টাকার বালিশ
নচিকেতাবাবু তাঁর মৃত্যুদিনের ছবিটা মৃত্যুর অনেক আগেই মনে মনে এঁকে রেখেছিলেন। তিনি নিশ্চল হয়ে টানটান শুয়ে আছেন তাঁর বিবাহসূত্রে প্রাপ্ত সেগুনকাঠের খাটে। মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর দু’ছেলে, দু’বৌমা, একমাত্র মেয়ে-জামাই, গোটা চারেক নাতি-নাতনি, সদ্যবিধবা স্ত্রী। তাঁর দু’ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তিনি হেসেছিলেন, মৃত্যুর পরে সেই হাসিটাই লেগে আছে আঠার মতো। আসলে তিনি এভাবেই মরতে চেয়েছিলেন। তাঁর মাথার নিচে যে বালিশটা আছে, মানে তিনি প্রতিদিন রাতে যে বালিশে মাথা রেখে ঘুমোন, সেই বালিশটা ফুলে ফেঁপে আছে, না তুলোয় নয়, বরং বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন মাপের বিভিন্ন মূল্যের কাগজের টাকায়। হ্যাঁ, তিনি টাকার বালিশে মাথা রেখে ঘুমোতেন। তবে ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়। তাঁর দু’ছেলে, ছেলেদের বউ, মেয়ে-জামাই কেউ জানে না। এমনকি তাঁর স্ত্রীকেও ঘুণাক্ষরে জানতে দেননি। এজন্য তাঁকে বিস্তর ঝক্কিও পোয়াতে হয়েছিল। তিনি বিয়ে করেছিলেন চব্বিশ বছর বয়সে। স্ত্রীর বয়স তখন মাত্র উনিশ। সেই চব্বিশ বছর বয়স থেকে শুরু করে বাষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে সেগুনকাঠের খাটেই শুয়েছেন। সহবাস করেছেন। তিন তিনবার স্ত্রীকে গর্ভবতী করেছেন। কিন্তু না, আর নয়। এতদিন একটু একটু করে ব্যাঙ্ক থেকে মাস মাইনের টাকা অল্প অল্প সরিয়ে টাকার বালিশ তৈরির যে প্রজেক্টে মনোনিবেশ করেছিলেন, এবার তা রূপায়ণের পর্ব। ইতিমধ্যেই বালিশের খোল কিনে আলমারির মধ্যে জামা-প্যান্টের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই বালিশের খোলে ব্যাঙ্ক থেকে ক্যাশটাকা তুলে এনে ভরতে হবে। কিন্তু কাজটা করতে হবে খুব গোপনে, নির্জনে। দিনের আলোয় একেবারেই তা সম্ভব নয়। সুতরাং গভীর রাত্রিই উপযুক্ত সময়। আবার তাতেও অন্য বাগড়া আছে। তাঁর স্ত্রীর ঘুম খুব পাতলা। ঘুমের ঘোরে তিনি নাক ডাকলেও স্ত্রীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। অগত্যা নচিকেতাবাবু ঠিক করলেন, স্ত্রীকে শোবার ঘর থেকে তাড়াতে হবে। কীভাবে তাড়াবেন? স্ত্রীকে বোঝালেন, দেখ, আমাদের মধ্যে তো এখন শারীরিক সম্পর্ক প্রায় নেই। কখনও অবরে সবরে যদি প্রয়োজন হয়, তখন ভেবে দেখা যাবে। তাছাড়া তোমারও তো যথেষ্ট বয়স হলো। রাতে একটানা ঘুম খুব জরুরি। আমি তোমার সঙ্গে একই ঘরে একই খাটে শুলে তা আদৌ সম্ভব নয়। তাই আমার পরামর্শ, তুমি এরপর থেকে অন্য ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা কর। তাহলে আমরা দুজনেই নির্বিঘ্নে রাতে ঘুমোতে পারব। স্ত্রী আপত্তি তুলেছিলেন, কই, এতবছর তো অসুবিধে হয়নি, তাহলে এখন কেন হবে?
শুধু শোবারঘর নয়, ঘরের আলমারি থেকে নিজের সবকিছু সরিয়ে নিতে হয়েছিল স্ত্রীকে। নচিকেতাবাবুর জামাকাপড় এবং টাকার বালিশ থাকত আলমারিতে। রাতে সেই বালিশে মাথা রেখে ঘুমোতেন। এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যেদিন গভীর রাতে প্রয়াত হবেন, সেদিন তাঁর মাথার নিচে থাকবে টাকার বালিশ। এটাই তাঁর একমাত্র স্বপ্ন।
পঁয়ষট্টি বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছিলেন নচিকেতাবাবু। তবে গভীর রাতে নয়, বরং দিনের প্রকাশ্য আলোয়। এবং ঘরে নয়, ব্যস্ত রাস্তায়। উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো বাসটা এমন হামলে পড়ল গায়ের ওপর…
খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনতাই তো ! সুন্দর । ঝুরঝুরে।
উত্তরমুছুন