আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখা হয়নি। পড়াশুনা তেমনভাবে করতে হলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখা সম্ভব নয় বলে ক্লাস নাইন-এ ওঠার পর থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলাম। এবারের মাস্টারমশাই দারুণ মানুষ ছিলেন। তিনি তখন গীতবিতানে গান শেখাতেন, অল ইন্ডিয়া রেডিওতে
বি-হাই আর্টিস্ট ছিলেন, তবুও আমাকে বাড়িতে এসে গান শিখিয়েছিলেন। তাঁকে কোনওদিন ভুলবো না। তাঁর তখন বয়স খুব কম। যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি হাশিখুশি অমায়িক মানুষ। তাঁর নাম সৌরেন রায়। তাঁর জীবনের গল্প আমাকে খুব নাড়া দিত। স্কুলের পড়া শেষ হতেই একটা কেরানীর চাকরি তাঁর জন্য জোগাড় করে তাঁর বাবা তাঁর বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। পড়াশুনা করা আর গান শেখা, এই তাঁর আকাঙ্ক্ষা, তাই তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছিলেন। কিন্তু দেশটা তো আমাদের। তিনদিন কলের জল খেয়ে রাস্তায় কাটিয়ে তিনি ফিরে এসে বাধ্য হয়ে সেই চাকরি আর বিয়ে দুটোই করেছিলেন। অন্য পথ পাননি। তবু তিনি গান এমনই গাইতেন যে অবাক হয়ে যেতাম। সংসারের জোয়াল আর অর্থকষ্টে তিনি নাম করতে পারেননি, কিন্তু তাঁর অজস্র ছাত্রছাত্রীর কাছে অঢেল শ্রদ্ধা পেয়েছেন। তাঁর কাছে নানান গলায় নানা ভঙ্গীতে বাল্মীকিপ্রতিভার ডাকাতদলের গান যিনি শুনেছেন তিনি কখনও তা
ভুলতে পারবেন না। আমি শিলিগুড়িতে চলে গেলাম বিয়ে হয়ে, আর সেই সঙ্গেই আমার গান শেখার পর্ব শেষ হল। কিন্তু এখনও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ আছে। পঁচাশি পেরিয়েও তিনি আসরে গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন।
এছাড়া আর একটা কথা মনে পড়ছে। ঠিক স্কুলে ভর্তি হবার আগের ঘটনা। পাড়ার বাচ্চারা মিলে একটা নাটক করবে ঠিক করল। রাম-সীতার কাহিনি। আমি হলাম রাম। সীতা আমার চেয়েও ছোট এক মেয়ে। মজার ব্যাপার ছিল যে আমি কেমন করে যেন নিজেকে কল্পনায় গুলিয়ে ফেলেছিলাম নাটকের চরিত্রের সঙ্গে। সে এক উদ্ভট ব্যাপার হয়েছিল, বকাঝকা খেয়ে একাকার।
আমাদের দু-ভাইবোনের পড়াশুনা ছিল অদ্ভুত। তখনও তো বাড়িতেই সব। আর মায়ের কথামতো। মায়ের ধারণা ছিল যে ইংরেজি আর অঙ্ক ঠিকমতো শিখলেই হয়, আর কিছুর দরকার হয়না। আমরা দুভাইবোন ঠেসে ইংরেজি আর অঙ্ক করতাম সারাদিন। বাড়িতে কথাবার্তা বাংলাতেই হতো, কিন্তু লিখিত বাংলা এত দেরিতে শিখেছিলাম যে এখন ভাবলে অবাক লাগে। মনে আছে বছর আষ্টেক বয়সে নদীর রচনা লিখেছিলাম। সে যে কি বস্তু হয়েছিল তা আর কারো মনে না থাকলেও আমার ঠিকই মনে আছে। বাড়িতে সেই রচনা নিয়ে বহুদিন অনেক হাসিঠাট্টা হয়েছে। কথা বলার একটা মাতৃভাষা আর লেখার জন্য তাই আমার যেন অন্য একটা মাতৃভাষা আজও পর্যন্ত রয়ে
গেছে। বিদেশিনীকে সৎ মা বলে জেনেও টানটুকু ভুলতে পারিনা।
আমার মা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে বি,এ পাশ করেছিলেন, এবং সে নিয়ে যথেষ্ট শ্লাঘা বোধ করতেন আমার মা, বাবা, দুজনেই। অফিস এবং স্কুলে চাকরিও করেছেন মা। মায়ের আসল গুণ ছিল, তিনি সাহিত্য ভালবাসতেন, আর নিজে ছোটবেলায় সামান্য লেখালেখিও করেছিলেন। আমার মনে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তিনিই জাগিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে যে লেখা যায় এই ভাবনা আমার মনে জাগিয়ে দিয়েছিলেন আমার মা। কিন্তু আবার তাঁরই জন্য উঠতি বয়সে যখন অনেক লেখা শুরু করেছি, তখনই হঠাৎ লেখালেখি ছেড়েও দিয়েছিলাম। কিন্তু সেকথা পরে।
মা পড়তে ভালবাসতেন বলে আমাদের বাড়িতে বাংলা ইংরেজি দুই ভাষার সাহিত্যের বেশ কিছু বই ছিল। আজ বুঝি আমার ছোটবেলা অন্যদের থেকে আলাদা একরমের ছিল। বেশ উদ্ভট ধরণের একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলাম আমি। দুটো জিনিষের নেশা ছিল আমার। পড়াশুনা আর গল্পের বই পড়া। আমাদের বাড়িতে মায়ের জন্য অনেক গল্পের বই ছিল কিন্তু শিশুপাঠ্য বই কিছুই ছিল না। যেখানে যে বাড়িতে কোনও পড়বার মতো বই দেখতাম সেই বই নিয়ে বসে যেতাম। আমার বড়মাসির বাড়ি ছিল খিদিরপুরে। সেখানে শুকতারা আসত। আমি সেখানে গেলে সেই যে শুকতারা নিয়ে বসতাম, আর উঠতাম না। এ নিয়ে মা খুবই বকাবকি করতেন। মনে আছে পড়াশুনা করে বাবা-মাকে তাক লাগিয়ে দিতাম। বই কে বই কবিতা মুখস্ত ছিল, যে শুনতে চাইত তাকেই শোনাতাম। সুকুমার রায়, সত্যেন দত্ত থেকে চট করে খুব বাচ্চা বয়সেই কেমন করে রবীন্দ্রনাথে চলে এলাম। খোদ রবীন্দ্রনাথের মতোই বোঝাবুঝির বিশেষ দরকার বোধ করিনি তখন। পড়ার নেশায় সঞ্চয়িতা, চয়নিকা থেকে কবিতার পর কবিতা পড়ে যেতাম। কিছুই বুঝিনি ঠিকই, তবু তার কিছুটা মানে বুঝি। ছন্দের একটা টান আছে, শব্দের একটা দোলা আছে। কবিতা না বুঝলে ঠিক যায় আসে না, কারণ কবিতা বোঝার মতো জিনিষই নয়। কিন্তু কি করে যে কিচ্ছু না বুঝে দশ-এগারো বছর বয়সে ‘গোরা’ আর ‘চতুরঙ্গ’, পড়ে ফেলেছিলাম তা আমি আজও বুঝিনা। মনে আছে কেবল কথোপকথন অংশ একটু-আধটু বুঝতাম, তাই সেগুলো পেন্সিলে দাগ দিয়ে রাখতাম। ইংরেজি যা বই ছিল তারও সেই একই হাল, একবর্ণ না বুঝে ডিক্সনারি হাতে নিয়ে পাতার পর পাতা গিলে যাওয়া। কেবল শেক্সপীয়রে দাঁত ফোটাতে পারিনি মনে আছে। শিশুপাঠ্য বই না পেলে হয়ত শিশুমন তার খিদে এভাবেই মেটায়।
একবার জন্মদিনে বড়দাদা এলেন। তিনি আমার দাদা কিন্তু আমার মায়ের চেয়েও বছর ছয়েকের বড় ছিলেন। সেই আমলের এসব ব্যাপার আজকের দিনে অদ্ভুত লাগবে জানি, কিন্তু মজার কথা এই যে তিনি আমার নিজের মাসতুতো দাদা, আমার বড়মাসির ছেলে। বড়মাসির নাকি বিয়ে হয়েছিল বারোতে আর সন্তান হয়েছিল তেরোতে। আমার খুব অল্প বয়সেই বড়দাদা চলে যান, কিন্তু তাঁর অজস্র স্নেহ আমি আজও ভুলতে পারিনি। যাইহোক, বড়দাদা আমার আটবছরের জন্মদিনে এলেন হাতে এক যাদুপুঁথি নিয়ে--- সেই আমলের নামকরা শিশুদের পত্রিকা ‘শিশুসাথী’-র পুজো সংখ্যা। সেই বই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বই। কি এক আশ্চর্য জগৎ খুলে গেল আমার সামনে, সে যে কি মুক্তি, কি আনন্দ, আমি তো মন খুলে বলবার মতোও কাউকে পাইনি, একা একা এত আনন্দ হজম করে গেছি। ভাই এসব বুঝত না, সে এসবের অংশীদার ছিলনা কোনওদিন। গোপন কথা ফাঁস করলে আজ সবাই হাসবেন, কিন্তু আজও আমি ছোটদের বই পেলে না পড়ে থাকতে পারিনা। কি করব, ছোটদের যত বই সবই তো আমি অনেক বড় হয়ে পড়েছি। আঠেরো বছর বয়সে দশবছরের ছোট মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে মামাবাড়ির পথে বর্ধমান লোক্যালে বসে আমার প্রথম ‘বুড়ো-আংলা’ পড়া। ওই ভাইটার আজও দেখছি সেকথা মনে আছে। কোনও মানে হয়?
ক্রমশ...
খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনবেশ ভালো লাগলো। অনেকেই স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারেন।
উত্তরমুছুন