শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২

অর্ক চট্টোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প

নৃত্য-মৃত্যু...মৃত্যু-নৃত্য

মেঘ করে এলো। শুধু কি সকালে, নাকি শরীরেও? শরীরে যা জমেছে তা কি মেদ না মেঘ? হয়ত মেদমাত্রেই মেঘ। অভিজ্ঞতা, অবজ্ঞা, অন্যায়, অত্যাচার, অপমানসূচক শব্দ-- সবই শরীরে লেখা থাকে মেঘ হয়ে। যে কোন সময় বৃষ্টি হয়ে নেমে আসবে, ডুবিয়ে দেবে সবকিছু! কিন্তু বৃষ্টিও তো রোদের পর নাচ হয়ে ফোটে শরীরে! এই শরীর যা এতগুলো বছর ধরে ক্রমে ক্রমে নাচ হয়ে উঠছে, উঠেছে, কি করে থামিয়ে দিই তাকে? নাচ মানে তো গতি, শরীরে গতি সঞ্চার করা আর নিজেকে মেরে ফেলা মানে শরীরে সকল গতির অবসান! একে অপরের বিপরীত। এই কাজ তাই সহজ নয়! অথচ উপায় কি? ডান্সার কমিটস সুইসাইড! ওয়াও। স্যাড ইমোজি নাকি কেয়ার? হু কেয়ারস? নোবডি! তাই কেয়ার কেবল ইমোটিকন হয়ে রয়ে গেছে। কি করে থামাই শরীরের নাচ? কোন সুইচ টিপলে থামবে মাথার ভেতর চিন্তার নাচ? শরীরের মুদ্রার উপর মৃত্যুর ধুলো পড়বে!

 

            উদ্বেল হাওয়ার ভিতর শরীর দিয়ে সারাজীবন কত-কিই না লেখার চেষ্টা! যেন কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছে, কিছু পাচ্ছে না কিন্তু তাও ধরবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে! আঙুলের জোড়-বিজোড়ে, মুখমণ্ডলে, চোখের ওঠানামায়, কটিদেশের কম্পনে, পায়ের ভাঁজে, বিভঙ্গের বিহঙ্গে, গোটা জীবনটা নাচ হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। কিন্তু কি রইল? কিছু কি আদৌ রইল বড় হাওয়ার গায়ে শরীরের ছোট্ট নাচ-আঁচড় হয়ে? সবই তো নিয়ে গেল হাওয়া, মুছে দিল! নাহ, মোছেনি! নিয়ে গেছে কিন্তু মুছে দিতে পারেনি। হাওয়া ততটাও বড় নয়! মৃত্যুতে কিছু মুছে যায়না, কেবল শেষ হয়, এই যা!

 

            আমি প্রশ্ন করেছিলাম। নৃত্যগুরু, তা সে বায়োলজিকালি পুরুষ হোক বা মহিলা, তাকে পুরুষ-শরীর হিসাবে কেন ভাবতে হবে? আর শিষ্যমাত্রেই কেন নারী-শরীর হবে? আমাদের নৃত্য-প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এমন কেন? এসব প্রশ্নে বিগ বসেরা স্বাভাবিকভাবেই খুশি হননি! ফিউশন ডান্স? সেটা আবার কি? নাট্যশাস্ত্রের অবমাননা? মানছি না, মানবো না!

“The gender dichotomy, without regard to the sexes involved, is clear: the disciple is female, the guru male; the body feminine-receptive, the system masculine-penetrative.”

পাঠক মহোদয়, ভাববেন না আমি এইসব বিগ বসের জন্য আত্মহত্যা করছি! নো ওয়ে! আমি আসলে আমার নৃত্যশরীর নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছি। নৃত্যমৃত্যু নয়, হল মৃত্যুনৃত্য! শরীর থামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমার। অন্যরা স্পেকিউলেট করতেই পারে, কেন আত্মহত্যা করল, কেন করল, কেন করল? কিন্তু অস্তিত্বের সিদ্ধান্ত আমার! আত্মহত্যা মানে শরীরের মেঘ-জল-বৃষ্টিকে নির্জলা উপবাসের পথে নিয়ে যাওয়া। স্থবিরতা! নাচ মানে কি কেবল মুভমেন্ট নাকি? সেখানেও স্থবিরতা থাকে। মুভমেন্টের মাঝে মাঝে নিথর হয়ে পড়াও তো নাচ, নাকি? মৃত্যু সেই নিথরতাকেই প্রামাণ্য করে তোলে।

ছাদের কার্নিশে দাঁড়ানো শরীর নৃত্যপ্রস্তুত! এবার শুরু হবে নাচ। তিরিশতলা বাড়ি থেকে পড়তে অনেকটা সময় লাগবে! ততক্ষণে হাওয়া শরীর ছেঁচে নাচ তৈরি করবে। হাত-পা-মাথা-পিঠ-বুক-কোমর-পা হাওয়ায় সব নিজেদের বদলে নেবে। তবে শরীর এবার আর কিছু আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করবে না। শরীর জানবে এই হাওয়ায় ধরে থাকবার কিছু নেই। নির্মূল এই হাওয়া মেঘ গলে তৈরি হয়েছে শরীরের চারপাশে, একটোপ্লাজম মিস্টের মত। তবে আমি জানি নীচের ফুটপাথে যখন দমাস করে পড়বে আমার শরীর, একবার অল্প কেঁপে উঠে নিথর হয়ে যাবে চিরতরে, তখন শরীর আবার নাচ হয়ে উঠবে। এত বছর নাচতে নাচতে যে নাচ থেকে দূরে সরে এসেছি, অবশেষে সেই মৃত্যুনৃত্য ফিরে আসবে আমার শরীরে। পড়ে থাকা শরীরের অবস্থান মার্ক করে যে চকের দাগ কাটবে পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তসূচক সে জ্যামিতিতে আমার নাচ স্থানিক হয়ে থাকবে। শরীরের শেষ নাচ সেখানে, যেখানে শরীর কেবল চক কাটা স্পেস হয়ে যায়

 

1 টি মন্তব্য: