মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০২২
সম্পাদকের নিবেদন
সম্পাদকের নিবেদন
বিংশ শতাব্দীতে গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১) ছিলেন একজন বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনকালে তিনি ব্যাপ্ত কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে চরম সফলতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর সকল কর্মের প্রেরণা ছিল সুস্থ জাতীয়তাবোধ, স্বদেশপ্রেম। যাঁর ভাবনার মূলে রয়েছে মানুষের হিতসাধনার ব্রত। বিশ শতকের বাংলায় স্বদেশি যুগের আবহাওয়ায়, জাতিয়তাবোধের সঙ্গে বিশ্ব-ঐক্য-অনুভূতির মিলন, গুরুসদয়ের জীবন-দর্শনেরই পরিচয়। আন্তর্জাতিকতাবোধের এই রূপটি আমরা রবীন্দ্র-দর্শনে অতিঅবশ্যই পেয়েছি। গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের মধ্যে, যে লোকহিত-সাধনের সম্মিলিত ইতিবাচক প্রক্রিয়াটি রয়েছে, তা বুঝতে পেরেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। স্বদেশপ্রেম গুরুসদয়ের কাছে মাটির কাছাকাছি মানুষের কল্যাণ-সাধনের ব্রতকেই বোঝাতো। রবীন্দ্র-ভাবনার সঙ্গে তাঁর ভাবনার অনেক মিল দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের গ্রামভাবনা ও স্বদেশভাবনা গুরুসদয়কে প্রাণিত করেছিল বলেই মনে হয়।
গুরুসদয় দত্ত বাংলার লোকশিল্প এবং বাংলার লোকনৃত্য, এই দুই বিষয়ে আজীবন চর্চা করেছেন। তাঁর জীবিতকালে লোকসংস্কৃতি-বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয় দুটি, –––
১৯৩৩ সালে Indian Folk Dance and Folk Song Movement এবং ১৯৩৯ সালে পটুয়া সংগীত।
এছাড়া ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল তেরো বছরে লোকসংস্কৃতি, পল্লিসংগঠন ও ব্রতচারী বিষয়ে লেখেন অনেকগুলি গ্রন্থ।
১৯২৯-এ তিনি ময়মনসিংহের কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন গ্রামোন্নয়ন আন্দোলন শুরু করেন। বীরভূমে আসার পর, ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি শিক্ষা শিবির থেকে যার সূত্রপাত, ১৯৩২-এ প্রতিষ্ঠিত সেই ব্রতচারী আন্দোলন, গুরুসদয়ের সর্বাধিক পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
ব্রতচারী স্ত্রীপুরুষ-জাতি-ধর্ম-বয়স নির্বিশেষ সংগঠন, যার উদ্দেশ্য আত্মিক ও সামাজিক উন্নতি। জাতিয়তাবাদের পাশাপাশি বিশ্বনাগরিকত্বের অঙ্গীকার। শরীর ও মন গঠন, দেশীয় ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণ ও চর্চায় উৎসাহ দান, বিশেষত লোকসংগীত ও লোকনৃত্য।
গুরুসদয়-ভাবনাকে উজ্জীবিত করতে তাঁর গ্রন্থগুলির নিবিড় পাঠ জরুরি, এবং তাঁর জীবনদর্শনের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা।
সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছায় –––
রোশনি ইসলাম
সোনালি বেগম
স্মরণঃ কবি কৃষ্ণ ধর-কে শ্রদ্ধাঞ্জলি
কবি কৃষ্ণ ধর
‘কৃষ্ণ ধরের অঙ্গীকার পড়ে বোধ হল নতুন, উঠতি কবিতার সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে হয়তো। এ কাব্য মন দিয়ে পড়া দরকার।’ চতুরঙ্গ পত্রিকায় লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। স্বাধীনতার পরের বছরই প্রকাশ পেয়েছিল এই ‘অঙ্গীকার’ (১৯৪৮)। গত ১২ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছেন চল্লিশের সেই কবি কৃষ্ণ ধর, বয়স হয়েছিল চুরানব্বই বছর। শেষজীবনে থাকতেন কনিষ্ঠা কন্যা সুরঞ্জনার কাছেই। ১৯২৮ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলা সাহিত্য নিয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়েই লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। কবিতা তাঁর কাছে ‘জীবনের স্বপ্ন দেখার জানালা’। চল্লিশের সাম্যবাদী চেতনার অভিঘাত থেকে তাঁর কবিতাও মুক্ত নয়, তাঁর কবিতা একাধারে সমাজমনস্ক এবং অন্তর্লীন আবেগ ও মননশীলতায় স্পন্দিত। স্বপ্ন ও সংগ্রামকে মিলিয়ে দেন তাঁর কাব্যভাষায়। লিখেছেন একাধিক সার্থক কাব্যনাটক ও গদ্যগ্রন্থ। দেশবন্ধু গার্লস কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকেও পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। সম্পাদনা করেছেন যুগান্তর ও দৈনিক বসুমতী। সাংবাদিক হিসেবে আমেরিকা-ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে : এ জন্মের নায়ক, কালের রাখাল তুমি ভিয়েতনাম, যখন প্রথম ধরেছে কলি, হে সময় হে সন্ধিক্ষণ, হাঁটব থামব না, নির্বাচিত কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, কৃষ্ণ ধরের কবিতা ইত্যাদি। কাব্যনাট্য : বনজ্যোৎস্না ও সমবেত করতালি, বিরুদ্ধ বাতাস, পায়ের শব্দ শোনা যায়, কাব্যনাট্য সংগ্রহ। নজরুল স্মৃতি, শিশিরকুমার, সুধা বসু স্মৃতি, পোয়েট্রি ইন্ডিয়া, সারঙ্গ অর্ঘ্য ইত্যাদি পুরস্কারের পাশপাশি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আট দশক সাত কাহন’-এর জন্য পেয়েছেন মুজফ্ফর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে তরুণ মুখোপাধ্যায়ের সমালোচনাগ্রন্থ ‘কালের রাখাল কবি কৃষ্ণ ধর’ (২০১৯) এবং কলকাতার যীশু পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (একুশ শতক, ২০১৬) গ্রন্থের প্রথম ও শেষ কবিতাদুটি পুনর্মুদ্রিত হলো :
অন্তরঙ্গ মুখ
প্রদীপটা নিবিয়ো না
এখানে অন্ধকার
আমি তোমার মুখটুকু দেখব বলে
এই আড়ালে বসে আছি।
চারিদিকে অন্ধকার, নিবু নিবু প্রদীপ।
তাহলেও তোমার মুখটুকু দেখা যাবে
তুমি যখন সলতেটা উসকে দিতে আসবে।
বাইরে কার যেন কান্নার শব্দ শুনতে পাই
কারা কাঁদছে?
মানুষ, মৃত্তিকা না অরণ্য;
তুমি আর কীসের জন্য কাঁদবে?
সেই ছোট্ট ঘরটির জন্য
মানুষের জননী যেখানে বসে থাকেন!
একবারও কী মনে পড়ে না
এই নদী, আকাশের মেঘ,
আর গাছের কাঁপন লাগা
পাতার কথা?
তুমি কী ভুলো মন!
প্রদীপটা নিবিয়ো না
আমি আলোতে তোমার মুখ দেখবো বলে
কখন থেকে বসে আছি! [মূল কাব্য : এ জন্মের নায়ক (১৯৬২)]
ইচ্ছাপত্র
অগ্নিতে দিয়ো না শরীর, দিও না পুণ্যবারিস্রোতে
কিংবা গোরের মাটির বুকে
দেহটাকে দিয়ো যাতে মানুষের কাজে লাগে
এ আমার ইচ্ছাপত্র লিখে যাই দেওয়ালের গায়ে
প্রিয় বৃক্ষের পাতায়, শাখাপ্রশাখায়
অন্যথা করো না, মায়ায় ভুলো না, যেতে দাও নশ্বর শরীর
শোক নয়, এ দেহকে নতুন সজ্জায় ঢেকে
দিয়ে এসো শুশ্রূষার কাজে, সে তাই চেয়েছে
কান্না দিয়ে ভিজিয়ো না তাকে,
দুয়ার পেরোতে দাও, আকাশ দেখুক তাকে
পৃথিবীকে ভালোবেসে, পৃথিবীর নিরাময় চেয়ে
রেখে যাব নিজের শরীর
অগ্নিতে দিয়ো না তাকে, দিয়ো না নদীতে
মাটিতে শোবে না শরীর
যাবে মানুষেরই কাছে যার জন্য ছিল তার
আজীবন মনন শিল্পের চর্চা, মোহহীন
ছিল অন্বেষণ জীবন সত্যের। [মূল কাব্য : হাঁটব থামব না (২০০৪)]
তথ্যসংকলন ও কবিপরিচিতি : ঋতম্ মুখোপাধ্যায়
চিত্রঋণ : ‘কলকাতার যীশু’ পত্রিকা গোষ্ঠী