বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সুবীর সরকার-এর ধারাবাহিক গদ্য : "ভবতারণের জোত"

 

ভবতারণের জোত


২৩ 

ফুলবাড়ির সেই হাতিজোতদার যখন কোচবিহারের মহারাজার দরবার থেকে ফিরে আসতেন

তার মস্ত হাতি ইন্দ্রকুমারের পিঠে চড়েই তখন জলঢাকার শীতের বিশাল চরে বসে যেত তিন

দিনিয়া মেলাবাড়িহাতিজোতদার,লোকশ্রুতিতে হাতি দেউনিয়া মস্ত কাঠের খড়ম আর হস্তে

গামারীর নকশাদার লাঠি নিয়ে সেই মেলাবাড়ির ভেতর উচ্চারণহীন এক জাঁক  জৌলুশ নিয়েই

ঢুকে পড়তেন।তখন একশো ঢাক একসাথেই বেজে উঠতো।মেয়েরা শরীরে নাচ নিয়ে কন্ঠে গান

নিয়ে পরিসর ভরিয়ে ফেলতো সেই মেলাবাড়ির।হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে ছড়িয়ে পড়তো

সুর_

গাও হেলানি দিয়া নাচরে গোলাপি

এই কালখন্ডের ভেতর আমরা দেখি হাতিজোতদার তার নিঃসঙ্গতা তার অন্যমনস্কতা নিয়ে

কেমন দুরাগত হয়ে উঠছেন।সেই মস্ত এক শিকারবাড়ির গল্প বুঝি ছড়িয়ে দিতেই চাইছেন এই

দিকও দিগরের দিকে।ইকবাল পাগলের যাত্রার দলের পাশে তখন চুপচাপ এসে দাঁড়াতে থাকে

ঝাম্পুরা কুশানীর কুষান পালার দলবল।সেই লুপ্ত সময়ের দেশে সেই পাখি  ফড়িঙের দেশে

সেই ডে লাইট  নির্জনতার দেশে একসময় তো হাতি দেউনিয়া আর দোল ধনি একাকার হয়েই

যেতে থাকেন এক আদি কিংবা অনন্ত হাহাকার হয়েই হয়তো!সমস্ত শূণ্যতা ঘিরে ফেলে সা্রাজীবন

মানুষকে।আর মানুষ তার যাবতীয় বেঁচেবর্তে থাকবার চিরকালীনতায় বারবার গান টেনে আনে,

নাচ টেনে আনে,ডাহুক  শালিক টেনে আনে।আর দিনদুনিয়ায় রচিত হয় অনন্তের সব পদাবলী_

কুচবিহারত হামার বাড়ি

ঘাটাত দেখং ভইসা গাড়ি


২৪

পুরোন সময়ের শ্যাওলা হাতাতে হাতাতে অনেক সময় উজিয়ে দোলগোবিন্দ ধনীর বাড়ির

খোলানে দাঁড়িয়ে তার উত্তর প্রজন্মের এক যুবক হিমাদ্রিশেখর হয়তো একধরণের স্মৃতিপরব

উদযাপন করতে থাকে এক চিরবিষ্ময়ের ঘোর জাগিয়েই।আর তখন,সেই মরা বিকেলের আলোর

নিচ দিয়ে উড়ে যেতে থাকে অজস্র লাল টিয়া,হয়তো ঘোকসাডাঙ্গার হাটের দিকেই।

এই যে এত এত দেখা,এত এত জীবনের দৃশ্য;আসলে সব কিছুই তো মিথচালিত।মিথজড়িত।

অগনণ মিথের ভেতর দিয়ে চিরদিনের এক জীবন যাপন করে চলে মানুষ।মিথতাড়িত সেই

জীবনে বারবার ঝুঁকেই পড়ে মিথের আলো।মিথের ইতিহাস থেকে,আবার মিথের ইতিহাস বহন

করতে করতে কিরকম বুঝি আবহমান হয়ে উঠতে থাকে মিথ।ম্যাজিকের মতন।কালখন্ডবাহিত

হয়ে এভাবেই মিথের নব নব জন্মই হয়।



২৫।

অনিমেষ গান গাইছে।গান গাইতে গাইতে অনিমেষ ফিরে যাচ্ছে জীবনের উজানে।উৎসে।অনিমেষ

ভবতারণের জোতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মস্ত এক মিথের কপালে হাত রাখে।অনিমেষ কেঁদে ফেলে

আর কান্নার ভেতর জুড়ে বসে লাল টিয়া।

আসলে আলো অন্ধকারের এক জীবনে কেবল গ্লানি বহন করেই বাঁচতে হয়।

এটাই নিয়তি।আর অনিমেষ এই চিরদিনের সত্যিটা খুব ভালো করেই জানে। বোঝে।

আর আমরা দেখি,ভবতারণের জোতে হেমন্তের মায়া আর আলো মাখতে মাখতে নুতন এক

জীবনের দিকেই নুতন এক পদযাত্রা শুরু হয়ে যায় অনিমেষের।

 




সমাপ্ত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন