যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ। ঘড়িতে – ভোর চারটে। গরুর গাড়ির যাত্রা যখন পারিবারিক তখন গাড়ির উপর একটি ‘হুড’ বসানো হয়, যার পোষাকি নাম ‘টপ্পর’- যা বাঁশের বাতা বেঁকিয়ে গোলাকার এক ইগলু-সদৃশ আকৃতির হয়। তার উপর কানাত কাপড় রঞ্জক সাবানের গোলা জলে চুবিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়। পরে তা ঐ বাতার তৈরি কাঠামোর উপর-নিচ দুদিকেই কভার করা থাকে। তার উপর আলকাতরা-চর্চিত চটের কাপড় যাতে নান্দনিক একটা রূপ পায় এবং টেকসই থাকে। আমার মনে আছে এটা আমার বাবা মিস্ত্রি ডেকে এনে ঘরেই তৈরি করিয়েছিলেন। এবার আপহোলস্টারি অর্থাৎ যাত্রীদের বসার জায়গাটি যথেষ্ট আরামদায়ক করার জন্য প্রথমে পুরু করে খড় বিছানো হয়। তার উপর এক প্রস্থ পুরু কম্বল এবং শেষ ধাপে একটি শতরঞ্জি বিছানো হয়। মোটামুটি বসার ব্যবস্থা বেশ আরামদায়ক। বনেদি পরিবারে আগে রেওয়াজ ছিল গাড়ির আগে-পিছে পাইক-বরকন্দাজ।
আমাদের পরিবহনযান ‘জোতা’ হয়ে গেছে। মতিদার সময়জ্ঞানের তারিফ করতেই হয়। দুই কিষাণকেই দেখেছি, তারা যখন চাষের কাজে ভোরে গরু নিয়ে বেরোত, তখন আকাশের তারা দেখে নিখুঁত সময় নির্ধারণ করত। আর আজ যেমন চারটে তে বেরোবার সময় দিয়েছে, তার আগেই এসে গরুদের বের করে, জোয়াঁলের সঙ্গে ‘জুতে’, টপ্পর লাগিয়ে, গাড়ি যাবার জন্য তৈরি। এদিকে গরুদের কোনো ভোর নেই। গোঁজ-বাঁধা থেকে তাদের খুলে এনে জোঁয়ালে যুক্ত করা মানেই, এবার ভার বও। সে ধানের আঁটি হোক বা মালিকের পরিবার, চাষের মরসুমে ধানমাঠে লাঙ্গল বওয়া হোক বা মই-টানা, কাজ একটাই তাদের ‘ভার বয়ে যাও’। গাড়ির ত্রিকোণাকৃতি মুখ নিচে নামানো থাকে গাড়িতে ওঠার সুবিধের জন্য। তখন বলদযুগলকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে ওঠার জায়গা করে দেওয়া হয়। সবাই উঠলে পর ত্রিকোণ মুখটি জোয়াঁলের খাঁজের ঘাটে ঘাটে মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা থাকে।
যাত্রা শুরু হবে এবার। এই শব্দ-নিঝুম ভোরে সারা গ্রাম ঘুমিয়ে আর আমরা সবাই জেগে এক বহু প্রতীক্ষিত সফরে যাবার জন্য প্রস্তুত। শরতের হিম-জড়ানো ভোর কালো চাদর গায়ে ঘুমিয়ে। একটি হ্যাজাকবাতি, গুটিকয় হ্যারিকেন, খান-দুই টর্চ হাতে গাড়িতে লগেজ তোলা হচ্ছে। জোয়াঁল-বাঁধা নধর বলদযুগল নির্বিকার উদাসীনতায় খড় চিবিয়ে যাচ্ছে। তাদের গলায় বাঁধা ঘন্টাগুলো অহরহ টুংটাং বেজেই চলেছে। ভারি মিস্টি সে ধ্বনি।
একে একে সবাই গাড়িতে ওঠার পর মতিদা নিচে নামানো জোয়াঁলটি দুহাতে তুলে ধরে বলদযুগলের ঘাড়ে চাপিয়ে দক্ষহাতে দড়ি দিয়ে বাঁধার পর মাথা নিচু করে জোয়াঁলের তলা দিয়ে পেরিয়ে এসে একলাফে চালকের আসনে দুদিকে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। হাতে ধরা ছোট আকারের লাঠি- ‘হেলেবাড়ি’। এই একটাই ডিভাইস- গাড়ি চালনার ‘কন্ট্রোল স্টিক’। আকারে আড়াই ফুটিয়া এক বাঁশের লাঠি। বাঁয়ে যাবার হলে ‘ডানআলি’ বলদটির পেটের ডানদিকে আস্তে আস্তে হেলেবাড়ি দিয়ে মৃদু আঘাত মানেই ডানদিকের বলদটি বাঁদিকে ঘুরে যাবে আবার বাঁদিকে ঘুরতে হলে ঠিক তার বিপরীত। গাড়ি থামানোর প্রয়োজন হলে জোয়াঁলের ঠিক মাঝখানে হেলেবাড়ি দিয়ে মৃদু স্ট্রোক দিয়ে শব্দ তুলে ‘হা-হা’ মুখ দিয়ে আওয়াজ করলেই বলদযুগল দাঁড়িয়ে পড়বে। আবার সচল করতে হলে, ‘হেট পা-পা’ বলতে হবে হেলেবাড়ি উঁচিয়ে। দৌড় করাতে হলে দুজনের ল্যাজ দুহাতে ক্রমাগত মুচড়িয়ে পায়ের দুই বুড়ো আঙুল দিয়ে পেটের তলায় মোক্ষম খোঁচা, ব্যাস, গাড়ি চলবে জোর কদমে। তবে তা কখনোই দূরপাল্লার ট্রিপে এর প্রয়োগ করা হয় না, তাতে বলদেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে তাড়তাড়ি।
দালানবাড়ি ছেড়ে আমাদের যাত্রা হলো শুরু। চারিদিক আঁধারমাখা। যেন রাত্রি এখন। গাড়ির কাঠামোর নিচে বাঁধা ঝোলানো লন্ঠনের মৃদু দোদুল্যমান আলো। দুটোই অন্ধকার কিন্তু গভীর রাত্রির আঁধার আর ভোরের আঁধারের তফাতটা বোঝা যায়। কিন্তু তাকে প্রকাশ করা বেশ মুস্কিল। আমাদের আমবাগানের ভিতর দিয়ে মেঠোপথ ধরল গাড়ি। মতিদার কাছে জানলাম, পুরো রাস্তাটাই এরকম মেঠোপথ। মেঠোরাস্তায় লোহার পাত দিয়ে মোড়া কাঠের চাকার ঘর্ষণে এক অদ্ভুত মিঠে সুরের আবহ তৈরি হচ্ছে। জনা পাঁচেক যাত্রী গাড়ির কৃপণ পরিসরে মধ্যবিত্ত ক্ষমতায় বসেছি। তার মধ্যে স্তুতি আর মা আদ্দেক রাজত্ব দখল করে বসে আছে আর আমরা বাকি তিনজন অপর অর্ধে সন্নিবিষ্ট। লোক মারফত আমাদের যাত্রা-বারতা ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে দিদিমণির কাছে। সেখানেও নিশ্চয় পুজোয় সমাগত আত্মীয়ের ভীড় থাকার কথা। ঘরভর্তি লোকে হয়ত গমগম করবে। সেখানে কারা-কারা এসেছে, কাদেরই বা দেখতে পাবো গিয়ে এমনতর আলোচনায় আমরা সবাই মশগুল। নিঃঝুম বাগদিপাড়ার ভিতরের কুলি বেয়ে গাড়ি এবার উঠবে মূল সরাণে। দু-চারটে পাড়ার কুকুর রাস্তার উপর বেশ নিশ্চিন্তে কুন্ডলি পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল, আমাদের গাড়ি এসে পড়ায়, ঘুমের অন্তরায়। বেশ বিরক্তি নিয়ে রাস্তার খড়-বিছানো আরামের শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের গাড়ি পেরোবার রাস্তা ছেড়ে দিল কিন্তু খুব যে খুশি হতে পারেনি, একথা তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে স্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার কুন্ডলি দিল। এবার পাশের গাঁ হজরতপুর অভিমুখে একটানা সিধে রাস্তা। দূরে কিছু স্পষ্টভাবে ঠাওর করা যাচ্ছে না শুধু গাছগুলির মাথায় মাথায় ঝাঁকবাঁধা আঁধার, মূর্ত হয়ে উঠছে অজস্র জোনাকির ঝকমকি চুমকিতে। গাঁ ছাড়িয়ে এক খোলা প্রান্তরে গাড়ি এসে পড়ল।
যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত করা যায়, কোত্থাও জনমানব নাই। দূরে তালপুকুরী ধারে দু-একটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। স্তুতির আবার ভীষণ ভূতের ভয়। এসব অপার্থিব আলো দেখে কিছুটা আড়ষ্ট। মা জানালো, যারা ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ভোরের বেলায় তাল কুড়োতে আসে তাদের হাতেও এমন আলো থাকে। ভাদ্রমাস বড় আকালের মাস। সেসময় বছরের জমানো চালে টান ধরে আসে। নবান্ন না আসা অব্দি তাদের খুব কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে। চাষের কাজ সব বন্ধ থাকে ফলে রুজি-রোজগারেও টান। সেই দুর্দিনে এই তাল কুড়িয়ে, তার থেকে খাবার বানিয়ে তাদের অভাব অনেকটাই মেটে। তাই ভোররাত্রে ওরা তালের খোঁজে লন্ঠন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আর এই তাল প্রসংগ আসতেই আমার ছেলেবেলাকার কিছু স্মৃতি উসকে দিল। যখন গ্রামের স্কুলে পড়তাম, ভাদ্রমাস এলেই, তাল কুড়োনোর হিড়িক পড়ে যেত আমাদের মধ্যে। তাল পাকলে তা গাছ থেকে আপনা-আপনি খসে পড়ে মাটীতে। সেই খসে-পড়ার শব্দটিও অদ্ভুত- ‘ঝলাং-ঢিপ’। দুটি স্পষ্ট শব্দ-ব্যঞ্জনা এবং তা প্রকট।। প্রথম শব্দটির উৎপত্তি তালগাছের নিচের সারির পাতার (বাগড়ো) বাধা পেরিয়ে আসার আর দ্বিতীয় শব্দটি কয়েক সেকেন্ড পর মাটীতে পড়ার বিকট শব্দ। এবং এই শব্দটির আওয়াজ বেশ সুদূরপ্রসারী। ব্যস ! সংলগ্ন এরিয়ায় ‘তাল-সন্ধানী’ যত উতকর্ণ এবং ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন কিশোর-যুবার দল যে যেখানেই থাকুক না কেন, সেই মধুর দুটি শব্দের অভিকেন্দ্রের দিকে প্রায় নির্ভুলভাবে এবং সংক্ষিপ্ততম রুটে অকুস্থলে পৌঁছে যেত। সেই ভূপতিত তালের উপর প্রথম স্পর্শ যার, সেই তালটির উপর সম্পুর্ণ অধিকার তারই। তালের মালিকানা বা অধিকার নিয়ে যে বাগ-বিতন্ডা, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-মারামারিও যে হতো না, তা নয়। এমনও দেখা গেছে দুটি কিশোর প্রায় একই সময়ে তালের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, বাকিরা একটু পিছনে। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। কে পায়, কে পায়। তালটি দেখা যাচ্ছে উবু হয়ে অর্ধাংশ জেগে আছে হলুদ-কালোর অপরূপ মিশ্রণে। সেই উত্তেজনার মোক্ষম মুহূর্তে একটি কিশোর গোলকিপারের দক্ষতায় সামনে ডাইভ মেরে তালটিকে স্পর্শ করল সারা শরীর দিয়ে। সারা গায়ে কাদা-জল মেখে কাংক্ষিত তালটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল বীরের ভঙ্গিমায়। ওদিকে ফিনিশিং লাইনে এসে পরাভূত কিশোরটি একমুখ বিস্ময় নিয়ে তার দৌড় শেষ করল। এ শুধু তাল-জয় নয়, এক তীব্র প্রতিযোগিতায়, পুরুষাকারের জয়।
খুব সুন্দর।মনগ্রাহী লেখা। চালিয়ে যান। লেখা থামাবেন না।
উত্তরমুছুন