বুধবার, ১ জুন, ২০২২

মেঘ অদিতি-র ঝুরোগল্প

একটি দীর্ঘ কাহিনী

পথচলতি মানুষের জটলা ক্রমেই বাড়ছে। আর উন্মাদটা খিকখিক হাসছে। হেসেই চলেছে। মাঝেমাঝে গলা তুলে কাউকে ডাকার ভঙ্গিতে সুশীল সুশীল বলে চীৎকার করছে। কোথা থেকে দুটো কালো কুকুরও জুটেছে তার সাথে। সুশীল বলে আরেকবার গলা তুলতেই দুটো কুকুরই তার শতচ্ছিন্ন পোশাক ধরে টানাটানি শুরু করল। তাকে উদ্ধারের বদলে দর্শনার্থীর ভিড়ে কেউকেউ সে দৃশ্যধারণ করতে তুলে ধরল তাদের মোবাইল ক্যামেরা।

মুখোমুখি দুটো দ্বিতল বাড়ির বন্ধ জানলা হঠাৎই  তখন খুলে গেল।

নে, ঘেউ এবার ভুতোকে শায়েস্তা করবে। এবার কী করবি? পারলে ঠেকা দেখি!’ ঝাঁজালো গলায় বলে উঠল দখিনা জানলার প্রথমা। 

উত্তর দিকের জানলায় দাঁড়ানো দ্বিতীয়া তার উত্তর করল না। বরং সেই উন্মাদকে ঘিরে দুই সারমেয়র টানাটানি আর মানুষের জটলা দেখে তার সারা শরীর স্থবির হয়ে পড়ল। দুই বাড়ির মাঝ দিয়ে যে সরু রাস্তা চলে গেছে, তারই মাঝ বরাবর মস্ত পাকুড় গাছের ছায়া্ যেখানটায় পড়ে সেখানেই এই উন্মাদ দিনরাত বসে থাকে। ভুতোও তো তাকে চেনে। কিন্তু আজ কেন সে হামলে পড়ল লোকটার ওপর সে বুঝে পেল না। একবার ভুতোকে গলা তুলে ডাকতে চাইল। কিন্তু শরীরের মতই তার মনও অসাড় হয়ে পড়েছে। যা ঘটছে ঘটুক, আমার কী করার আছে ভেবে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।

জানলায় ভেসে ওঠা প্রথমা দ্বিতীয়ার মুখের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। দুজনেরই চোখের মণি কটা, চুল কালচে বাদামী। প্রথমার চুলের গোছা দীর্ঘ বলে তা জানলার বাইরে সর্পিল ভঙ্গিতে যেন হঠাৎ থেমে গেছে। অন্যজনের ঘাড় অবধি ছাঁটা চুলে এলোমেলো ছড়িয়ে যাচ্ছে রোদের ঢেউ। প্রথমা বিরক্তি চাপতে গিয়ে দ্বিতীয়ার থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তায় তাকাল। এবং মুহূর্তে সেও চমকে উঠল। সর্বনাশ! পাগলটাকে আক্রমণ করে বসেছে ঘেউ। ঘেউকে তো সে পাঠিয়েছিল ভুতোকে শায়েস্তা করতে। ঘেউ কিনা তেড়ে গেল সেই পাগলের দিকে! ঘেউকে সে ফিরে আসার কথা বলতে চাইল কিন্তু ঘেউ ততক্ষণে উন্মাদটার জামা ফালাফালা করে ফেলেছে।

ঘটনাটা তেমন কিছুই নয়। পথেঘাটে এমন কতই ঘটে তবে কিনা উন্মাদকে ঘিরে প্রথমা দ্বিতীয়া উভয়েরই মনে পুরনো ক্ষত আছে কি না। সেই উন্মাদ যে ছিল সুদর্শন, একইসাথে দীর্ঘকায়। সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় বড্ড মানাত যাকে। সে কারণেই তো লোকে তাকে সুশীল সমাজভুক্ত করেছিল। আর মুখোমুখি জানলায় যারা দাঁড়িয়ে, সম্পর্কে তারা দুই সহোদরা। দুজনেই চেয়েছিল একে জীবনসঙ্গী করতে। প্রথমা ভাবে, উফ, কী ভুলটাই না করেছিল সে। দ্বিতীয়ার মনে তখন বয়ে চলেছে গতজন্মের বিরহগাঁথা। অতঃপর দুজনে এক্সাথেই ভাবলো, দখলের প্রবণতা মানুষকে বড্ড হিংস্র করে তোলে। সেই হিংস্রতাকে জিইয়ে রেখে তারাও কবে যেন দুটো বাড়ির জানলা বন্ধ করে দিয়েছিল.. আর সেইসব টানাপোড়েনের মধ্যে সেই সুদর্শন পুরুষটি পরিণত হয়েছিল বদ্ধ উন্মাদে।

দুটো বাড়ির জানলা এখন আবার বন্ধ।

রাস্তায় ছড়িয়ে আছে ছেঁড়া পোশাকের টুকরো-টাকরা এবং ভুতো-ঘেউয়ের ফেলে যাওয়া ছায়া।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন