শ্রাবণের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ছবি
মৃত্যু-মুক্তি-স্মৃতিবিষে দেশের ভাঙন
বিষণ্ণ আকাশ যেন বাইশে শ্রাবণ
বেদনা গভীর তবু জ্যোতির্ময় রবি!
শেষ রাত্রে বেজেছিল স্বাধীনতা ভেরী
যন্ত্রণার অবসানে মুক্তির আস্বাদ
তবুও কাঁটার মতো বেঁধে আমাদেরই
ক্ষমতার রাজনীতি জাতীয় বিবাদ।
তারপর কেটে গেছে কত শত দিন
স্বাধীন হয়েছি তবু পরাধীন মন
উপনিবেশের মায়া এখন রঙিন
মোড়কে সাজানো দেখি নতুন ধরন;
অলীক মোহের ঘোরে আজও আত্মক্ষয়
আমরা ধরেছি ছায়া, স্বাধীনতা নয়!
আমরা ধরেছি ছায়া, স্বাধীনতা পারিনি ধরিতে! - জীবনানন্দের কবিতার পঙ্ক্তিকে ঈষৎ বদলে নিয়ে এই উচ্চারণ একালে বেশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আমার। স্ব-অধীন হওয়াই যে স্বাধীনতা, অন্ধ অনুকরণ ও স্বেচ্ছাচারিতা নয়; তা এখনো বুঝতে পারিনি আমরা অনেকেই। তাই ভারতের স্বাধীনতা লাভের আনন্দ এবং অভিশপ্ত দেশভাগের পঁচাত্তর বছরের সীমায় এসে মুক্তি ও বিচ্ছেদের স্মৃতিকে পুনর্বিচার করতে বসি। কী পাইনি তার তালিকা যদিও অনেক বেশি। দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া - একথা বলার মতো লোক এখন কম। ভুবনগ্রামের বাসিন্দা হয়ে মানুষ এখন গ্লোবাল সিটিজেন হয়ে বাঁচতে ভালোবাসে। যদিও ঔপনিবেশিতা থেকে আমরা মুক্ত নই আজও। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী কূপমণ্ডূকের সংখ্যাও কম নয়। তাঁরা বিশ্বসাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি সংক্রান্ত জানালা বন্ধ করে দিয়ে বাঁচে। দেশভাগ এবং স্বাধীনতার একত্র পঁচাত্তর বর্ষ উদ্যাপনে এসব কথা আমাদের ভাবতে ইচ্ছে করে বারবার।
প্রদেশ একদা ছিল, আজ পরদেশ
‘১৯৪৬-৪৭’ – জীবনানন্দ দাশ তাঁর এই কবিতার শিরোনামে দুটি সাল-কে হাইফেন দিয়ে জুড়ে হয়তো ভিন্ন বার্তা দিতে চান আমাদের। যদিও সে-বার্তা আসলে পরস্পর সম্পৃক্ত। ছেচল্লিশের প্রাণঘাতী আর হিংসাত্মক দাঙ্গা এবং সাতচল্লিশের খণ্ডিত স্বাধীনতার আনন্দ-বেদনা ওই কবিতায় উৎকীর্ণ হয়ে আছে। ঐতিহাসিকের চোখে, যে-স্বাধীনতা একদিকে আমাদের জয় আর অন্যদিকে দেশভাগের মর্মান্তিক বিয়োগান্ত নাটক – তার প্রত্যক্ষ রূপ সাহিত্য-সংস্কৃতির দর্পণে প্রতিফলিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সমালোচকেরা যাকে দেশভাগের সাহিত্য বা ভাঙা বাংলার সাহিত্য বলেন, তার মধ্যে গল্প-উপন্যাস-নাটক-গান এবং চলচ্চিত্রও পড়ে যায়। তবে দেশভাগের সাহিত্যের সীমানাটা অনেক বেশি, সাদাত হাসান মান্টো-র ‘টোবা টেক সিং’ বা ‘খোল দো’র মতো বিখ্যাত উর্দু গল্পে পাঞ্জাব বিভাজনের বেদনা, দাঙ্গার কুফল, খালেদ হুসেনির ‘টেন টু পাকিস্তান’ কিংবা ত্রিপুরা-আসাম অঞ্চলের সাহিত্যেও দেশভাগের ছায়া নিবিড়ভাবে পড়েছে। এবং লক্ষণীয় আনন্দ নয়, যন্ত্রণাকীর্ণ এইসব রচনা। যে-বিষাদ তিরিশের কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-কে দিয়ে লিখিয়ে নেয় একটা ‘পুব-পশ্চিম’ আর একুশ শতকে সত্তরের কবি জয় গোস্বামী লেখেন ‘নন্দর মা’। পঞ্চাশের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাহাকার করেন :
এই দেশবিভাগ, বাংলা বিভাগ এখনও
শেল হয়ে বিঁধে আছে আমার বুকে
এটা ইতিহাস, মেনে নেওয়াও তো উচিত
কিন্তু যখনই ভাবি, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কি করতেন
বাংলা ছিল যার প্রাণ, তিনি কি আর একদিনও বাঁচতেন
মাঝে মাঝে এইসব ইতিহাসের মুখে
জুতো মারতে ইচ্ছে হয় না? (পাখির চোখে দেখা : ৮ / শারদীয়া দেশ ১৪১৮)
ব্রিটিশ ভারত ছাড়ল, যদিও রেখে গেল অনপনেয় বিচ্ছেদের ভার। এপার থেকে ওপারের দূরত্ব নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় বড়ো বেদনায় লিখলেন, ‘প্রদেশ একদা ছিল, আজ পরদেশ / পাসপোর্ট ভিসা বিনে নাইকো প্রবেশ’। ‘উদ্বাস্তু’ কিংবা ‘শরণার্থী’ - জন্ম নিয়েছিল এই নতুন শব্দ। শিকড়ছেঁড়ার বেদনা নিয়ে অসংখ্য মানুষ পুববাংলা থেকে পশ্চিমবাংলায় এলেন, তাদের স্বদেশ হয়ে গেলো পাকিস্তান নামের বিদেশ। এপার বাংলায় নামলো ছিন্নমূল বাঙালির ঢল। ধর্মের নিরিখে ভারত তথা বাংলা ভেঙে ভাগ করার অপচেষ্টা ফলপ্রসূ হল। ভারতীয় নেতারাও রাজনৈতিক ক্ষমতার মোহে তা’ মেনে নিলেন। বলা হল, দেশ ভাগ হলেও মানুষের মন ভাগ হবে না। অথচ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশিষ্ট বাঙালি কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য লেখেন :
অথচ আমরা দেখলাম
প্রথমে মানুষ ভাগ হল
ভাগ হল তাদের মন
তারপর দেশ ভাগ হল। (ভাগের মা)
ভাগ হয়ে যায় পুজো ও মহরম
ইতিহাসের এই রক্তাক্ত সময়ের দিকে তাকিয়ে তথ্যানুসন্ধানী হলে, প্রবল ক্ষুধা,দারিদ্র্য, অভাবে স্বভাব নষ্ট, নীতি বিসর্জন, অকাল মৃত্যু আর হত্যার ছবি আমাদের পীড়িত করবে। প্রবোধকুমার সান্যালের ‘হাসুবানু’, ‘অঙ্গার’ কিংবা অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘নির্বাস’ সেই উদ্বাস্তু জীবন ও পুনর্বাসনের বিশ্বস্ত ছবি তুলে ধরে। রয়েছে সলিল সেন-এর ‘নতুন ইহুদী’, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাস্তুভিটা’ নাটক এবং ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ , সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ ইত্যাদি একাধিক উল্লেখযোগ্য সিনেমা। সাম্প্রতিক কালে লেখা একাধিক আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথা ‘বিষাদবৃক্ষ, ‘দয়াময়ীর কথা’-র ভিতরেও বাংলা ভাগ আর দেশ ছেড়ে আসার অসহনীয় বেদনার বর্ণরাগ। কিন্তু বঙ্গভাষা তো বদলায় না, হয়তো রাঢ় বাংলার ভাষার সঙ্গে তফাত থেকে যায় বঙ্গালীর কিংবা সিলেটির, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। মুসলমান প্রধান দেশ হওয়ায় ওদেশের বাংলায় ইসলামী শব্দের স্বাভাবিক অনুপ্রবেশ ঘটে, সাম্প্রদায়িক মনোভাবও যুক্ত হয়। তবু পাতা ঝরা আর দেশ ভাঙার শব্দ একাকার হয়ে বাজে অলোকরঞ্জনের কানে :
পাতা ঝরলে
পুবের সঙ্গে পশ্চিমের
আওয়াজে মিল নেই;
ভাগ হয়ে যায় পুজো ও মহরম
এ ভাষা কী করে করি রপ্ত? (পাতা ঝরছে)
মণীন্দ্র রায়ের ‘চিঠি’ কবিতায় হিন্দু বৃদ্ধার মনে ফেলে আসা মুসলমান ছেলে-মেয়েদের জন্য স্নেহ ঝরে পড়ে। দিনেশ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় কিংবা রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ কবিদের মনে গঙ্গা-পদ্মার জোর করে গড়ে তোলা বিভেদ আর ভাষা ভাঙার অস্থিরতা খেলা করে। পঞ্চাশের তরুণ সান্যাল কিংবা শঙ্খ ঘোষ, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, তারাপদ রায়, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী প্রমুখ অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত আর ‘পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি’ বুকে নিয়ে দেশহীনতার অনুভবে ব্যথাতুর হন। তবু ‘বাংলা ভাষাই তখন আমার একমাত্র দেশ’ – এই উচ্চারণ চিরকালীন হয়ে আশ্বাস জোগায়।
নতুন জিনিসের নতুন নাম – উদ্বাস্তু
ভাঙা বাংলার স্মৃতির ভিতরে নিহিত রয়েছে ছিন্নমূল কান্না – যদি এইভাবে ভাবি, ভুল হবে কোনো? আমরা যারা দেশভাগ দেখিনি, এপার আর ওপার বাংলার বিভক্তরূপ দেখেই বড়ো হয়েছি তাদের কাছে এই ছিন্নমূল বাঙালির ধারণাটি বেগানা মনে হতে পারে। ইদানীং বাংলা ভাষার তাগিদে দুই বাংলার ভিতরে একটা আন্তরিক যোগ থাকলেও সংস্কৃতিগত প্রভেদ তৈরি হয়েছে যথেষ্ট। রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনও। তাই চোখের দুটি তারা হিসেবে দেখার ভাবালুতা কতটা সমর্থন করা যায়, এ-নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু যাঁরা অখণ্ড বাংলাকে দেখেছেন, পূর্ববঙ্গে বাস করেছেন তাঁরাই জানেন দেশভাগের বেদনা কি প্রবল। শুধু তো জন্মস্থান ছেড়ে আসা নয়, ভিটেমাটি, মান-সম্মান, ঐতিহ্য সব ছেড়ে আরেক বাংলায় আশ্রয় খোঁজার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। জীবনযাপনের আমূল পরিবর্তন আর শিকড়ের টানকে ভুলতে না পারা – এই দ্বান্দ্বিকতায় ভাঙা বাংলার সাহিত্য হয়ে উঠেছিল কিছু স্মৃতি আর কিছু অশ্রুর শিল্পিত বয়ান। আমরা আগেই বলেছি, সেই বয়ানগুলির মধ্য থেকে আমি কেবল কবিতা-কেই বেছে নিয়েছি। কারণ, আমার বিশ্বাস কবিতাই সেই দর্পণ যার ভিতরে ধরা পড়ে প্রতিটি সংবেদী মানুষের আত্মপ্রতিকৃতি। এ-প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়া স্বাভাবিক তরুণ সান্যালের সেই চমৎকার সংজ্ঞা : ‘স্মৃতিলাঞ্ছন শব্দ দিয়ে গড়ে তোলা হয় কবিতা।’ তাই দেশভাগের বেদনার স্মৃতি যে-কবিকে তাড়া করে ফেরে তার কবিতায় জীবন্ত হয়ে ওঠে সেই সময়। পাশাপাশি দীর্ঘ কালের দূরত্ব যে স্মৃতির কুয়াশা তৈরি করে সেখানেও তৈরি হয় আরেকটা ধরন। আমরা দেশভাগের অব্যবহিত পরেই একজন অবাঙালি কবির কবিতা বঙ্গানুবাদে পড়ি,
শুনেছি তো আলোর ছটায় মিলিয়ে গেছে অন্ধকার
শুনেছি তো মিলনের ভালোবাসায় মিটে গেছে বিষাদ,
ভেবে যারা ব্যথা পায়, অনেক নাকি পালটে গেছে তারা,
পুণ্য শুধু মিলনের আনন্দ, পাপ নাকি বিচ্ছেদের বিষাদ । (ফৈয়জ আহমদ ফৈয়দ : ১৯১১-১৯৮৪)
কিন্তু সময় সবকিছুকে সহনীয় করে তোলে। এই বিচ্ছেদ-বেদনা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে, কেবল রয়ে যায় চাপা যন্ত্রণা। প্রায় মিলিয়ে যাওয়া ছিঁড়ে যাওয়ার দাগ কখনো কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে স্মৃতিকে জাগায়। তখন যেসব কবিতা লেখা হয় তার ভিতরে বেদনার স্পর্শ থাকলেও তা অনেকটা সহনীয়। আস্বাদযোগ্য হয়ে পাঠকের কাছে ধরা দেয়। তার মানে এই নয় দেশভাগ কিংবা বঙ্গবিভাজন একালের থীমকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে কেবল একটা থীমে পর্যবসিত হয়ে যায় তখন। তেমন হলে সে-কবিতা নিছক সুসজ্জিত বাক্ছল মাত্র বলা যায়। বেদনাকে সেখানে পণ্য করা হয়। তবে আশার কথা এই, বাঙালি কবিরা এই স্পর্শকাতর বিষয়-কে নিজস্ব অনুভব দিয়েই কবিতায় এনেছেন। রবীন্দ্র-সমকালে জাত এবং রবীন্দ্রোত্তর পর্বেও সক্রিয় কুমুদরঞ্জন মল্লিক তাই লিখতে পারেন :
গৃহে যেই চাল নাই
দীনু তিনু দুই ভাই
ভিনু হত তারা জমিতে হইলে ধান।
এও যে ধরন সেই
স্বাধীনতা এল যেই
ভাগাভাগি হবে হিন্দু মুসলমান।
গণমন অধিরাজ
কেন এ বদল আজ?
মিলাবে কোথায় ভাঙার পাণ্ডা হলে? ( জিন্নাজির প্রতি / বিষের বাঁশি)
তবু তো ভাঙন এলো। যে-ভাঙার জন্য একা জিন্না কিংবা নেহরুকে দায়ী করা বোধহয় উচিত নয়। মূল কারণ অনেক গভীরে নিহিত এবং ঐতিহাসিকের অনুসন্ধানে তার বিভিন্ন সূত্র ইদানীং ধরা পড়ছে। বাংলা এবং পাঞ্জাব-বিভাজন তো ঘটে গেল, কিন্তু তারপর যে কয়েক কোটি মানুষের স্থানান্তর ঘটল এবং যারা মাটি কামড়ে নিজের ভূমিতেই রয়ে গেল, এ-দুয়ের পরিসংখ্যান নিয়েও ঐতিহাসিক আর সমাজতাত্ত্বিকরা নিয়ত চর্চা করছেন। কিন্তু কবি তো তত্ত্বকথা শোনান না। তিনি লেখেন একান্ত অনুভব, যা কখনও সামূহিক স্বর হয়ে যায় :
আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত
আমার বুকে পালানোর পালানোর আরো পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি। (দেশহীন / শঙ্খ ঘোষ)
প্রতারক হলেও সেই স্মৃতিই বিশেষ মূল্যবান। তাই ‘বঙ্গবিভাজনের স্মৃতি’ কবিকে তাড়া করে ফেরে। কেবল ঘটনা নয়, সেই রক্তাক্ত স্মৃতির ভিতরে হত্যা আর কান্নার পাপ :
আরো ঘূর্ণি শোণিতে কান্নায় মানুষের
মা আমার, আমাদের হত্যা
পাপে
পরস্পর বিশ্বাসের চিড়ে
জীবনের হৃদয়ের অঞ্জলি অঢেল, হে যৌবন
এপার ওপার বাঙলা দুঃখময়তায়
অশ্রুমতী ... (অমৃত আস্বাদে মৃত্যু বাংলাদেশ / গণেশ বসু)
দেশছাড়া হয়ে যাঁরা এ-বাংলায় এলেন, তাঁদের বলা হলো ‘উদ্বাস্তু’। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কবিতায় এই উদ্বাস্তুদের ছবি আঁকা হয়েছে :
আসল জিনিস দেখবি তো চল ওপারে,
আমাদের নিজের দেশে, নতুন দেশে,
নতুন দেশের নতুন নতুন জিনিস – মানুষ নয়, জিনিস –
সে জিনিসের নাম কী?
নতুন জিনিসের নতুন নাম – উদ্বাস্তু। (উদ্বাস্তু)
‘জিনিস’ - এই অভিধাই বুঝিয়ে দেয় উদ্বাস্তুদের কেমন তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হতো। সলিল সেন যাঁদের ‘নতুন ইহুদী’ বলছেন তারা এই উদ্বাস্তুই। ‘ডায়াস্পোরা’ এই গ্রিক শব্দের আক্ষরিক অর্থ ছড়িয়ে যাওয়া বা ছত্রভঙ্গ করা। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদী বিতাড়নের ইতিহাস শব্দটিকে গুরুত্বময় করে তুলেছে, সেখানে দেশছাড়া হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীকেই ‘ডায়াস্পোরা’ বলা হয়। যার বাংলা প্রতিশব্দ ছিন্নমূল যথাযথ না হলেও কাছাকাছি। ভারত ভাগের ফলে সৃষ্টি হওয়া প্রায় কয়েক কোটি উদ্বাস্তু-কে উপনিবেশ-উত্তর ডায়াস্পোরা বলা চলে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিল তাদের মধ্যে বহু মানুষ। কুমুদরঞ্জন মল্লিক লিখেছেন :
উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়িছে, অন্ন বস্ত্র চাকুরি চাহি,
হে কবি, তোমার কবিতা পড়ার ইচ্ছা এবং সময় নাহি।
দুর্ঘটনার নাহিকো অবধি, দিন যে কাটিছে চিন্তা ভরে,
সকল দ্রব্য অগ্নিমূল্য, - মানুষের প্রাণ এত কি সহে? (কবি-কথা / কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা)
আর এসব নিয়ে সংকীর্ণ-রাজনীতিও কম ছিল না। উদ্বাস্তু মানুষেরাও টিকে থাকার তাগিদে রাজনীতিকে আশ্রয় করলেন। আর এভাবেই স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে শুরু হলো পূর্ববঙ্গবাসী তথা বাঙালদের বাঁচার লড়াই। ‘নতুন ইহুদী’ নাটকের শেষ দৃশ্যে বাবা, ভাই, বোন-কে হারানো উদ্বাস্তু মোহন-কে তাই রাজনৈতিক কর্মী মহেন্দ্রের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়। সে মৃত্যুর আগে প্রতিশোধ নিতে চায়। মহেন্দ্র তাকে উৎসাহ দিয়ে বলে :
‘মনে মনে সমস্ত প্রপীড়িতদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শপথ নাও যে স্বার্থলোভী, অর্থলোলুপ যারা তোমাদের ভাগ্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের শাস্তি দেবে। হৃদয়হীন শোষকদের অত্যাচার তুমি খতম করবেই, ভাগ্যের গোলামী তুমি আর বরদাস্ত করবে না কিছুতেই।’
তার এই বক্তব্যের ভিতর কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসের সুর ধরা পড়েছে, যা নাট্যকার সলিল সেনেরও মনের কথা।
মনে পড়ার দুঃখ আমার ছিন্নমূলের স্মৃতি
দেশভাগ আসলে স্মৃতিবাহিত এক রক্তাক্ত অধ্যায়। স্মৃতি খুঁড়লেই উঠে আসে সেসব ভয়ের চলচ্ছবি। সুধেন্দু মল্লিকের কবিতা মূলত ঈশ্বরীয় আবেশ রচনা করে শান্ত ও সাত্ত্বিক, তবু তিনিও লেখেন :
নিশ্চিন্তে ভুলে যাই আমাদের পিছনে ছুরি বেঁধা
গুলিতে ফুটো হয়ে ঝাঁঝরা পিটিয়ে চুরমার
যন্ত্রণাগুলো গোঙাতে থাকে আজো
সীমান্ত কালভার্টের নিচে বছরের পর বছর। (কালভার্ট / ধন্যবাদ অশেষ ধন্যবাদ)
আসলে স্মৃতি আর সময় যে প্রতারক, তা’ আমরা আগেই বলেছি। রণজিৎ গুহ তাঁর ‘স্মৃতি এমনিতেই মিথ্যেবাদী’ (আনন্দবাজার পত্রিকা / ১৫.০৮.২০০৭) সাক্ষাৎকারে সংগত কারণেই বলেন : ‘স্মৃতি তো একটা আর্কাইভ। সরকারি বেসরকারি সব নথিখানার মতোই স্মৃতির আর্কাইভও বিশেষ বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবণতা অনুযায়ী বাছাই করা দলিলে ভর্তি থাকে। তাই তার থেকে কোনও সত্যনিষ্ঠ নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না।’ যায় না ঠিকই, তবুও তো স্মৃতির উপরেই আমাদের নির্ভর করতে হয়। যদিও ব্যথার স্মৃতিকে আমরা ভুলতে চাই বারবার। দেশভাগের ভিতরে যেমন নিহিত থাকে ফেলে আসা গ্রাম-দেশ, তেমনই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তথা পুনর্বাসন। আর এই শিরোনামেই একটি কবিতায় শঙ্খ ঘোষ লেখেন :
ধ্বস
তীরবল্লম
ভিটেমাটি
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিমমুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙা বাক্স পড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাৎ সব বাস্তুহীন। ...
একেক দিন
হাজার দিন
জন্মদিন
সমস্ত একসঙ্গে ঘুরে আসে স্মৃতির হাতে
অল্প আলোয় বসে-থাকা পথভিখারি
যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে
জ্বালিয়ে নেয় প্রতিদিনের পুনর্বাসন। (পুনর্বাসন / তুমি তো তেমন গৌরী নও)
এই পুনর্বাসন নিছক নতুন বাসস্থান পাওয়া হয়ে থাকে না কেবল। শিকড়ছেঁড়া পুববাংলার মানুষেরা নতুন করে শিকড় তৈরি করতে শুরু করে যখন নতুন প্রজন্মের জন্ম দিতে থাকে। সেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালিদের স্মৃতিতে থাকে না কোনো দেশভাগের বেদনা বা বাংলাদেশের জন্য আলাদা একটা টান। তরুণ সান্যালের কবিতায় বাংলার ভাঁটফুলের জন্য কান্না শুনি। পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি থেকে উঠে আসে ‘বাংলা আলেখ্য’ আর ‘ছেলেবেলার বিশ্বলোক’। তবু ভদ্রাসন বেচতে আসার নির্মম বাস্তবটাই সত্য, কারণ আধুনিক মানুষ নাগরিক এবং প্রায়শই ফ্ল্যাট বা নিজস্ব ছোট্ট ঘরের বাসিন্দা :
প্রোমোটারের চোখ চক্চক্ করছে অদৃশ্য চাবির গোছায়
যেমনটি বেতফলের থোকা ঝুঁকে নামছিল বাবার আপন মাটিতে। (দশকাঠা ছয় ছটাক)
পূর্বপুরুষদের মুখে শোনা দেশভাগের গল্পই আজ আমাদের কাছে সম্বল। শুধুই ইতিহাস। হয়তো সে মূক নয়, তবু তার গোপন কথা কি শুনতে পাই আমরা? দেশভাগ না-দেখেও এই প্রজন্মের কাছে সেই অনুভূতির স্বাক্ষর তাই জয় গোস্বামী তুলে ধরেন ‘নন্দর মা’ কবিতায় :
আজ চারিদিকে ফ্ল্যাট বাড়ি, ফ্ল্যাট বাড়ি
আজ চারিদিকে বস্তি বস্তি লোক
লাইনের পাশে বাঁশ-দরমার ঘর
ঘর থেকে আসে কাজ করা মেয়েলোক।
ঠিকে ঝি ছিলাম, এখন রাতদিনের
খাওয়া পরা পাই এখানে, ফাইভ সি-তে
ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়েছে, আমি
এখানেই থাকি গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতে ...
এইখানে বসে, আমি নন্দর মা
ছেলেকে ভাবি না, ভাবি না স্বামীরও নাম
শুধু মনে পড়ে আমরা যাচ্ছিলাম
সেই কোন দেশে পালিয়ে যাচ্ছিলাম।
এসব চরিত্র কি নিছকই কাল্পনিক? কবিতার ভিতরে দেশভাগের এমন ছবি কিন্তু উঠে আসে অনেকটা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেও। সত্তরের আরেক কবি তরুণ মুখোপাধ্যায়ও সেই একইভাবে বইপড়া অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে লিখতে পারেন ‘অথ দেশভাগ কথা’। পাঁচ স্তবকের এ-কবিতায় ভয়, যন্ত্রণাকে জয় করে বিশ্বাসের ছবি আমাদের আশ্বস্ত করে :
সেদিন পিছনে তাড়া করেছিল ভয়
সেদিন পিছনে ছিল মৃত্যুও ত্রাস,
তবু কী বিশ্বাসে নির্ভীক তারা
বাঁধা তার ভেঙে চলেছিল অন্যদেশে।
আবার নতুন করে শুরু হলো বাঁচা
আবার নতুন করে হলো ঘর বাঁধা,
ভেঙে গেল দুটি দেশ, মানুষ ভাঙেনি –
বাঙালির কোনো ভাগ আমি তো মানি না।
আজকের ভুবনগ্রাম যদিও অদৃশ্য ইথার-তরঙ্গে জোড়া, তবু এমন এক ক্ষতচিহ্নিত ইতিহাসের জন্য এপার বাংলার আমরা কাতর হই :
মনে পড়ার দুঃখ আমার ছিন্নমূলের স্মৃতি
আবার ফিরে তুলতে থাকি অজস্র উদ্ধৃতি। (মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)
ভাঙা বাংলার চিহ্নময় কবিতার ভিতর দিয়ে এই বিষাদযাপন যেন মনে করায় আমাদের পশ্চিম আছে পুব নেই, এককালে ছিল। এইসব বাংলা কবিতা সেই না-থাকার বেদনাময় অন্ধকার স্মৃতিকে আজও বহন করে চলেছে।
অনুকথন
কিন্তু মুক্তির মন্দির সোপানতলে যত প্রাণের বলিদান হয়েছিল, সেসব স্মৃতি আজও কি অশ্রুকাতর করে আমাদের? সাহিত্যের পাতায় স্বাধীনতা ও দেশভাগের যুগলতা যেমন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যর জন্ম দিয়েছে, তেমনই ক্রমশ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে ‘পার্টিশন লিটারেচার’ নামক একটি পৃথক বিদ্যাচর্চা। গুটিকয় বৃদ্ধ মানুষ ছাড়া দেশভাগ এখন ইতিহাসের বিষয় এবং কিছুটা শৌখিন চর্চার জিনিস। দেশের খন্ডিত অংশের দুটি ভাগে বিভাজনও হয়েছে পরে। যদিও আমাদের যে বিচ্ছেদ ব্যাকুলতা, তা অপর প্রান্তে ততখনি নেই বলেই মনে হয়। আর তাই স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে লেখা জাদুবাস্তবতার আখ্যান সলমন রুশদির ‘মিডনাইটস্ চিলড্রেন’ আমাদের ঔপনিবেশিকতা থেকে স্বাধীন সত্তায় উত্তরণের পথ দেখায়, যেন বলে ‘We all owe death a life’। যদিও সেই লেখককেও সত্যি বলার অপরাধে মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হতে হয়! দেশের স্বাধীনতা থেকে চিন্তা ও যাপনের স্বাধীনতা কিংবা নারী স্বাধীনতার নিরিখে আমরা অনেকটা পথ এই পঁচাত্তর বছরে এগিয়ে গেলেও প্রদীপের তলায় অন্ধকার আজও কাটেনি। ধর্ম-শিক্ষা-সমাজ-রাজনীতি সর্বত্র সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা আলোর গান গাইতে গিয়ে বিষণ্ণ হই। তবু ভাবি, স্বাধীনতার সোনার হরিণ একদিন ধরা দেবে নাকি?
ব্যবহৃত গ্রন্থপঞ্জি :
১) দেশভাগের কবিতা / সংকলন ও সম্পাদনা : ড. শঙ্করপ্রসাদ চক্রবর্তী / একুশ শতক / বইমেলা ২০১০/ কলকাতা।
২) দেশভাগ : স্মৃতি আর স্তব্ধতা / সেমন্তী ঘোষ সম্পাদিত / গাঙচিল / পুনর্মুদ্রণ, মার্চ ২০১১ / কলকাতা।
৩) ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য / অশ্রুকুমার সিকদার / দে’জ পাবলিশিং / ২০০৫ /কলকাতা।
৪) কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা / পবিত্র সরকার ও সুধেন্দু মল্লিক সং / প.ব. বাংলা আকাদেমি / ২০১২ / কলকাতা।
৫) দ্বিখণ্ডিত বাংলা : দেশভাগের প্রভাব (১৯৪৭) / সম্পাদক : পল্লব দাস অরিজিৎ ভট্টাচার্য, এভেনেল প্রেস, নভেম্বর ২০১৯, মেমারি।
৬) এছাড়া একাধিক কবির কাব্য, নির্বাচিত কবিতা এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ই-আর্টিকেল কাজে লাগিয়েছি।
বি.দ্র. প্রারম্ভিক কবিতাটি এই প্রবন্ধলেখকের স্বরচিত।
খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনভালো লাগলো। কলম চলতে থাকুক।
উত্তরমুছুন