে সে একা, সে ছাড়া জনমানব নাই। সময় নির্ণয়ের জন্য পিছনের দেওয়ালের দিকে সে অভ্যাসমতো চাহিয়া দেখিল, কিন্তু ব্রাকেটের উপর ঘড়িটা নিস্তব্ধ, কখন থামিয়া গিয়াছে। অয়েল করানোর অভাবে ঘড়িটা মাঝে মাঝে বন্ধ হইয়া যাইতেছে। ইজি-চেয়ারের বেতের ছাউনিটা ছিঁড়িয়াছে, সদর হইতে বেত ও কারিগর আনাইয়া ওটা মেরামত করা প্রয়োজন, কিন্তু সেও হয় নাই। এসব পরের কথা, এখন সম্পত্তি থাকিলে হয়। আগামী সরকারী নিলামে বাকি রাজস্বের দায়ে সম্পত্তি নিলামে উঠিয়াছে। পাঁচশত টাকা লাগিবে; না দিতে পারিলে সমস্ত নিলাম হইয়া যাইবে; নায়েব গোমস্তা চাপরাসী, এমন কি চাকর ও মাহিন্দার পর্যন্ত বাহিরে গিয়াছে, মহলে মহলে টাকার জন্য তাহারা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।’ (বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪১৮ : ১৭৭)
শিবনাথ, মাস্টারমশাই থেকে শুরু করে সকলেই টাকার সন্ধানে ঘুরেছে। শিবনাথ উৎকণ্ঠার যন্ত্রণায় কাতর। শেষপর্যন্ত মাস্টারমশাই নিজের সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে তাকে বাঁচান। উপন্যাসের পরবর্তী প্রবাহ রাজনৈতিক বৃত্তে গিয়ে পৌঁছেছে। প্রসঙ্গত, ‘জলসাঘর’ গল্পের সেই ‘সাত রায়ের মোহ’ কে অনুভব করেন শেষ জমিদার বিশ্বম্ভর রায়। যদিও এই সপ্তম পুরুষের আমলেই রায়বাড়ির লক্ষ্মী ‘ঋণসমুদ্রে তলাইয়া গেলেন’ (বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪২৮ : ১১২), বিশ্বম্ভর নির্বংশও হয়েছেন। তারপর ‘প্রিভি কাউন্সিলের বিচারে রায়বংশের ভূসম্পত্তি সব চলিয়া গেল। রহিল বাড়িঘর ও লাখরাজের কায়েমী বন্দোবস্তটুকু’। (বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪২৮ : ১১৩) তবু ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি নতুন বড়লোক মহিম গাঙ্গুলির কাছে তিনি পরাজিত হতে চাননি। নিজের সর্বস্ব দিয়েও কৃষ্ণা বাইজীকে তিনি আসরের বরাত দিয়েছেন। শেষবারের মতো সেই জলসাঘরের আসর এবং সারারাত মদ্যপান, কৃষ্ণাকে প্রেয়সী চন্দ্রাবাই ভেবে ভুল করার মধ্য দিয়ে রাত কাটে রায়-হুজুরের। ভোররাতে ঘোড়া তুফানের পিঠে সওয়ারও হন তিনি। যদিও শরীর ও মন বেশিক্ষণ সেই চাঞ্চল্য বহন করতে পারেনি। বুঝেছেন সবটাই মোহ। তাই গল্পের শেষে :
‘বাতি নিবিয়ে দে – জলসাঘরের দরজা বন্ধ কর – জলসাঘরের –
আর কথা শোনা গেল না। হাতের চাবুকটা শুধু সশব্দে আসিয়া জলসাঘরের দরজায় আছড়াইয়া পড়িল।’ (বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪২৮ : ১২৭)
– এই হাহাকারের ছবি যেন এই সামন্ততন্ত্রের পতনের চিহ্নবাহী হয়ে ওঠে। সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য চলচ্চিত্রায়ণও মনে পড়ে যায়। এই সূত্রেই পূর্বজ ইংরেজ কথাসাহিত্যিক টমাস হার্ডি (১৮৪০-১৯২৮) এবং প্রায় সমান বয়সী কবি-কথাকার জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)-এর দুটি উপন্যাসের কথা আমাদের মনে পড়ে যায়।
কে এই হার্ডি?
টমাস হার্ডির (১৮৪০-১৯২৮) নামের সঙ্গে সাহিত্যের পাঠক মাত্রই সবিশেষ পরিচিত। ভিক্টোরীয় যুগের এই কবি ও কথাকার সমকাল থেকে উত্তরকালে বিশেষ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর লেখনী আঞ্চলিক সাহিত্যের ধারাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, একথাও বহু আলোচিত। ইংলণ্ডের ওয়েসেক্স বা সাসেক্স-কে কেন্দ্র করে তাঁর কবিতা-গল্প-উপন্যাসের কাহিনি-চরিত্র-ঘটনাবলী প্রবাহিত হয়েছে। নিছক স্থানিক বর্ণিমা নয়, ওয়েসেক্সের পটভূমি তাঁর রচনায় নিয়ন্ত্রী শক্তির ভূমিকায় পর্যবসিত হয়েছে। আধুনিক মনস্তত্ত্বের অন্তর্বাস্তবতা নিবিড়ভাবে চিত্রিত না হলেও গ্রিক নাট্যসুলভ এক বিষণ্ণতাবোধ, ট্র্যাজিক মহিমা তাঁর আখ্যানের মূল সুর। ‘ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড’ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের নাম, এই নাম তাঁর সমস্ত আখ্যানের বিশিষ্টতাসূচকও বলা চলে। কারণ, ওয়েসেক্সের গ্রাম জীবনের প্রেক্ষাপটকে তিনি এমন ভাবে তাঁর আখ্যানের নর-নারীদের সঙ্গে মিলিয়েছেন যে তাদের প্রেম-ঈর্ষা-আকাঙ্ক্ষা সবই এক আদিম-উদাসীন প্রকৃতির প্রেক্ষিতে বারবার পরাজিত হয়। প্রকৃতি-সমাজ-মানুষ --- এই তিনের বিন্যাসে তাঁর উপন্যাসে এক দুর্জ্ঞেয় ইচ্ছাশক্তিকে জয়ী হতে দেখা যায়। অধিকাংশ সমালোচক এর পিছনে হার্ডির দার্শনিক সংশয় ও নৈরাশ্যচেতনার কথা বলেন, যা শোপেনহাওয়ার, ডারউইন ও গ্রিক নিয়তিবাদ প্রভাবিত। এছাড়া আছে তাঁর কবিতা; সেখানেও বিষণ্ণতাবোধ, দার্শনিকতা, গ্রামজীবনের স্মৃতি এবং সমীপ সময় ছায়া
ফেলে।
হার্ডি ও জীবনানন্দ : সামন্ততন্ত্রের ফসিল
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক জীবনানন্দ ‘ঝরা পালক’ উত্তর সময়ে এই হার্ডিকে বিশেষভাবে আঁকড়ে ধরলেন। হার্ডি মারা গেছেন ১৯২৮-এ আর জীবনানন্দের ডায়েরি শুরু হচ্ছে ১৯২৯ এ, এটাও বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো বিষয়। তবে এসবের বাইরেও যা আমাদের চমৎকৃত করে তা হল দু-জনের লিটারারি নোটসের মিল। দুজনেই যে শুধু চারপাশের মানুষজন, ঘটনাপ্রবাহ বা ভাবনাক্রম টুকে রেখেছেন তা-ই নয়, তাঁদের খাতায় ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন বই, লেখক, সংবাদপত্রের কাটিং গল্প উপন্যাস কবিতার প্লট। এখন দেখা যাক কীভাবে জীবনানন্দের ১৯২৯ এর থিমস্-এ হার্ডি উঁকি দিয়েছে বারংবার। ১৯২৯-এ জীবনানন্দের লিটেরারি নোটস এ যে ১৩৬টা এন্ট্রি আছে তার একেবারে শুরুর দিকের এন্ট্রিগুলোতেই (২,৩,৪,৫,৬) স্থান করে নিয়েছেন হার্ডি। মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি থাকলেও হার্ডি ছিলেন একাধারে ছোটগল্পকার অন্যদিকে কবিও। থিমসের শুরুতেই জীবনানন্দ দেখি তার একের পর এক ছোটগল্প- এর কথা লিখে রেখেছেন- ‘ফর কনশ্যনস সেক’ (২), ‘আলিসিয়াস ডায়েরি’ (৩) ‘অ্যান ইমাজিনেটিভ ওম্যান’ (৪), ‘আ ফিউ ক্রাস্টেড ক্যারেকটারস’ (৫), হঠাৎ এ গল্পগুলোই কেন তাঁকে প্রভাবিত করে তার অন্যতম প্রধান কারণ ব্যক্তিজীবনে অপূর্ণ প্রেমের বেদনা। তবে আমাদের অন্বিষ্ট হার্ডি বিষয়ক জীবনানন্দের লিটারারি নোটসের তৃতীয় খণ্ডের এন্ট্রি, যেটি ১১৩ নং এন্ট্রি। সেখানে তিনি লিখেছেন, ' - These pictures (Hardy)'। (দাশ, ২০০৯ : ১০২৬) হার্ডির একটা উপন্যাস আছে, তিনখন্ডে, ‘আ লাওডিসিয়ান’ (খ্রি ১৮৮১); সম্ভবত এই উপন্যাসটির কথা মনে করেছেন জীবনানন্দ। এই উপন্যাসে নায়িকা পলা ও নায়ক সমারসেটের স্ট্যানচি ক্যাসল কুচক্রী ডেয়ারের ফন্দিতে পুড়ে যায়। সামন্ততন্ত্রের ফসিলটাকে দূর থেকে আগুনের আভায় শেষ হতে দেখলেন পলা। আর এক নতুন প্রাসাদ পুরনো ধ্বংসস্তূপের মাঝে। হার্ডির এই উপন্যাসের ছায়া যেন বেশ স্পষ্ট জীবনানন্দের 'কল্যাণী' উপন্যাসে। এই উপন্যাসে পলার মতো 'কল্যাণী'তেও একটি চরিত্র কল্যাণী, যে শালিকবাড়ি এলাকার জমিদার পঙ্কজ রায়চৌধুরী মহাশয়ের কন্যা। লেখাপড়ার জন্য কলকাতার হোস্টেলে বেশ কিছুদিন থাকার পর সে যখন নিজের দেশে ফিরে তখন তার আর সেখানে থাকতে ভালো লাগে না। পড়াশোনার জন্য আবার ফিরে যায় কলকাতায়। তবে পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফিরেই যেন হার্ডির পলার মতোই তার জীবন বদলে যায়। জমিদারতন্ত্রের ফসিল ক্যাসল্টাকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার জন্য এসেছিল জর্জ সমারসেট, তবে শুধু ক্যাসল গড়ে তুলতেই নয় পলার জীবনেও প্রবেশ করেছিল এই সামারসেট। ঠিক যেমনভাবে কল্যাণীর জীবনেও এসেছিল বাড়িতে ঘুরতে আসা বছর চল্লিশের এর চন্দ্রমোহন। বিশ্রী চেহারা, হলদে রং চীনের মতো মুখে মুখে আঁচিল ভরা দাড়ি এই চন্দ্রমোহন পাণিপ্রার্থনা করেছিল পঙ্কজ বাবুর কাছে পলার। সে জানিয়েছিল তার বিশাল ব্যবসা, আশি লাখ বা শত কোটি তার কাছে কিছুই না। এদিকে টাকার অভাবে জমিদার প্রায় ডুবতে বসা, কোর্ট অব ওয়ার্ডসে জমিদারি দেওয়ার পক্ষে রায় চৌধুরী বাবুর এরকম বিত্তবান পাত্র মেয়ের জন্য হাতছাড়া করতে চাননি। তাই অনেক বুঝিয়ে কল্যাণীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন চন্দ্রমোহনের। কিন্তু বিয়ের পর জানা যায় পাঁচ/সাত কোটি তো দূরের কথা পাঁচ/সাত লাখ ও নেই চন্দ্রমোহনের ব্যাঙ্কে। তার সম্বল মাত্র হাজার পনেরো টাকা যার মধ্যে সাত হাজার টাকাই বিয়েতে যৌতুক হিসেবে রায়চৌধুরী মহাশয়ের কাছ থেকে পাওয়া। আর এখানেই কল্যাণীর সঙ্গে আ লাওডিসিয়ানের পলার পার্থক্য। পলা উইলিয়াম ডেয়ারের ছলচাতুরীকে ধরে ফেলে তার সঙ্গে বিয়ে ভেঙে ফেলে ডেয়ারের বাবা ক্যাপ্টেন ডি স্ট্যানচির সঙ্গে করা বাগদানও। আর বিয়ে করেন নিজের ভালোবাসা, প্রেম সমারসেটকে। কিন্তু কল্যাণী বা পঙ্কজ বাবু কেউই ধরতে পারে নি চন্দ্রমোহনের মিথ্যাচার। ফলে এই মিথ্যাচারের শিকার হতে হয় রায়চৌধুরী বাবুর কন্যা কল্যাণীকে। পলা নিজের জীবন বাঁচাতে পারলেও কল্যাণী কিন্তু রক্ষা করতে পারেনি নিজেকে। পনেরো হাজার টাকার সুদে সংসার চলা প্রতারক চন্দ্রমোহনকে বিয়ে করেছে সে এবং তার জান্তব লালসার শিকার হয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আর সবশেষে বলা যায় জমিদারতন্ত্রের পতনের ব্যাপারটি। হার্ডির উপন্যাসে পলা ও সমারসেটের চোখের সামনে পুড়ে যায় স্ট্যানচি ক্যাসেল, পুড়ে যায় পুরোনো আসবাব, আর সেই সঙ্গে জ্বলতে থাকে প্রাসাদের আগের মালিকদের গ্যালারিতে ঝুলতে থাকা ছবিদের স্কেচ। 'কল্যাণী' তেও জমিদারী পুড়ে ছারখার হয়ে না গেলেও অর্থের অভাবে তা দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ধ্বংসেরই মুখে। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে সে কথা জানিয়ে –
'রায়চৌধুরী মশাই নানারকম কথা ভাবছিলেন: প্রথমত জমিদারীটা কোর্ট অব ওয়ার্ডসে দিলে কেমন হয়?
ভাবতে গিয়ে তিনি শিহরিত হয়ে উঠবেন। অবস্থাটা অত খারাপ হয়নি। কোনওদিনও যেন না হয় – ওরকম অবস্থা!
কোর্ট অব ওয়ার্ডসের কথা তিনি ভুলে যেতে চাইলেন। (দাশ, ২০০০ : ২৯)
অর্থাৎ একটাতে পুঁজিবাদ সামন্ততন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেল আর একটায় তার ভবিতব্য সরকারি বিচারাধীন তথা ধ্বংসের দোরগোড়ায়। ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৯৮ সালে এই উপন্যাস প্রকাশ পেলে আমাদের কাছে একটি শিক্ষিত, স্বাধীন মেয়ের অসুন্দরের হাতে সমর্পণের ছবিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, কিন্তু দিনলিপি ও হার্ডির সূত্রে এই পাঠ নিঃসন্দেহে ভিন্ন আস্বাদ এনে দেয় আমাদের মনে। এ-প্রসঙ্গে ঐ লিটারারি নোটসের টীকায় জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহর অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য :
‘জীবনানন্দ’র কল্যাণী পলা’র মতন অতটা পারেননি, প্রথম দিকটায় পারলেও শেষটায় পারেন নি জীবন বাঁচাতে, যা তাঁর পারবার কথা ছিল না, তা-ও করতে পেরেছেন; এমন-কী, পেরেছেন-যে, তা বিপর্যয়মুখী সামন্ততান্ত্রিক ঠ’কে যাওয়া বাবা’কে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, নিজেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করিয়েছেন। আর-কী করতে পারতেন কল্যাণী এবং তাঁর স্রষ্টা জীবনানন্দ? ইংরেজরা শিল্প বিপ্লব দেখেছেন, তার হাত ধরে আধুনিকতাবাদ-এর এবং পুঁজিবাদের উত্থান দেখেছেন, তাদের সুফল-কুফল দু’টোই চেখে দেখেছেন, কিন্তু উপনিবেশিত ভারতবর্ষে অভিঘাতটা উপর উপর থেকেই গেছে, এবং যতটা কুফল ফলেছে, ততটা সুফল নয়। তা-হলেও সে-সময়টায় অন্তত হার্ডি’র সঙ্গে জীবনানন্দ সহমত পোষণ করেছেন, যদিও লিখনশৈলীতে নয়।’ (দাশ, ২০০৯ : ১০৩০)
কেন এই তুলনা?
সমাজবাস্তবতা আসলে চায় সমাজের বাস্তবনিষ্ঠ ছবিকে তুলে ধরতে। আমাদের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য হোক কিংবা লোকসাহিত্যের রূপকথা-উপকথা-ব্রতকথার আড়ালে সমাজের বস্তুনিষ্ঠ ছবি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। তবে ক্রমশ সমাজের বাস্তব ছবিকে তুলে ধরে তার সংস্কারসাধনের আকাঙ্ক্ষা জন্ম দেয় সবিচার বাস্তববাদে। ভিক্টোরীয় যুগের ডিকেন্স সেই ধারার গুরুত্বপূর্ণ কথাকার, হার্ডিও তাঁর আঞ্চলিকতা ও চরিত্রনির্মাণের বাস্তবতায় সমাজকে উপেক্ষা করেননি। তাঁর ১৮৮১-এর ‘এ লাওডিসিয়ান’ উপন্যাসের পরিণাম বুঝিয়ে দেয় সময়ের অলঙ্ঘ্য নিয়মে অতীতকে মুছে যেতেই হয়। কাহিনি পলা-সমারসেটের পুনর্মিলনের মধ্যে দিয়ে শেষ হলেও ওই সামন্ততন্ত্রের অবসানের সূত্র হার্ডির সমাজ সচেতন মনকে চিনিয়ে দেয়। ওয়েসেক্সের কথাকার হার্ডি, রাঢ়বাংলার রূপকার তারাশঙ্কর এবং রূপসী বাংলার স্রষ্টা জীবনানন্দের লেখায় আঞ্চলিকতার সূত্রে বহুল আলোচিত কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু এখানে আলোচিত আখ্যানগুলিতে জমিদারতন্ত্রের মহিমা অবসিত হওয়ার বাস্তব ছবিটিকে আমরা তুলনামূলকভাবে বিচার করেছি। তাই এই অনালোকিত সাদৃশ্যের দিকটিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতেই পারি না কি?
(টীকা : এখানে আখ্যান শব্দটি ন্যারেটিভ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে)
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
আকর গ্রন্থ
গোর্কি, মাক্সিম, (পঞ্চম সং, ২০১৭) মা, পুষ্পময়ী বসু অনূদিত, বিশ্বাসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা
দাশ, জীবনানন্দ, দিনলিপি / লিটারারি নোটস ১-৪ (২০০৯), ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত, প্রতিক্ষণ, কলকাতা
দাশ, জীবনানন্দ উপন্যাস সমগ্র (২০০০), দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, গতিধারা, ঢাকা
দাশ, জীবনানন্দ, কাব্যসংগ্রহ (১৯৯৩), দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, ভারবি, কলকাতা
বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, (বিয়াল্লিশতম মুদ্রণ ১৪১৮) ধাত্রীদেবতা, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা
বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, (১৪২৮) বাছাই গল্প, বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত, নিউ লতিকা প্রকাশনী, কলকাতা
সহায়ক গ্রন্থ
চট্টোপাধ্যায়, কুন্তল, (২০১৫), ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, রত্নাবলী, কলকাতা
মিত্র, গৌতম, (২০১৯/২০২০), পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি : জীবনানন্দের খোঁজে (১-২), ঋত প্রকাশন, কলকাতা
মাইতি, (ড.) শিশিরকুমার, (২০০৯), সামন্ততান্ত্রিক ভাবনা ও বাংলা সাহিত্য, আশাবরী, ২০০৯, হাওড়া
মুখোপাধ্যায়, তরুণ সম্পাদিত, (২০১৫), বাংলা উপন্যাস : পাখির নজরে, এস এস পাবলিকেশন, কলকাতা
মুখোপাধ্যায়, তরুণ সংকলিত, (১৪২২), বাস্তবতা ও বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ, শিক্ষণ প্রকাশনী, কলকাতা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন