শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

এসেছো কবিতা

মা হঠাৎ একদিন বললেনআমি প্লট দিচ্ছিতুই উপন্যাস লেখ। এই বলে তিনি শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাধারণ মেয়ে’ স্টাইলে প্লট ডিকটেট করা। এর পরে এই হোকতার পরে নায়ক অমুকটা করুকনায়িকার তমুক অসুখটা হোকইত্যাদি বিস্তারিত বিবরণ দিতে থাকলেন। এবার আমার ভিতরে যেন খরা নামল। মনের গোপনে যে নিজস্ব জায়গাটুকু ছিল, যেখানে স্রষ্টা হিসাবে আমি মায়ের প্রভাব থেকে সাময়িক মুক্তির স্বাদ পেতাম, সেখানে এমন অনধিকার প্রবেশ আমার ভিতরের একচিলতে জমিটুকু অধিকার করার অন্যায় প্রচেষ্টা বলে মনে হল। স্পষ্ট করে কিছু না ভাবলেও যেন  বোধ হয়েছিল যে আমার আমিত্ব একান্ত সংকটের সামনে। লেখা আমার নিজের। সেখানে আমি আমার মাকে প্রবেশ করতে দিতে পারলাম নাকিন্তু চিরদিনের অনাদৃত সন্তানের শিরা-উপশিরায়  বাবা-মা সম্বন্ধে যে ভয় থাকে সেই ভয়টুকু আমার মধ্যে ছিল, তাই কোনও সরব প্রতিবাদও করতে পারিনি। আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব ছিল সেটুকুই শুধু করেছিলাম। আমার একমাত্র প্রতিবাদ ছিল নীরবে লেখা ছেড়ে দেওয়া। সেটুকুও মা মেনে নিতে পারেননিকারণ সেটাও তো তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া। আমিও তাঁকে বলতে পারিনি আর তিনি কিছুতেই বোঝেননি যে তাঁর উপন্যাস আমি লিখতে পারিনাসেটা লিখতে হলে তাঁকেই পরিশ্রম করতে হবে। পরে বড় হয়ে ভার্জিনিয়া উলফের ‘ রুম অফ ওয়ান ওন’ পড়ে মনে হয়েছিল যেন আমার কথাই বলছেন। নিজের একটা ঘরসেটুকু আমার মনের নিজস্ব জমিটুকুতেও আমি পাইনি। আমার সৃষ্টির জগতে কেউ অনধিকার প্রবেশ করবে সেটা আমি মেনে নিতে পারিনি বলে আমাকে লেখা ছাড়তে হয়েছিল।

এরপর বহুবছর লেখা বন্ধ। মনের মুক্তিটুকু হারিয়ে গেলে শুধু শুকনো পড়াশুনো। কিন্তু সেটুকুও ভালবাসতে শিখেছিলামচিন্তার জগতে আমার মুক্তি ছিল। আজ বুঝি এই ছিল প্রস্তুতিপর্বের শুরু। একে তো সাহিত্য পড়াতার উপরে প্রেসিডেন্সির মতো কলেজেযেখানে সাহিত্যকে ভালবাসতে শেখার জন্যতার স্বাদ নেবার জন্য কেবল ক্লাস করে গেলেই চলত। সিলেবাসপরীক্ষাপ্রশ্নপত্রএসবের ধার ধারতেন না শিক্ষকেরা। তাঁরা কেবল পাঠ্য সব অসাধারণ সাহিত্যকীর্তির ভেতরে ঢুকে তাদের অসামান্য বিশ্লেষণ করে তার রস আস্বাদন করতে শেখাতে ব্যস্ত থাকতেন। তখন শ্রদ্ধেয় তারকনাথ সেন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তাঁর বিশেষ গুণ ছিল যে ক্লাসে এমনভাবে সবটুকু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়িয়ে দিতেন যে তাঁর ক্লাস করলেই চলতআর সেসব নোটস দ্বিতীয়বার পড়বার দরকারই প্রায় হতনাসবটুকু মনের মধ্যে গেঁথে যেত। সাহিত্যের একেবারে অন্তঃস্থলে পৌঁছে দিত তাঁর ব্যাখ্যা। আর আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন কাজল বোসযিনি পরে সেনগুপ্ত হন। আমার সাহিত্যের ছাত্রী হিসাবে কৃতিত্বের এবং সাহিত্যে জীবনভর গভীর প্রেমের সিংহভাগ তাঁর দান। সপ্তাহে একদিন একঘন্টা টিউটোরিয়াল প্রোফেসর হিসাবে তাঁর আমাকে সময় দেবার কথা ছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে অন্ততঃ সময়ের কোনও হিসাব তিনি রাখতেন না। যখনই তিনি স্টাফরুমে ফাঁকা থাকবেন তখনই আমার জন্য সময়। তাঁর একথা ঢালাও বলাই ছিল। বাড়ি থেকে বই বয়ে এনে এনে তিনি আমাকে পড়িয়ে সাহায্য করতেন। মনে আছে সেসব বইয়ের মধ্যে একটা ছিল দান্তে অ্যালিঘিয়েরির ‘কনভিভিও একই বাক্যের নানা স্তরের নানা অর্থ নিয়ে আলোচনা সেই বই থেকে কাজলদি আমাকে পড়িয়েছিলেন। আর ছিলেন প্রোফেসর শৈলেন সেন আর অমল ভট্টাচার্য। অমলবাবুর স্ত্রী শ্রীমতী সুকুমারী ভট্টাচার্য ‘বৈদিক যুগে নারীর স্থান’ গ্রন্থটি লিখে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন  হয়েছেন। অমলবাবুর মুস্কিল ছিল যে তিনি সারাদিন গ্রীক লেক্সিকন নিয়ে মগ্ন থাকতেন আর আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির পরিমিতি সম্বন্ধে খুব একটা খোঁজখবর রাখতেন না। তাই ফার্স্ট ইয়ারে তাঁর ক্লাসে প্রায় কিছুই বুঝতে পারতাম না কেউ। কিন্তু পরে দেখলাম কি অমূল্য সম্পদ তিনি ছড়িয়ে দেন প্রতিটি ক্লাসে। সেকেন্ড ইয়ারে তিনি আমাদের গ্রীকল্যাটিন  ইটালিয়ান ক্লাসিকস পড়াতেন। দান্তে- ‘ইনফেরনো’- অনেকটা অংশ খুব মন দিয়ে পড়িয়েছিলেন মনে আছে। আর তাছাড়া ‘ইলিয়া’, ‘অদিসি ‘আয়েনিদ এইসবের কিছু কিছু অংশ অনুবাদে আমাদের পড়ানো হয়েছিল। নাকোর্সের সঙ্গে এগুলোর কোনও যোগ ছিল নাকিন্তু আগেই বলেছিকোর্স বা পরীক্ষা নিয়ে মাস্টারমশাইদের কোনও চিন্তাই ছিল না। এগুলি ছাড়া তিনি রোম্যান্টিক কবিতা পড়াতেন। একজন ক্লাসিসিস্ট রোম্যান্টিক কবিতা পড়ালে যা হয়রোম্যান্টিক কবিদের অনেকসময়ই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত। কিন্তু তাঁর কাছে সাহিত্য পড়া কখনো একঘেঁয়ে হয়ে ওঠেনি। দারুণ মজা করতে পারতেন এই বিশাল মাপের পন্ডিত। একদিন শেলির কবিতা ‘টু  স্কাইলার্ক’ পড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেনআমরা সবে বেশ একটু নড়েচড়ে বসছিহঠাৎ ফিরে এসে দরজা দিয়ে মুখটা ঢুকিয়ে ইংরেজিতে বলে উঠলেন, ‘তোমরা জান তোশেলি কিন্তু লেডিকিলার ছিলেন!’

 

কলেজে গিয়ে প্রথম জ্ঞানের জগতের ঝাঁপ খুলে ভয়ে ভয়ে ভিতরে পা বাড়ালাম। সাহিত্যের সঙ্গে বলতে গেলে সেই আমার প্রকৃত পরিচয়। একটু বুঝিয়ে না দিলেধরিয়ে না দিলে চট করে সাহিত্যের গভীরে তো প্রবেশ করা যায় না। মনে আছে বাংলা ক্লাসে শ্রদ্ধেয় শ্রী হরপ্রসাদ মিত্র প্রথম চিত্রকল্পের আলোচনা করলে কবিতা পড়ার মানেটাই কেমন বদলে গেছিল। এতদিন যেসব কবিতা কেবল আক্ষরিক অর্থ  ধ্বনিমাধুর্যের জন্য পড়ে গেছি সেইসব কবিতা নতুন হয়ে ধরা দিল আমার কাছে। সংস্কৃত ক্লাসে গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ‘কিরাতার্জুনীয়ম’ পাঠ শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। ইংরেজি অনার্স ক্লাসে সিলেবাসের সব বই এমনভাবে খুঁটিয়ে পড়ানো হত যে সাহিত্য পড়ার ব্যাপারটাই যেন অন্যরকম হয়ে গেল। তাছাড়া কি পড়তে হবে তাও তো জানতে হয়। বাড়িতে মায়ের বেশ কিছু ইংরেজি গল্পের বই ছিল। সেগুলি প্রথমে না বুঝে তারপর মোটামুটি বুঝে পড়া হয়ে গেছিল। কিন্তু কলেজে এসে কত লাইব্রেরিকলেজ লাইব্রেরিবৃটিশ কাউন্সিলন্যাশন্যাল লাইব্রেরি। নাম না জানা কত বইইংরেজি অনুবাদে ফরাসীজার্মানরাশিয়ান। মনে আছে ডস্টয়েভস্কি এমন দারুণ যাদু করেছিলেন যে ওই অত বিশাল বিশাল সব বই পড়া হয়ে গেছিল। মানুষের মধ্যে পরস্পরবিরোধী দুটি সত্তা থাকেতার একটি শয়তান আর একটি শুভবুদ্ধিতে ভরা এর খবর আমি প্রথম পেয়েছিলাম হঠা একদিন দুপুরবেলা ফাঁকা বাড়িতে একা বসে ‘ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’ পড়ে। তখন আমি সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। মনে আছে কি দারুণভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছিল সেই কাহিনি আমার ভেতরটা যেন কাঁপতে লাগল। আমি কোনওদিন ভয় কাকে বলে জানিনা বলে মা আমাকে মেয়ে হিসাবে অস্বাভাবিক বলে মনে করতেন। কিন্তু আমার মতো মেয়ে সেই যেন প্রথম ভয় কাকে বলে জানল। সারা দুপুর ধরে একা বাড়িতে সেই অসামান্য বই পড়বার সে যে কি অভিজ্ঞতাআমার সেই প্রথম গায়ে কাঁটা দেওয়া ভয়ের সঙ্গে পরিচয়। মানুষের মনের অন্ধকার দিকের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় গভীরভাবে আমার মনে গেঁথে গেছিল। সে কি নিজেকে দেখতে পাবার জন্যইনা অন্য একরকম ভয়কেমন করে জানবকিতু ডস্টয়েভস্কির স্মেরডিয়াকভ যেন অন্য এক গভীরে নিয়ে গেল সেই দ্বিসত্তার সন্ধানকে। এছাড়াও ছিল ‘পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে ছোটবেলায় কিছু না বুঝে পাগলের কাছ থেকে পেয়ারা নিয়ে মজা করে খেয়েছিকিন্তু পাগলামি ব্যাপারটাকে আমি উঠতি বয়সে বেশ ভয় পেতাম। আজও পর্যন্ত আমি অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থার কোনও মানুষের খুব কাছে যেতে অস্বস্তি বোধ করি।


ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন