বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

এসেছো কবিতা

আমাদের বাড়ির পিছনের ছোট পুকুরে মাছরাঙা বসে থাকত দুপুরবেলা। পাড়ার অনেক মহিলা দুপুরে চান করতে আসতেনকাপড় কাচতেন। কোনোদিন দেখতাম বুড়োমানুষ কেউ ছিপ ফেলে বসে আছেন। ফানার দিকে তাঁদের একাগ্র দৃষ্টি দেখে অবাক লাগত। পুকুরপারে কচুর জঙ্গল। কলমিশাক হয়ে থাকত জলের ভিতর পর্যন্ত। হেলে সাপঢোঁড়া সাপআর কিছু হাঁস ওই পুকুরের নিত্য বাসিন্দা। মনে আছে মা পুববাংলার মেয়েসাপ দেখে ভয় পেতেন না। হেলে সাপেরা মাঝে মাঝে বাড়ির ভিতরে চলে আসত, আমরা দুই ভাইবোন তাদের দুধ দিতাম খেতে। দুপুরবেলা আমি বসে থাকতাম কখন কোন পাখিটা মাছ ধরে তাই দেখার জন্য। সে ভারি মজা। চুপচাপ গাছের ডালে বসে আছে, যেন কিচ্ছুটি জানেনা, কোনও ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই, যেন জগব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন, আর যেই জলে একটু বুড়বুড়ি উঠল কি উঠল না, ওমনি চক্ষের নিমেষে সে কি দুর্দান্ত উড়ান! আমার বুকটাও যেন লাফিয়ে উঠত পাখিটার সঙ্গে। এখন ভাবি, বকের দুর্নাম আছে, বেড়ালের ভুয়ো তপস্বী বলে নাম আছে, মাছরাঙাই বা কম যায় কিসে। পাখির প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছাড়া একে আর কীই বা বলা যায়!

 

পাশের বাড়িতে একটা পাগল ছেলে ছিল। আমার চেয়ে অবশ্য বয়সে অনেক বড়। সে বাড়ির বাইরে একটা আলাদা ঘরে একা একা থাকত। কিছু অন্যরকম কখনো দেখিনি, কিন্তু সবাই বলত, পাগল। তাকে নিয়ে বেশ একটা ভয় ভয় ভাব আর তার সঙ্গে একটা কৌতূহল ছিল আমার মনে। মাঝে মাঝে ছেলেটা ওদের বাগানে ঘুরে বেড়াত। আমাকে ডেকে হঠা কখনও কথা বলত। একটু ভয় ভয় করত না তা নয়, কিন্তু ওকে একটুও অন্যরকম মনে হয়নি কখনও। আমি ভাবতাম, ওকে সবাই পাগল বলে কেন, পাগল তবে কি আমাদেরই মতো হয়? সে আমাকে একদিন একটা বিশাল বড় পেয়ারা দিয়েছিল ওদের গাছ থেকে পেড়ে। মনে আছে আমি ছোট্ট মেয়ে অতবড় পেয়ারাটা গোটা খেতেও পারিনি। পরে আমি যে পাগলবলে কবিতাটা লিখেছি, আমি ঠিক জানি সেটা সেই তারই কথা মনে রেখে।  

 

আমার দুপুরটা ছিল আমাদের পিছনবাগানের পুকুরপারের জন্য, কিন্তু সকাল বিকেল সময় কাটত সামনের সেই বিশাল ঘেরা বাগানে আম, জাম, নারকেল গাছের ছায়ায় আর ওই বাগানে অনেক বড় পুকুরটার পারে ঘুরে। পড়াশুনা বলতে তো তখন নেহা সামান্য। ছড়ার দোলা দুলিয়ে দিত, ছড়া বলাতেন মা, সেটুকুই বলতে গেলে পড়াশুনা অখন্ড অবকাশ। পুতুল, খেলনা, এসব আমরা পাইনি কোনওদিন। সদ্য ভিটেমাটিহারা বাবা-মা ওসব দেবার কথা ভাবতেও পারতেন না। পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে গুলি ডাংগুলি খেলা ছিল কিছু। এছাড়া জল-মাটি-গাছের সঙ্গেই তাই আমার খেলা জমে উঠেছিল।

 

এখন বুঝি কি ডানপিটে মেয়ে ছিলাম। ভয় কাকে বলে জানতাম না কোনওদিন। সে নিয়ে অনেক বকাঝকা খেতে হয়েছে। তবে নেহা মেয়েতাই মারধোর খেতে হয়নি কোনওদিন। যেভাবেই হোক মায়ের বিশ্বাস ছিল যে মেয়েদের মারতে নেই। ভাইয়ের অবশ্য নিষ্কৃতি ছিল না। আমি তো ঝড় হলেই বেরিয়ে যেতাম। সামনের বাগানে গাছের ডালপাতার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিত ঝড়। মাথামোটা নারকেল গাছগুলো ঘাড়শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে বলতআর না আর নাআর দুষ্টুমি করব নাআমার মজা লাগত। দারুণ মজা হত যদি একটা দুটো নারকেল পড়ত গাছ থেকে। আমার চোখে তো পড়বেই। সেদিন বাড়িতে সব। কারো মনেই হত না ওটা আমার ঘাড়ে মাথায় পড়লে কি হত। মা দারুণ পিঠে ভাজতেন। গোকুল পিঠেপাটিসাপটাদুধপুলিআরো কত রকম। নারকেল পেলে কিছু না কিছু একটা হতই। একদিন আবার আরো একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছিল। এখন মনে হয় যে সেদিন পা ফস্কে গেলে কি হত। তখন ওসব মনেই হয়নি। হয়েছে কিবাড়ির সামনের বড় বাগানটাতে যে পুকুর ছিল তার উপরে একটা নারকেল গাছ ভেঙে পড়ে্ছিল। পুকুরের ধারে জলের উপর অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছিল তার মাথা। পুকুরপারে ঘুরতে ঘুরতে আমি হঠা দেখতে পেলাম যে পুকুরের একটু ভিতরের দিকে যেখানে জলের তলায় মাটি দেখা যাচ্ছে সেখানে কাদায় একটা মোটামুটি সাইজের মাছ পড়ে আছেকানটা তার মাটিতে গাঁথা। আর পায় কে। টলমলটলমলবছর পাঁচেকের দস্যি মেয়েটাকে আজ যেন পষ্ট দেখতে পাই নারকেল গাছের গুঁড়ির উপর দিয়ে জলের উপর গিয়ে অনেক কষ্টে ব্যালান্স রেখে মাছটাকে খাবলে ধরে তুলে নিতে। তারপর একদৌড়ে বাড়ি। আজও মনে আছে বাড়িতে নিজের ধরা সেই মাছ খাওয়ার মজা। আজকের বেহালা যে দেখেছে তার কাছে এসব আজগুবি গল্পের মতো শোনাবে জানিকিন্তু  তো সত্তর বছর আগের কলকাতা।

তখন তো স্কুলে ঢোকানোর এত তড়িঘড়ি ছিলনা, পড়াশুনা সেই বেহালার বাড়িতে ঠিকমতো শুরুই হয়নি। বাড়িতে হয়তো শ্লেট পেন্সিলে লেখাপড়া করেছিলাম কিছু কিন্তু সেসব কিছু মনে নেই। মনে যা আছে সে হল এইসব একলা দস্যিপনার সঙ্গে বাইরে হুটোপাটি করে ডাংগুলি আর গুলি খেলা। আমি আর আমার ভাই এসবে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলাম, তবে ভাই এসবে দারুণ পটু ছিল আর আমি প্রায় কিছুই তেমন ভালো পারতাম না। যাদের সঙ্গে সে খেলা চলত তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা আজকের দিনে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ভাবতেই পারবেন না। কিন্তু আমার মা বাবা চিরদিন তাদের সঙ্গে মিশতে দিয়ে কেবল মনে করিয়ে দিতেন যে আমরা শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত  পরিবারের সন্তান, তাই ওদের সঙ্গে মিলে মিশে খেলতে পারি কিন্তু ওদের মতো হলে চলবে না। আমাদের যে লেখাপড়া করে অনেক বড় হতে হবে সে বোধ সেই সময় থেকেই আমাদের মধ্যে জাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

 

এই সময়ে আমার নিজের কীর্তিকাহিনি আজ যেটুকু মনে পড়ে তা হল এইসব হট্টেমি-টট্টেমির সঙ্গে বইকে বই ছড়া মুখস্ত করা আর দুইঘরের ভাড়া বাড়ির টানা বারান্দা ভরে চক দিয়ে ফুল লতা পাতা এঁকে রাখা। এভাবে বাড়ি নোংরা করাতে হয়ত অনেক বাড়িতে বাচ্চাদের বকা খেতে হয়, কিন্তু আমার মা-বাবা এসব লক্ষ্যই করতেন না। ওভাবে অত ছবি আঁকতাম কেন ভেবে এখন খুব অবাক লাগে, কারণ একটু বড় হয়ে আমি তো আর কোনওদিন ছবি আঁকতেই পারিনি। কিন্তু ছড়ায় গভীর আনন্দ ছিল। সে তো ছন্দের দোলা। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে আরও এক আনন্দ। সেই নেহা শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা মুখস্ত করেছিলাম। তার মধ্যে সব যে শিশুপাঠ্য তা নয়। ব্যাপারে আমার মা বোধহয় একটু অদ্ভুত ছিলেন। বুঝি না বুঝি কঠিন কঠিন কবিতা মুখস্ত করিয়ে দিয়েছিলেন। না বোঝা নিয়ে আমার অবশ্য কোনও সমস্যাই ছিল না। কিছু বুঝিনি ঠিকই, কিন্তু ধ্বনির যাদু সেই শিশুকালেই আমার মনকে ছুঁয়ে গেছিল, ভেতরে কেমন না বোঝা এক মাতন ধরিয়ে দিত। গা শিউরে উঠত যেন। সেইসব গা ছমছম করা লাইনগুলো যে কি ছিল বিশেষ মনে পড়েনা, তবে শুধু মনে পড়ে তাদের মধ্যে এই দুটি লাইন ছিল,

     অম্বরপ্রাঙ্গণমাঝে অস্ফুট মঞ্জীর গুঞ্জে

 অশ্রুত সেই তালে বাজে করতালি পল্লবপুঞ্জে।

আর ভালো লাগত, চমক লাগত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের যাদুতে ​:

ছিপখান

        তিনদাঁড়

                  তিনজন মাল্লা,

অথবা

ঝড়    রুষিয়ে

      ধায়    ঢুঁসিয়ে

           ফোঁস   ফুঁসিয়ে

                খুব    হুঁসিয়ার

 

বড়দের কবিতা শেখা নিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে। তখন অবশ্য মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। বছর আষ্টেক বয়সে আমাকে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে আবৃত্তির অডিশন দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। মা নিয়ে গেছিলেন। সেখানে আমি রবীন্দ্রনাথেরব্রাহ্মণকবিতাটা তৈরি করে গেছি। মা নিজেই কবিতা বেছে দিয়েছেন। কিন্তু শুরু করবার সঙ্গে সঙ্গেই যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি বললেন, এটা তো তোমার বয়সের উপযুক্ত নয়, তুমি অন্য একটা বলো। আমি তো ততদিনে সঞ্চয়িতার প্রায় সব কবিতা মু্খস্থ করে ফেলেছি, হঠাৎ করে আর কিছু মনে পড়েনি, ক্ষণিকারনববর্ষা’ ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকেকবিতাটি বললাম। বলাই বাহুল্য,  মনোনীত হইনি। এখন মনে হয়, সুকুমার রায় তো কন্ঠস্থ ছিল, সত্যেন্দ্রনাথ, কুমুদরঞ্জন অনেকাংশেই, কিন্তু আমার বয়সের উপযুক্ত কোন কবিতা হতে পারে সে কথা আমাকে কেউ বলে না দিলে আটবছর বয়সে আমি বুঝব কি করে?

আমার বয়স তখন পাঁচ পূর্ণ হয়েছে। আমরা বেহালার এই মায়াভরা পরিবেশ থেকে চলে এলাম ঠিক শহরের মধ্যিখানেআলিপুরেযেখানে একটা সামান্য বাসা ভাড়া নিয়ে বাবা একটুকরো জমি কিনে একটু একটু করে একটা বাড়ি করা শুরু করলেন। পড়াশুনা পুরোদমে শুরু হল। আলিপুরের ছোট্ট ভাড়া বাসায় হারিয়ে গেল আমার জগ হারিয়ে গেল সেই বাগানসেই পুকুর আর সারাদুপুর মাছরাঙার মাছধরা দেখা। ফুরিয়ে গেল একা একা দস্যিপনা করে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো। এখানে ঘেঁষাঘেঁষি অনেকঘর ভাড়াটেসরু গলিকটা বাড়ির সামনে ছোট্ট একচিলতে জমিতে আমা্র আর ভাইয়ের টেনিকোয়েট খেলা। বছরে একবার করে আমরা সেজমাসির বাড়ি বেড়াতে যেতাম। মেসোমশাই দারোগা ছিলেনকর্মোপলক্ষ্যে মেদিনীপুরের নানা শহরে থাকতেন। আমরা তাই ঝাড়গ্রামতমলুককাঁথিএইসব শহরে গিয়ে গিয়ে থাকতাম। বেহালা ছাড়ার পর এই মেদিনীপুরেই যেটুকু প্রকৃতির সঙ্গ পেয়েছি। ঝাড়গ্রামের শালবন দেখে কি দারুণ আনন্দ পেয়েছিলাম আজও মনে পড়ে।







ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন