প্যারাডোলিয়া
বাদশার জেগে থাকার অর্ধেক সময় কাটে কল্পনা ও অবাস্তব আকৃতির সাথে মনে মনে কথা বলা তর্ক বিতর্ক ও যত আমোদ প্রমোদ। বাকী সময় জীবিকার জন্যে যতটুকু। মানুষের জন্যে তার সময় খুব কম। ভোরে উঠেই যখন কোমোটে বসে যায়, অপরিষ্কার শ্যাওলাপড়া চিত্র বিচিত্র নকশাতে বুঁদ হয়ে খোঁজে নানান আকৃতির মুখ দেহভঙ্গি জানোয়ার পাখি ঘোড়া লোকলস্কর রাণী কুমারী দেহ আরো কতকি। অনেকদিন ধরে একটা আকৃতিকে কুকুর শয়তান আনুবিস বলে জানতো, একদিন সেটা হঠাত্ বদলে গিয়ে একটা সন্ত ফকিরের প্রশান্ত দয়াবান মুখ হয়ে গেছে। অদ্ভুত প্রশান্তির ছটা তার মুখমন্ডলে। এতদিন ভয় পায়নি,এবার ভয় পেল সে। এই অশুচি দুর্গন্ধময় নোংরা পায়খানার মেঝেতে ঈশ্বরের দূত? পাপ হবে না? এই চিন্তায় সে লোক ডাকিয়ে মেঝেতে ঝকঝকে টাইলস বসিয়ে দিল।
অবশ্য তার কল্পনা ও চিত্র বিচিত্র আকৃতি খোঁজার বিরাম নেই। যেখানে সেখানে পলস্তারা খসা দেওয়াল দেখলেই থমকে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে ছেঁড়া মেঘ দেখলেই পলকেই পেয়ে যায় আকৃতি। এইরকম অবস্থায় একদিন এক ট্যাক্সিতে ধাক্কা। ডাক্তারের জিজ্ঞাসা,-রাস্তার মাঝে আকাশের দিকে হাঁ করে কি দেখছিলেন? আর একটু হলেই চাকার নিচে চলে যেতেন।
তারপর রেফার টু সাইকিয়াট্রিস্ট। উনি বললেন, -না, এটা রোগ নয়। এটা একটা ভ্রম। নাম প্যারাডোলিয়া। তবে এই ভ্রমটা একটা শিল্পসত্তা। কী ভালো ডাক্তার! এইগুণ যে আমাতে রয়েছে সেটাতো জানতাম না? ভাবল বাদশা।
জীবনযাপনে কষ্ট অবসাদ অসার সমস্যা তো লেগেই থাকে। মাঝে মাঝেই কোনো মুখাকৃতির কাছে জটিলতার সমাধান খোঁজে বাদশা। মাটির ঢিবি, গাছের কোটর, জীর্ণ দেওয়াল কিংবা ভাঙ্গাচোরা মেঝে থেকে শিল্প মুখর হয়ে ওঠে। বাদশা তার আর্জি পেশ করে। আর অদ্ভুত? সমাধান পেয়েও যায়। তাই সে আনন্দে থাকে। এই স্বভাবের জন্যে একটা দামী বার কর্ণারে কাজ করতে করতে প্রমোশন হয়ে গেল। যদিও মাঝে মাঝে শারিরীকভাবে সে অসুস্থ থাকে। বছরদশেক আগে ওপেন হার্ট বাইপাস অপারেশন হয়েছিল। একটু স্ট্যাটাস ভালো হতে এখন মাঝে মাঝে ক্লায়েন্টদের সাথে ড্রিংক নিতে হয়। অনেক হাই ফাই কাস্টমার। অদ্ভুত তাদের ফরমায়েশি। কেউ চায় সুগন্ধযুক্ত সুরা,কেউ চায় লাল আঙুর কী বেটি। কাঁদে,‘ইয়ে লাল রঙ কব মুঝে ছোড়েগা’। বাদশা সবাইকে দিয়েথুয়ে নিজে ভিন্টেজ কোর্টিফায়েড ওয়াইন নিয়ে বসে। গেলাসে ধীরে ধীরে ঢালতেই বুদবুদ থেকে বিদ্যুতের আভা ঠিকরোয়। তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে সাতরঙ্গী পরীদের সাথে বাদশার মোলাকাত হয়। ওরা হাসে,বাদশার সাথে খেলা করে। আগুন তরলের সাথে বাদশা ওদের পান করে। যেন বুকের ভিতরে সেলাই করা হাড়েদের দহন হয়। বাদশা টের পায়, বুকের পরাধীনতার গ্রন্থি খুলছে। শিল্পসত্তার বন্দীদশা খুলছে।
বাদশা সম্মোহিতের মতন সটান তার গরীবিখানায় আসে। নতুনকেনা রঙ তুলি ক্যানভাস খোলে। সামনের ঝুরঝুরে ফাটা দেওয়াল থেকে উঁকি মারে প্যারাডোলিয়া শিল্পকলা। হাসে কথাবলে ও বাদশার ক্যানভাসে বন্দী হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন