অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
ভূমিকা
কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক অনুবাদক এবং অধ্যাপক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রথম পর্বে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি নতুন বিভাগ চালু হয়-‘তুলনামূলক সাহিত্য’, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে। তাঁর অনুরোধে অলোকরঞ্জন পাশাপাশি সেই বিভাগেও যোগদান করেন। সেখান থেকে হুমবোল্ট ফাউন্ডেশন স্কীমের গবেষণা করার উদ্দেশ্যে জার্মানিতে যান। গবেষণা শেষে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভারততত্ব’ বিভাগে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। তারপর আর তিনি দেশে ফিরে আসেননি। সেখানেই স্থায়ীভাবে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হয়ে যান। পরবর্তী কালে ‘ভারততত্ব’ বিষয়টি উন্নীত হয়ে ‘নব্য ভারততত্ত্ব’ রূপে আখ্যায়িত হয়। এই ‘নব্য ভারততত্ত্ব’ নিয়ে কলকাতাস্থ জার্মানি-ভাষাশিক্ষার অধিষ্ঠান ‘ম্যাক্স ম্যুলার’ ভবন (এখন গ্যেটে ভবন নামাংকিত) এই বিষয়টির উপর অধ্যাপক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র একটি ভাষণের আয়োজন করেছিল গত ১৭ই মার্চ, ২০০৮ সালে। ভাষণটি ইংরেজিতে পরিবেষিত হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে আমার আমন্ত্রণ থাকলেও কলকাতার জ্যামে আটকে যাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এজন্য অবশ্য অলোকদার (আমি এই বলেই সম্বোধন করতাম) কাছে মৃদু তিরস্কার শুনতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, পরের দিন তাঁর যাদবপুরের ফ্ল্যাটে তিনি হঠাৎ কয়েক পাতার একটি প্রিন্ট-আউট আমার হাতে দিয়ে সেটা পড়তে বলেন। আমি হাতে নিয়ে দেখতে পাই অলোকদার নামে একটি ইংরেজি ভাষণ। উপরেলেখা Neo Indology – a speech by Alokeranjan Dasgupta আমি কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়তে শুরু করলাম। দীর্ঘ চার পাতা ধরে একটি ভাষণ। পড়লাম এবং যার অধিকাংশ মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। পড়া শেষ হতেই অলোকদা বলে উঠলেন – এই ভাষণটি তোমাকে বাংলায় অনুবাদ করে দিতে হবে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। ‘এর আদ্দেকও তো আমার মাথায় ঢুকল না’। কিন্তু অলোকদা নাছোড়। এটা তোমার কাছে ‘বাঁয়া হাতের খেলা’ – চুটকি মেরে করে ফেলবে।’ এমন বিশ্বাস তাঁর কেমন করে জন্মাল জানিনা। কিন্তু এখানে তর্ক বৃথা- সেটা আমি বিলক্ষণ জানতাম। তাই কথা না বাড়িয়ে ভিতরে ভিতরে ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরে এলাম। এটা তখন আমার কাছে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছি এবং সেই বই প্রকাশিত হয়েছে- সেই কাজ যতটা শক্ত ছিল তা আমি জানি, আর কেউ না জানুক, কিন্তু এই কাজ তো আরো দুরূহ। সে যাই হোক, পরের সাত দিন, আমার নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল। আমি টালিগঞ্জে থাকি, অলোকদা যাদবপুরে- খুব বেশি দূরত্ব নয়। কিন্তু পরের সাতদিন অলোকদার বাড়িমুখো হইনি। ভাবলাম কাজটা সাঙ্গ করে তবেই যাব। শেষ পর্যন্ত, দুরুদুরু বক্ষে সেই টাইপ করে চারটি ভাষান্তরিত পাতা তাঁর হাতে সমর্পণ করে সোফার এককোণে টানটান হয়ে বসে রইলাম। আড়চোখে দেখলাম অলোকদার মুখে সম্মতির হাসি। মুখে বললেন প্রায় স্বগতোক্তির ঢঙে – ‘এমনটি আর কেউই পারত না’। সেই কথা আমাকে যা আনন্দ দিয়েছিল, তা সারাজীবন আমার কাছে এক অলংকারের মত। কিন্তু আনন্দের প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় ইংরেজি প্রিন্ট আউট টি তাঁর কাছে থেকে চেয়ে রাখিনি। পরের বছর আবার যখন ফিরলেন কলকাতায় অলোকদাও সেই কপিটির কোনো খোঁজ পেলেন না। কপি ঐ একটিমাত্রই ছিল। আর অলোকদা যে কাগজপত্রের ব্যাপারে খুব গোছালো ছিলেন এমন অপবাদ তাঁর শত্রুরাও দেবে না। ফলে আমাদের সেই কপি আর ফিরে পাবার কোনো রাস্তা খুঁজে পাইনি। ‘সন্ধিৎসা’ – অরবিন্দ ভবন, কলকাতার মুখপত্র-র সম্পাদক রমাপ্রসাদ দে, অলোকদার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সেটি ছেপে দিলেন। সেই পত্রিকা অবশ্য অরবিন্দ ভবনের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই এত মূল্যবান একটি ভাষণ সাধারণ্যে পৌঁছায় নি। তাই ওয়েব ম্যাগাজিন ‘রঙিন ক্যানভাস’ –এর সম্পাদক রোশনি ইসলাম এর অনুরোধে আমি সেই মূল্যবান ভাষণটি পাঠালাম তার কাছে যাতে পাঠকবৃন্দ এই অসাধারণ একটি ভাষণ পড়ার সুযোগ পান। ধন্যবাদ।
- রন্তিদেব সরকার
নব্য ভারতচর্যার উন্মেষ
-অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
প্রথমেই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলা যাক যে আমার এই উপস্থাপনা একেবারেই আনুসারিক-ধর্মী ; জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট-এর Neure Sprachen and Literatures বিভাগে অর্থাৎ আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনার সময়ে অভিজ্ঞতালব্ধ ধ্যান ও ধারণার ভিত্তিতেই গড়া।
ব্যাপারটা শুনলে অদ্ভুত লাগবে যে এই বিশেষ বিভাগটির জন্মলগ্ন, যা পুরোনো এক চাঁদোয়ার নিচে, প্রাচীন ভারতত্ত্বের উৎসমুখ হতে উৎসারিত হয়েছিল একদিন; যে বিদ্যাটিকে আদৌ মৌলিক বলা যায় না বরং বেপথুমান বলা যেতে পারে; রক্ষণশীল ধ্রুপদীজনেরা যে বিদ্যাটিকে Fachrichtung-অর্থাৎ নিছক এক সহযোগীবিদ্যা বলে অভিহিত করেছিলেন; যা নাকি বিদ্যার মূলস্রোতে পরিগণিত হবার মত নয় বলে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, তা এখন আপন যোগ্যতায় মান্যতা পেতে শুরু করেছে এবং এতদসত্তেও, আপন অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে এমন এক প্রতিকূল পটভূমি, যেখানে বিদ্বজ্জন এবং পন্ডিতমহলের অবজ্ঞা এবং সদাজাগ্রত ভ্রূকুটি নিরন্তর সঞ্চরমান, সেখানে দাঁড়িয়ে আধুনিক ভাষা ও সাহিত্যের এই শাখা Neue Indologie- র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিল এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যার অবিসংবাদী প্রভাব তদানীন্তন পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলি (Eastern Block), যেমন পোল্যান্ড এবং চেকোস্লোভাকিয়া-র উপর পড়েছিল ।
এই নন্দিত সমাপতনের কারণ খুঁজতে বেশী দূরে যাবার প্রয়োজন নেই। একটা কারণ অবশ্যই যে ধ্রুপদী ভারততত্ত্ব বিষয়টি সর্বতোভাবে সংহত এমনকি এর মধ্যে একমেবদ্বিতীয়ম্ গোছের অন্তর্নিহিত একটা ভাব ছিল। এর অন্তর্গত ভারত-জার্মানি সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের যে জোয়ার হিটলারের জার্মানিকে প্লাবিত করেছিল, সেই প্রবাহে ১৩টি (তখনও সংখ্যাটির গায়ে ‘অপয়া’ তকমাটি আঁটেনি) সংস্কৃত-অধ্যাপকের পদ, তুমুল উদ্দীপনায় সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্ব্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিতে সংস্কৃত ভাষার প্রতি এই অন্ধ অনুরাগ দেশের এক সংস্কার-এ পর্যবসিত হয়েছিল যা তখনও পর্যন্ত কথ্যভাষার মধ্যে গণ্য করা হতনা তবুও ‘প্রাকৃত’ বা ‘পালি’ ভাষার থেকে কিছুটা হলেও বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল।
ক্রমবিকাশশীল ভারততত্ত্ব, যাই হোক না কেন, সে সময় যাবতীয় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল বিভিন্ন ভারতীয় কথ্যভাষার উপর, বিশেষ করে ইন্দো-এরিয়ান এবং দ্রাবিড়, উভয় ভাষা-ভাষীদের উপর। এই প্রয়াসকে কমবেশী বহুধামুখী ছক বলে চিহ্নিত করা যায়। সরকারি-ভাবে তখনকার দিনে ১৫টি স্বীকৃত ভারতীয় ভাষা-ভাষীরা (এখন ২৪টি) নিজেদের মধ্যে চমৎকার এক যোগাযোগের সেতু তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিল, যা প্রায় এক যৌথ মিলন-মেলার সঙ্গেই তুলনীয়; যা খ্রিষ্টীয় পার্বণ ‘Pentecost’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়- যেখানে বহুদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের সমাবেশে তারা আবিষ্কার করে যে তারা ভিনদেশের কথ্য ভাষা বুঝতে সক্ষম হচ্ছে।
একটি মিশ্র শব্দবন্ধন হয়ত বা আধুনিক ভারততত্ত্বের অন্যতম মেরুরেখা কেননা যে পঠনবিন্যাস আমরা অনুসরণ করতাম তার মূল উপজীব্য ছিল বিভিন্নতা এবং বহুবাচনিক; এ ভাবে শুধুমাত্র কোন একটি সাহিত্যবিশেষের নয়, পাশাপাশি অন্যান্য অনেক, যার প্রতিটি মূল থেকে বেজে উঠত নিখাদ ভারতীয়তার সম্মেলক সুর। এখানে ‘বিভিন্নতা’ বলতে সেই মান্ধাতার আমলের রূপরেখাটি নয়, যা শুধুমাত্র প্রকৃ্তি, তা থেকে বিভাজিত ভিন্নতর শ্রেণীবিন্যাস, তা থেকে মহাজাতি, প্রজাতি ইত্যাদি নয়, আমি সেই মারাত্মক অনুশাসিত বিন্যাসের কথা বলতে চাইছি, এক বৈচিত্রময় বিরোধাভাসের উপস্থিতি, যা আমি ভারতীয় সংস্কৃতিতে পেয়েছি। পক্ষান্তরে, এটা ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের অতীব সম্ভাবনাময় সৃজনশীলতা যা তাকে কর্তৃত্বময়তা প্রদান করে। অন্য কোন ধর্মের পক্ষে কি কোনদিন তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে সৃস্টি করা কল্পনাতেও স্থান পেয়েছে ?
এই যে ছড়ানো বিশালত্ব, মহাবিশালত্বও বলা যায়- রক্তে সত্যিই এক নেশা ধরিয়ে দেয় এবং কোন পাশ্চাত্যবাসীর কাছে তা হয়ত এক বিভ্রান্তিকর ব্যাপার। সব কিছুর মধ্যে সে চায় পরিপাটী; সাজানো টেবিল, চিহ্নিত এলাকা। মেরুকরণটাই মুখ্য সেখানে, মেলামেশাটা বাহ্য ! পাশাপাশি ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘সীমানা’ বয়ে আনে তাকে অতিক্রম করার হাতছানি কেননা, আকার কখন হয়ে ওঠে নিরাকার, কখনও বা সাকার আবার কখনও তা মিলেমিশে একাকার হয়ে অন্য কোনো আকৃতিতে স্বপ্রকাশ, এক অনিশ্চিত লক্ষের দিকে ছুটে যাওয়া, যা দেখে নীতিবাগীশরা তাকে অসম্ভব বলে সাব্যস্ত করতে চাইবে। কিন্তু তা বলে সৃজনশীলতা কি উচ্ছন্নে যাবে? তা হবার নয়, কেননা একে দৃঢ়হাতে ধারণ করেছে, এক সদাপ্রবাহী সাম্যাবস্থা, যেখানে সংস্কার এবং স্বকীয়তা একটি সূত্রে গ্রথিত হয়ে যাচ্ছে। যেখানে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা এক যুগলনৃ্ত্যে সামিল হয়ে পড়ছে এবং নিরন্তর এক সূক্ষাতিসূক্ষ শৈলী
রচনা করেই চলেছে।
শুধুমাত্র হেগেলীয় দর্শনে সূত্র বা বিরোধাভাস নয়, তার থেকেও অনেক গভীর অধ্যাত্মবোধ নরনারীর জীবনে ক্রিয়াশীল রয়েছে। বিদ্বেষপ্রসূত মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় পাশ্চাত্য সভ্যতার আরোপিত প্রাণশক্তি-নিংড়ানো যন্ত্রব্যবস্থা নয় বরঞ্চ হৃদয়তন্ত্রীতে অর্কেস্ট্রার ঝঙ্কার তোলা সূরমূর্ছনা ছড়িয়ে বহুরূপী ঈশ্বরের বন্দনা। অধ্যাত্মরূপের বিভিন্ন প্রকাশের প্রতি কোন নিয়মনিষ্ঠ ছকের শৃংখলা নয়, পক্ষান্তরে, স্বতঃস্ফূর্ত সমর্পণের
অঙ্গীকার যেখানে পরস্পর গান ও ভাষণ, সংগীত ও গতিময়তা, দেহ ও পার্থিবতা এবং পৃথিবী ও
আকাশ, বাতাস ও উপলখন্ড এবং মহাশূন্য খুঁজে ফেরে, প্রাণের অস্তিত্ব ঘোষণা করে, নিদারুণ
আনন্দের উল্লাসে।
এমনতর তূরীয় আনন্দে আমার সতীর্থবন্ধুরা মশগুল ছিলেন, যারা রসদ সংগ্রহে ব্রতী হয়ে যোগাযোগ
ঘটাতেন নিত্য এবং অনিত্য সাহিত্যের সঙ্গে, এমনকি তারাও, যারা লিখিত এবং অলিখিত সাহিত্য
সামগ্রীর সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। মৌখিক সাহিত্য (আপাতবিরোধী শব্দ হচ্ছে না তো ?) বহুভাষাভাষী ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী পটভূমিতে এক
বিশেষভাবে আবশ্যিক উপাদান- যে ভান্ডার থেকে এই উপমহাদেশের কতশত সৃজনশীল সাহিত্যরচনা এখনও
আমাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের যোগানদার। ভারতীয় উপমহাদেশের আর যাই হোক, অন্তর্মুখিনতার অপবাদ নেই। উদ্দীপ্ত বাঙ্ময়তা, তা সে গপ্পোই হোক বা বাজারে দরাদরি, নিছক কেনাকাটা হোক বা আটপৌরে সুখদুঃখের
পাঁচালি,বকবকানি বা আড্ডা- এ সবই এই উপমহাদেশের চালচিত্র। এই সজীব উর্বরশীলতার মধ্যেই ‘লিখিত’ সাহিত্যের জন্ম; তা হয়ত কোনো চূড়ান্ত বা নিখুঁত রূপরেখা নয়, কিন্তু আরও পাঁচটি বিকশিত ফুলের মধ্যে গণ্য করার মত একটি তো নিশ্চয়ই। সে অর্থে এটা হয়ত ক্ষুদ্রাকার কেননা লিখিত সাহিত্যের সুযোগ – সুবিধে মুষ্টিমেয় লোকেদের নাগালেই ছিল তখন। সে সব উচ্চৈঃস্বরে পঠনের মাধ্যমে অথবা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে অঙ্কনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হত। সম্ভবত এখানেই, আশ্চর্যজনকভাবে, ইংরেজি ভাষায়, কৃত্রিম সুরভিযুক্ত ভারতীয় সাহিত্যের নমুনা মেলে। এ সব অবশ্যই ভারতীয় সমাজের গভীর ব্যাপ্তি থেকে উৎসারিত আলো নয় বা সৌরভ নয় কিন্তু সমাজের মূলস্রোতের সাধারণ শ্রেণীর দ্বারা লালিত, অভিজ্ঞতালব্ধ নির্যাস বলা যেতে পারে। এটা বলা যেতে পারে, মার্কিন মুলুকে Indian Studies নামে যে বিষয়টি পড়ানো হয়ে থাকে, তা মূলত নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে সংগৃহীত লোকায়ত জীবনের উপাদানগুলির উপর আধারিত। কিন্তু আসল উদ্দেশ্যগুলি তো পুঁথিগতই থেকে যাচ্ছে। তবে যাই হোক না কেন, হাইডেলবার্গ সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট -এ আমরা কিন্তু আমাদের অধ্যাপনার সময় শুধুমাত্র মেধামনস্কতায় আচ্ছন্ন থাকতাম না। পক্ষান্তরে, যেটার উপর গুরুত্ব দিতাম তা হল গিয়ে –সৃজনশীল মননের সঙ্গে আমাদের নিরন্তর দ্বৈরথ। তাদের মধ্যে অনেকেই দলবেঁধে এসে নৃত্যগীত পরিবেষন করত এবং আমরা তৎক্ষনাৎ সেগুলিকে পরবর্তী
অধ্যয়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত করতাম।
হাইডেলবার্গে, আমরা বিচ্ছিন্ন কোন পুঁথিগত বিশেষত্বের উপর গুরুত্ব না দিয়ে বরং শিক্ষাদান-শিক্ষাগ্রহণের এই চিরায়ত প্রক্রিয়াটির সামগ্রিক অন্বেষায় জোর দিতাম। আমাদের কেন্দ্রিত অনুপ্রাণনা ভাষাসাহিত্যমুখী নির্ভরতার দ্বারা আচ্ছন্ন থাকত, যার মূল ভাবধারাটি ছিল
জৈবিকবৃত্তি দ্বারা চালিত মানুষের যুগপৎ ভাষা ও সাহিত্যের স্বরায়ণ। তাই আপনারা বিস্মিত হতেই পারেন যে আমি প্রায়ই প্রারম্ভিক স্তরে কাজ শুরু করতাম রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ
পাঠ’ দিয়ে। শিশুদের এই চমৎকার বইটি পড়ানো হত তাঁর শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক বিদ্যালয়ে। বইটিতে ‘বর্ণপরিচয়’ ঘটানো হয়েছে ‘বাগধারা’-র সাহায্যে, ছড়ার মাধ্যমে বা গদ্য দিয়ে যেখানে ছড়ার মেজাজটি রাখা হয়েছে। বিশ্বখ্যাত মনীষীরা, যেমন লোথার লুউৎসে বা নরিহিকো উচিদা – এঁরা ছোটদের পড়ার ক্লাশে গিয়ে নিজেরাই কখন শিশু হয়ে উঠতেন। আমার কাছে এ এক অমেয় প্রাপ্তি যেদিন দু-একটা ক্লাশ নেবার পর লোথার আমার রুমে ঢুকে বললেন- “ অলোকরঞ্জন, চলো আমরা দুজনে মিলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতার জার্মান-অনুবাদের একটা সংকলন বের করে ফেলি”। আর সত্যি সত্যিই এমন একটি বই প্রকাশিত হল- ‘GANGESDELTA’ (১৯৭৪) নাম দিয়ে, যে সংকলনটিতে স্থান পেয়েছিল সমসাময়িক বাংলার তথা ভারতের নির্বাচিত কিছু কবিতা সহ বাংলাদেশের কবিতা, পরবর্তী
সময়ে যা জার্মানিতে একটি উচ্চতর সিলেবাসে পাঠ্যবই-এর মর্যাদা লাভ করেছিল এবং আমাদের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও অন্যত্র সবার জন্য এই বইটি অবশ্য-পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
তুলনামূলক সাহিত্যের মূলনীতির উপর দাঁড়িয়ে আমাদের অন্যান্য ভাষা-ভাষী অনুষদবর্গের কাছে নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। বস্তুতপক্ষে কারো পক্ষেই সমস্ত ভারতীয় ভাষাগুলিতে দক্ষ হওয়া সম্ভব নয় যার ফলে আমাদের ক্লাশগুলি একাধিক ভাষার অধ্যাপক-এ অধ্যুষিত হয়ে থাকত। যেমন ছোটগল্পের ক্লাশে অথবা উপন্যাস ক্লাশে দেখা যেতে লাগল, যুগ্মভাবে বাংলা-তামিল কিংবা মারাঠী-কন্নড় অথবা হিন্দী-ঊর্দু ক্লাশগুলি একযোগে চলছে। সে সব ক্ষেত্রে, যে সব ছাত্রছাত্রী এ ধরণের যুগ্মক্লাশে অভ্যস্ত হচ্ছে তাদের স্নাতকোত্তর বিভাগের পরীক্ষায় অথবা গবেষণার কাজে কমপক্ষে দু-দুটি সাহিত্যে/ভাষায় কাজ করার প্রবণতা এসে যেত। এই প্রবণতার ফলে এমন প্রণোদনা তৈরী হয়েছিল যে একটি কর্মশালায় বাংলাভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল যার পরিচালনভার ছিল Institute of Sinology and Japanese Studies-এর হাতে এবং সেটা উৎসর্গীকৃত হয়েছিল ভারত, চিন ও জাপানের তিন আধুনিক লেখকের নামে।
যে ব্যাপারটা আমাদের কাছে গুরুত্ব পেত, তা ছিল – সমকালীন ভারতীয় লেখনের মাতৃভাষাশ্রিত লেখাপত্তরের গভীর অধ্যয়ন। একদিন পন্ডিত আইথাল, কন্নড় ভাষায় বিরচিত অনন্থমূর্থি-র গল্প-‘সূর্যের ঘোড়া’ আমাদের পড়ে শোনাচ্ছিলেন। সেখানেই তিনি আমাদের জানালেন –‘ কন্নড় ভাষা ৪ কোটি দক্ষিণ-ভারতীয় লোকের মাতৃভাষা তথাপি শুধুমাত্র একটি অঞ্চলের অধিবাসীরাই এই ভাষা বোঝে। যতক্ষণ না পর্যন্ত কন্নড়-সাহিত্য ইংরাজী ভাষায় অনুদিত হচ্ছে এবং তার থেকে অন্যান্য ভাষায়, সারা দুনিয়ার কাছে কন্নড়-ভাষার দরজা বন্ধ; যদিও এই ভাষায় সাহিত্য হাজার বছরেরও বেশী পুরোনো। এ প্রসঙ্গে আমাদের মারাঠী ভাষার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সোনঠাইমার এই লেখকের উপর একটি জ্ঞাতব্য পাদটীকা সংযোজন করলেন –“অধ্যাপক অনন্থমূর্থি এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন – হিন্দু জাতির মধ্যে কুলীনশ্রেষ্ঠ; যার অর্থ, এক নিবিড় সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠার এক নিশ্চিন্ত আশ্বাস। তাঁর লেখা বই ‘সংস্কার’-ই তাকে প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। তারপর তিনি আরো দুটি উপন্যাস, বহু ছোটগল্প এবং কবিতা, একটি নাটক এবং একাধিক সাহিত্য সমালোচনা রচনা করেন। একজন লেখক হিসেবে তিনি বারে বারে বর্তমানের প্রেক্ষিতে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিকতা টেনে এনেছেন, পারস্পরিক বিরোধিতাপুর্ণ ঐতিহ্যের লড়াই, তিনি নিজের জীবনযাত্রায় অনুভব করেছিলেন, প্রায়শই। অধ্যাপক অনন্থমূর্থির মতে বেশ কিছু শতাব্দীর এই সহাবস্থানই সম্ভবতঃ ভারতবর্ষের বিশেষত্ব। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন এই ভাবে –
· “আমার ঠাকুমা মধ্যযুগের, তার সঙ্গে তাঁর মূল্যবোধ ও স্মৃতিও। আমি সেদিক দিয়ে অনেকটাই আধুনিক। কিন্তু আমার শৈশব কেটেছে চসার- এর সমসাময়িক চতুর্দশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি সরাসরি ‘ক্যানটারবেরি টেলস’ থেকে টেনে বের করার মতই। আমি প্রথম যখন তা পড়লাম, তাদের লেখককে আমার সমকালীন বলেই মনে হয়েছিল। ডিকেন্স- ও প্রায় আমার সমসাময়িক কেননা ভারতবর্ষে তখন আমরা অনুরূপ সামাজিক অবিচার এবং শ্রমিক অসন্তোষ-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। শ্রীহীন শহরতলি- আরও সব কিছুই, যা দ্রুত শিল্পায়নের পায়ে পায়ে এসে পড়ে, সে সব লক্ষণ পরিষ্ফুট হয়ে উঠছিল। তথাপি পাশাপাশি চন্দ্রপৃষ্ঠে কী কী হচ্ছে তাও আমরা জানতে পারছিলাম। কয়েক শতাব্দীর এই যে সহাবস্থান, তা ভারতীয় সাহিত্যকে ধনী করেছে, বিভিন্ন ভাষায় তা প্রকাশ পেয়েছে, বিশেষ কোন আগ্রহকে ঘিরেই।”
এহেন এক পটভূমিতে ঋদ্ধ হয়ে আমরা তাঁর মূল গল্প- সূর্যের ঘোড়া- র সহযোগী গল্পগুলি গভীর মনযোগ নিয়ে শুনতে শুরু করলাম এবং সে সময় আমাদের অনুভূতি হচ্ছিল, যেন কোন মন্ত্র মন্দ্রিত হচ্ছে। আমরা আবিষ্কার করলাম, বস্তুতপক্ষে কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই, লেখক অনন্থমূর্থি তাঁর লেখার মধ্যে তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু ‘অনন্ত’-কে সবরকম সামাজিক সংস্কার এবং প্রথার জাল থেকে মুক্ত করতে চাইছেন-ভারতীয় ব্যাপার-স্যাপারও রয়েছে এর মধ্যে, এক প্রতীকী জঙ্গল, যা সমগ্র মানবসত্তার স্মৃতিভান্ডার হিসেবে প্রতীয়মান করতে চেয়েছেন-
· “অনন্ত, অনন্ত, এখন তুমি জঙ্গলে প্রবেশ করেছ। জঙ্গলে প্রবেশ, জঙ্গলে প্রবেশ......বৃক্ষ, বৃক্ষ, বৃক্ষ... বৃক্ষের মাঝখানে ...একটি টিয়ে। সবুজ টিয়ে......পাতার আড়ালে এক সবুজ, সবুজ টিয়ে......এক সবুজ টিয়ের বাঁকানো ঠোঁট, বাঁকানো ঠোঁটে একটি লাল ফল, লাল, লাল ফল......”
আমি এখানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্মৃতি রোমন্থন করছি যেখানে আন্তআঞ্চলিক অথবা আন্তবিষয়ক ভাষার
শিক্ষাদান নিয়মিতভাবে করে থাকে Department of Modern Languages & Literatures, যেখানে সমস্ত ছাত্রছাত্রী, সমস্ত ভাষার অনুষদবর্গ, অতিথি অধ্যাপক এবং মানববিদ্যা, ধর্মতত্ত্ববিদ্যা, শিল্প-ইতিহাস বিভাগের অংশগ্রহণকারীরা- সবাই এই বন্ধুত্বপূর্ণ বিতর্কে যোগদান করেছেন এক বিশেষ মহৎ
অনুসন্ধিৎসায় অংশীদার হতে, যৌথভাবে।
আমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে, চিরশিক্ষার্থী এক শিক্ষকের ভূমিকায় এমন একটি সৃজনমুখী আকাদেমিক
তথা নান্দনিক ঐতিহ্যের শরিক, যাকে আমি, গ্রহণযোগ্য শিক্ষায়তনের কাঠামো হিসেবেই দেখতে ভালোবাসি; যা শুষ্ক, প্রথাজীর্ণ বিদ্যার্জনের বালাই থেকে মুক্ত।
[জন্ম- ৬ অক্টোবর ১৯৩৩
স্থান- বকুলবাগান, কলকাতা
প্রয়াণ – ১৭ নভেম্বর ২০২০
স্থান- হির্শবার্গ, জার্মানি
পিতা - বিভূতিরঞ্জন দাশগুপ্ত
মাতা - নীহারিকা দাশগুপ্ত
পড়াশোনাঃ
স্কুল শিক্ষা - পাঠভবন, বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন, বীরভূম
IA স্তর- সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর - প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
কর্মজীবন- অধ্যাপনা -যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ ও বাংলা বিভাগ, কলকাতা। পরে অধ্যাপনা করেন নব্য ভারততত্ত্ব নিয়ে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়-এ।
গবেষণা- বাংলা সাহিত্যে লিরিক রূপকল্পের বিবর্তন বিষয়ে পিএইচ ডি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হুমবোল্ট ফাউণ্ডেশন এর গবেষণাবৃত্তিও পেয়েছেন।
অসংখ্য কাব্য, অনুবাদ সংকলন, প্ৰবন্ধ গ্রন্থের প্রণেতা কবি দেশবিদেশের বহু পুরস্কারে সম্মানিত, যথা : রবীন্দ্র, গ্যেটে, শিরোমণি, আনন্দ, নজরুল, কবীর, সুধা বসু ইত্যাদি পুরস্কার।]
আমি তো বাকরূদ্ধ । রন্তি তোমার সুলিখিত ভাষনে। অলোকরঙ্জন সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম তুলনাত্মক সাহিত্য বিভাগ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মহারথীদের অন্যতম আর খুব ছোট্ট করে বলি আমার শ্রীমতীর অতিপ্রিয় অধ্যাপক। তোমার ভাষনে তিনিও মুগ্ধ। আমাদের উভয়ের সশ্রদ্ধ প্রনাম কবিকে আর তোমাকে জানাই অশেষ অভিনন্দন।
উত্তরমুছুন।
ওপরের মন্তব্যটি এই অধম প্রদীপ ঘোষ দুর্গাপুর থেকে রন্তি !
উত্তরমুছুন