প্রীতি উপহার
পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক অনেকদিন আগেই চুকেবুকে গেছে গঙ্গাপদর। আর সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক তো কস্মিনকালেও ছিল না। নেহাত বাংলামাধ্যম স্কুলে পড়েছিল, তাই সিলেবাসে বাংলাসাহিত্য ছিল, আর তারই পরিণামে কয়েক পিস
মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল, মানকুমারী বসু ইত্যাদি গিলতে বাধ্য
হয়েছিল। ব্যস এইটুকুই। ভেবেছিল আদৌ কোনো সাহিত্যপাঠ না করেও দিব্যি জীবনটা চলে যাবে। এবং ভাবনাটায় খুব একটা ভুলও ছিল না। অক্ষরজ্ঞানের সুযোগ যাদের ঘটেনি, সারা জীবনে কোনো বই না পড়েও তো তাদের দিন কেটে যায়!
এইপর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু গন্ডগোলটা শুরু হলো গঙ্গাপদর বৌভাতের সন্ধ্যে থেকে। গঙ্গাপদর সদ্য পরিণীতা বৌ বড়লোক ঘরের মেয়ে। বৌয়ের মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে সোনার গয়নায় রীতিমতো সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছে। এছাড়া খাট-বিছানা, আলমারি-ফ্রিজ, ড্রেসিংটেবিল-ডাইনিংটেবিল, এমনকি একটা এসি গাড়িও বিয়েতে উপহার দিয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই গঙ্গাপদ সামান্য একটা বিয়ে করে বৌ সমেত এত সামগ্রী পেয়ে খুশিতে ডগমগ করছে। বাড়ির আত্মীয়স্বজনরাও চক্ষুলজ্জার খাতিরে অনেক দামি দামি উপহার দিয়েছে।
সন্ধ্যেবেলায় মঞ্চের ওপর দুটি রাজকীয় চেয়ারাসনে বসানো হয়েছে বর-বৌকে। খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে বিশাল ম্যারেজহল। চারিদিকে আলোর রোশনাই। হাওয়ায় রজনীগন্ধার সুবাস। নিতান্তই মৃদুস্বরে যন্ত্রসঙ্গীতে বেজে চলেছে হিন্দি সিনেমার গানের সুর। আমন্ত্রিতরা একে একে এবং দলবঁধে আসতে শুরু করেছে। মঞ্চে উঠে বরের সঙ্গে করমর্দন করে বৌয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। সবার হাতেই সুদৃশ্য রঙিন কাগজের প্যাকেটে মোড়া প্রীতি উপহার। কেউ কেউ অবশ্য খামে বন্দী নগদ টাকাও উপহার দিচ্ছে।
এরপরেই আসতে শুরু করল অফিসের কোলিগরা। মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে এসে উপস্থিত হলেও তারা মঞ্চে উঠল না, বরং অপেক্ষায় থাকল সবাই না আসা
পর্যন্ত। গঙ্গাপদ আশা করেছিল, অফিসের কোলিগরা সবাই মিলে একটা দারুণ দামি কিছু উপহার দেবে। কোলিগদের সংখ্যাও কম নয়! মেরে কেটেও প্রায় ষাট। ইতিমধ্যে গঙ্গাপদ মঞ্চ থেকে নেমে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করে গেছে। কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলেও দেখতে পেল না কোনো বড়সড় ভারি কোনো প্যাকেট। সময়টা শীতকাল। তাই প্রায় সবাই কোট-প্যান্ট পরে এসেছে। গঙ্গাপদ তাই ভাবতে বাধ্য হলো, এরা তাহলে সবাই তাকে ক্যাশটাকাই উপহার দেবে। এবং সেটা তেমন মন্দও নয়। ষাটজন যদি প্রত্যেকে অন্তত হাজার টাকাও দেয়, মোট পরিমাণটা রীতিমতো লোভনীয়। গঙ্গাপদ অত্যন্ত অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন তার কোলিগরা একে একে মঞ্চে উঠে আসবে এবং নববধূর হাতে তুলে দেবে হাজার টাকার খামের প্যাকেট।
তারপর একসময় সত্যি সত্যিই গঙ্গাপদর অফিসের কোলিগরা মঞ্চে উঠতে শুরু করল
বর-বৌকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানোর জন্য। সবার হাতে প্রীতি উপহারের প্যাকেট। কিন্তু একি কান্ড! এ তো টাকার খাম নয়, বরং বইয়ের প্যাকেট। গঙ্গাপদ হকচকিয়ে গেল, আজকের দিনে বিয়েতে কেউ বই উপহার দেয় নাকি? এসব উপহার তো বিগত
শতাব্দীর প্রথমার্ধে দেওয়া হতো! এখন এসব অচল। গঙ্গাপদ ভেবে কোনো কূল কিনারা পেল না, এই উপহারের বোঝা কোন ডাস্টবিনে ফেলবে!
অসাধারণ
উত্তরমুছুন