শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২

কাজল সেন-এর ঝুরোগল্প

আমার পরাণ যাহা চায়

 

বিয়ের বাসররাতে বুকান সবার অনুরোধে একটা গান গেয়েছিল। প্রথমে ঠিক করে উঠতে পারছিল না, এই স্থান-কাল-পাত্রের প্রাসঙ্গিকতায় কী গান গাওয়া যায়! তারপরই খালি গলায় শুরু করেছিল, ‘আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো!’ বুকান গান শিখেছে, গায় ভালো, গলাটাও মিষ্টি। বাসরঘরে সমাগত সবাই বেশ মন দিয়ে বুকানের গান শুনছিল। তাছাড়া বুকান আজ কনের সাজে সেজেছেও বড় সুন্দর। সে আজ যা কিছু করবে, সবার ভালো লাগবে। বুকানের ঠিক পাশেই গা ঘেঁষে বসে গান শুনছিল বুকানের সদ্য বিবাহিত বর আনন্দস্বরূপ।

 

আনন্দস্বরূপ এখন কর্মসূত্রে স্টেটসে থাকে। স্থায়ীভাবে থেকে যাবার অভিপ্রায়ে গ্রীনকার্ডের জন্য আবেদন জানিয়েছে। সম্ভবত পেয়েও যাবে। সম্প্রতি মাস দুয়েকের ছুটি ম্যানেজ করে দেশে এসেছে। উদ্দেশ্য মা-বাবা-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলিত হওয়া এবং এই অবসরে বিয়ের পর্ব চুকিয়ে ফেলা। বিয়ের সম্বন্ধটা দুপক্ষের অভিভাবকেরা অনেকদিন আগেই পাকা করে রেখেছিল।  বুকান আনন্দস্বরূপ অবশ্য কেউ কাউকে মুখোমুখি দেখেনি, ছবি দেখেছে। ফোনে দুএকবার কথা হয়েছে, মামুলি কিছু কথা, তেমন জরুরি নয়।

 

বুকান গান গাইছিল, ‘তোমা ছাড়া আর জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো!’ আনন্দস্বরূপের মনে হঠাৎ কেমন যেন একটা খটকা লাগল। বুকান এই গানের সূত্র ধরে তাকে কী মেসেজ পাঠাতে চাইছে? তাকে এভাবে ইমপ্রেস করার চেষ্টা কেন? বুকানের পরান কি সত্যি সত্যিই আনন্দস্বরূপকে চেয়েছিল? আদৌ চেয়েছিল? নাকি ডাহা মিথ্যে কথা বলছে? বুকান তো নিজেই একদিন ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল যে, আগে সে তার বয়ফ্রেন্ড সুমন্তকে ভালোবাসত। কিন্তু সেই সুমন্ত তাকে নিয়ে অনেক খেলাধুলো করে হঠাৎই একদিন কেটে পড়েছে। বিয়ের পর যেন কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয়, তাই আগেভাগেই জানিয়ে রাখছে। বুকানের কথা শুনে হকচকিয়ে গেছিল আনন্দস্বরূপ। বিয়ের আগে কোনো মেয়ে তার হবু বরকে এমন কথা বলে? আশ্চর্য তো! একথা জেনে তো যে কোনো হবু-বর বুকানকে বিয়ে করতে অস্বীকার করতে পারে! আনন্দস্বরূপ অবশ্য অস্বীকার করেনি। না করার দুএকটি মোক্ষম যুক্তিও আছে। প্রথমত আনন্দস্বরূপের মা-বাবা এবং বুকানের মা-বাবা একইসঙ্গে পড়াশোনা করেছে প্রেম করে বিয়ে করেছে। বিয়ের আগেই তারা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করেছিল, তাদের সন্তান যদি বিপরীত লিঙ্গের হয়, তাহলে তারা একে অন্যের বর-বৌ হবে। মাঝে অবশ্য কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না। অনেক বছর পরে কোনো এক সূত্রে যোগাযোগ হওয়ায় তারা তাদের চুক্তি রূপায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

 

এছাড়া আনন্দস্বরূপের বুকানকে বিয়ে করতে সম্মত হওয়ার আরও একটি কারণ বা মোক্ষম যুক্তি আছে। আসলে সে নিজেও ইতিপূর্বে ঝাড় খেয়েছে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে লিভ ইন করে। মেয়েটি আনন্দস্বরূপকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি, সন্তানধারণেও রাজি হয়নি। তারপর একদিন আনন্দস্বরূপকে ছেড়ে  চলেও গেছে।

 

কিন্তু তা বলে আনন্দস্বরূপ কখনওআমার পরাণ যাহা চায়গাইতে পারে না।  বুকানও গাইতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য এই গান কখনই লিখতে পারেন না!  

 

২টি মন্তব্য: