রবীন্দ্রনাথ লোকসাহিত্য গ্রন্থের ‘গ্রাম্যসাহিত্য’ প্রবন্ধে বলেছেন, “অন্নদামঙ্গল ও কবিকঙ্কনের কবি যদিচ রাজসভা-ধনীসভার কবি, যদিচ তাঁহারা উভয়ে পণ্ডিত, সংস্কৃত কাব্য সাহিত্য বিশারদ। তথাপি দেশীয় প্রচলিত সাহিত্যকে বেশি দূরে ছাড়াইয়া যাইতে পারেন নাই। অন্নদামঙ্গল ও কুমারসম্ভবের আখ্যানে প্রভেদ অল্প, কিন্তু অন্নদামঙ্গল কুমারসম্ভবের ছাঁচে গড়া হয় নাই। তাহার দেবদেবী বাংলাদেশের গ্রাম্য হরগৌরী। কবিকঙ্কনচণ্ডী, ধর্মমঙ্গল, মনসার ভাসান, সত্যপীরের কথা সমস্তই গ্রাম্যকাহিনী অবলম্বনে রচিত। সেই গ্রাম্য ছড়াগুলির পরিচয় পাইলে তবেই ভারতচন্দ্র-মুকুন্দরাম রচিত কাব্যের যথার্থ পরিচয় পাইবার পথ হয়।’ কাজেই দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ মুকুন্দ চক্রবর্তী ও ভারতচন্দ্রের কাব্যকে গ্রাম্য সাহিত্য বলেছেন। তাই এসব কাব্য বাহ্যত গ্রামীণ অন্তরঙ্গেরও গ্রামীণ অর্থাৎ ‘রুর্যাল’। আজ পর্যন্ত অনেকের বিশ্বাসও তাই কিন্তু মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষত চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী সাহিত্যে গ্রামীণ চেতনার পাশাপাশি নাগরিক চেতনা কীভাবে প্রকাশিত হয়েছিল অর্থাৎ সে সাহিত্য ‘রুর্যাল’ থেকে কীভাবে ‘আরবান’ হয়েছিল তা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য পড়তে পড়তে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে, ইংরেজ ও ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে এসেই আমরা নগর ও নগর সভ্যতার পরিচয় পেয়েছি এবং আমাদের চেতনার নগরায়ণ হয়েছে। ‘আরবান কালচার’ বলতে যা কিছু তা ঐ বৈশিষ্ট্যবোধ থেকে গড়ে উঠেছে। আর এই বোধের গর্ব মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে ছেড়ে দিয়েছে গ্রাম্য পরিবেশে। এখন এই নগর ও নগরভাবনা বলতে কি বুঝি ও তাই সত্যিই ইংরেজ আমলের ফসল কিনা তা জানা দরকার। নগর শব্দটি গড়ে উঠেছে city শব্দ থেকে। সভ্যতা অর্থাৎ civilization-এর উদ্ভবও এই city শব্দ থেকে। এ প্রসঙ্গে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘The word civilisation comes from Latin Civics, meaning ‘city’. Civilisation is primarily a city product whether in the west or in the east.’’ (The Calcutta Municipal Gazette, 1990)। আমাদের দেশের নগর ও নগরজীবনের সবথেকে ভালো নিদর্শন পাওয়া যায় শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে। এছাড়া নগর ভাবনার দিক থেকে আরও দুটি গ্রন্থের নাম উল্লেখযোগ্য- বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ ও কালিদাসের ‘মেঘদূত’। এই গ্রন্থগুলির ভৌগলিক পরিবেশ শুধু নগর নয়, আন্তঃপ্রেরণাও নাগরিক (urban)। মৃচ্ছকটিক নাটকে নগর হল উজ্জয়িনী। সেই নগরের সৌন্দর্য, মানুষের আচার-আচরণ, জীবনযাত্রায় সর্বোপরি প্রেমের দ্বন্দ্বে যে নাগরিক পরিচয় পাওয়া যায় তার সঙ্গে মধ্যযুগের সাহিত্যে প্রতিফলিত নগরভাবনার একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইংরেজ আমলের আগে বাংলা সাহিত্যে যে নাগরিকতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তা এসেছে সংস্কৃত সাহিত্যের পথ বেয়ে, মৃচ্ছকটিক তার একটা বড় স্তম্ভ। এ নাটকের নায়ক নাগরিক-সম্ভ্রান্ত বণিক আর নায়িকা ‘নাগরিকা’- সৌন্দর্য বিলাসী। প্রেমে রয়েছে নাগরিক জীবনের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব এবং ইন্দ্রিয়াসক্তি বা ভোগবিলাস। এসবের জের চলে এসেছে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরে। যেখানে ব্যবহৃত চুরি বিদ্যার সঙ্গে মৃচ্ছকটিক নাটকের চৌর্যবৃত্তির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রেমে বুদ্ধিলীলার পরিণতি দুটি ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান।
মধ্যযুগে এই নগর পত্তনের পেছনে প্রধানত চারটি ক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। এক. রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক, দুই. বাণিজ্যিক, তিন. বিদ্যাচর্চা বা সাংস্কৃতিক, চার. ধর্মীয়। এই সময়ের সাহিত্যে আমরা যে সব নগরের চিত্র পাই তার কিছু বাস্তব, কিছু কবি কল্পিত। বাস্তবের মধ্যে প্রধান গুজরাট, গৌড়নগরী, নবদ্বীপ ইত্যাদি। এছাড়াও আছে সপ্তগ্রাম, বর্ধমান, কৃষ্ণনগর প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য। গঙ্গার ধারে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে ত্রিবেণী, শান্তিপুর, পানিহাটি আর কাল্পনিক নগর হিসাবে বিখ্যাত ছিল চম্পাই নগরী, উজানিনগরী।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কয়েকটি নগর ও তাদের নাগরিক বৈশিষ্ট্য-
এক. মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল :
চণ্ডীমঙ্গলের এই গুজরাট নগর সম্পর্কে প্রথমেই আমাদের প্রশ্ন জাগে এই নগর পত্তনের মূলে কি ছিল? এটা কি নিছক কাল্পনিক না এর বাস্তব ভিত্তি আছে। এটাকে কাল্পনিক বলেই প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার এর মধ্যে গৌড় নগরীর ছায়া দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কবি গুজরাট নামটা নিয়ে এল কেন? গুজরাট নামটা তো বাস্তব- ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক। ভারতের পশ্চিমে এটির অবস্থান। মুকুন্দের এই গুজরাট ভাবনা যতই কাল্পনিক হোক এর কিছু না কিছু বাস্তব ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয়। কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করেন যে বনের ওদিকে কলিঙ্গ অর্থাৎ ওড়িশা আর এদিকে বঙ্গ অর্থাৎ মেদিনীপুর জেলার সীমান্ত। কবি এই জেলায় বসে (বাঁকুড়া রায়ের সভায়) কাব্য লিখেছিলেন। কবির ভাবনায় যে গুজরাট এসেছে তা ভৌগোলিক পরিবেশের স্থান নয় কিন্তু গুজরাটের স্থান প্রসিদ্ধি কবির পক্ষে অশ্রুত বা অজ্ঞাত নাও থাকতে পারে। তুর্কী আক্রমণের পর এদেশে অশ্বশক্তির প্রতিষ্ঠা ঘটে। তারপর গুজরাট থেকে অশ্ব আসত বাংলাদেশের বাণিজ্যিক বস্তু হয়ে। সুতরাং এসবের সঙ্গে মুকুন্দের পরিচয় থাকা অসম্ভব নয়। তিনি যেখানে ছিলেন অর্থাৎ বঙ্গ ও কলিঙ্গের সীমান্তে সে জায়গা ছিল সেখানে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে যাওয়ার গেট-ওয়ে। এই বনাঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এছাড়া বিদ্যাপতির ‘পুরুষপরীক্ষা’য় পাচ্ছি গৌড়ের সঙ্গে গুজরাটের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা। সুতরাং, পশ্চিম ভারতের গুজরাট কবি চিন্তায় আসতেই পারে। মুকুন্দের গুজরাট নগর ভূগোল-ইতিহাস ও কিংবদন্তীর মিশ্রণ। তা না হলে চোখের সামনে বাংলাদেশের নগর জনপদ থাকা সত্ত্বেও কবি গুজরাট নিয়ে আসতেন না। সুতরাং এই গুজরাট বাস্তব, এর নগর পদ্ধতি অনেকটা কবি কল্পিত।
মুকুন্দের গুজরাট নগর পত্তনের ক্ষেত্রে গৌড় নগরীর কোন ছাপ বা স্মৃতি আছে বলে মনে হয় না। এই নগরের নাম কবির বাস্তব জ্ঞানের ফসল হলেও কবি নগর পত্তনের উপাদান সংগ্রহ করেছেন পৌরাণিক ঐতিহ্য থেকে এবং কবির ধনী প্রাসাদ ও বাস্তব সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে। পৌরাণিক ঐতিহ্য এসেছে মূলত রামায়ণ থেকে- ‘অযোধ্যা সমান পুরী’। ধনীর প্রাসাদের অভিজ্ঞতা:
১. ‘পাষাণে রচিত নাছ বাট’
২. ‘সিংহদ্বার পূর্বে জলাশয়’
৩. ‘নানা চিত্রে ইট কাটে’
৪. ‘প্রতি বাড়ি কূপের সঞ্চয়’
সামাজিক অভিজ্ঞতার বড়ো প্রমাণ হিন্দু-মুসলমানের বাসগৃহ নির্মাণ বাংলাদেশের কোন জনপদে হিন্দুরা বিশেষত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বাস করে পূর্ব দিকে, মুসলমানরা পশ্চিমে, দেবালয় মধ্যস্থানে আর উত্তর দক্ষিণে নানা বসত হয়। গুজরাটেও তাই হয়েছে-
‘পশ্চিমে যবনালয় তুলিলেন সত্র সত্র
দলীজ মসিদ নানা ছন্দে।’
আর, ‘নগর চত্বর মাঝে শিবের মন্দির সাজে’
অন্যান্য নানা প্রসিদ্ধ প্রাসাদের গঠনের মতো মুকুন্দের বর্ণিত প্রাসাদেও ‘উত্তরে খিড়কি সিংহদ্বার পূর্বদেশে।’ এই বর্ণনার হুবহু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় কলকাতার রাজভবনের গঠন কাঠামোতেও। আর একটা ব্যাপার এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখ্য-বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরনো দিঘি বা সায়র বিস্তৃত উত্তর দক্ষিণে আর চওড়া পুবে-পশ্চিমে। বর্ধমান, বিষ্ণুপুরে এধরণের জলাশয় দেখা যায়। যেগুলি প্রায় সবই রাজকীর্তি। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে জলাশয়গুলির এরূপ উত্তর-দক্ষিণে বিস্তার কেন? যতদূর অনুমান পবিত্র নদী গঙ্গার প্রবাহের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেই এই জলাশয়গুলির উত্তর-দক্ষিণ অভিমুখে খনন করা। বর্ধমানের বিশাল দীঘি কৃষ্ণসায়রও এই নিদর্শনের সাক্ষী বহন করেছে।
এ তো গেল খোদ নগরের কথা। এবার দেখা যাক নাগরিক জীবনের ছবি এ কাব্যে কতটা উজ্জ্বল। চণ্ডীমঙ্গলের খণ্ড সংখ্যা দুটি- আখেটিক ও বণিক। আখেটিক খণ্ডে নায়ক কালকেতুর গ্রামজীবন থেকে নগরজীবনে উত্তরণ ঘটেছে। অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ ব্যাধ হয়েছে রাজা। আর বণিক খণ্ডে দেখা যায় বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নগর জীবনের ছবি। এই খণ্ডের নায়ক ধনপতি অন্ন সংস্থানের জন্য বস্ত্র নয়, পায়রা উড়িয়ে সময় কাটায়। আখেটিক খণ্ডে দেবী চণ্ডী কালকেতুকে ধন দিয়ে আরামে দিন কাটাতে দেয়নি। তাকে দিয়ে নগর নির্মাণ করিয়ে নাগরিক সমাজের প্রয়োজনে নানা জাতির বসতি ঘটিয়েছেন। রাজা কালকেতু সিংহাসনে বসে রাজকর্তব্য পালন করেছে। যে কর্তব্যে ছিল না কোন গ্রাম্য সংকীর্ণতা। ছিল কেবল উদার নাগরিক চেতনা। তাই হিন্দুদের নানা জাতি ও মুসলমানদের নিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক নব্য সমাজ গড়ে তুললেন কবি কালকেতুকে দিয়ে। দামিন্যার এক গ্রামীণ কবির এ এক মহৎ নাগরিক চেতনা। কালকেতুর গুজরাট শুধু যে রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল তাই নয়, ছিল ধর্মীয় ও বাণিজ্য কেন্দ্রও। এভাবে কবি মুকুন্দ গুজরাটে এক নাগরিক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলেন।
কবির এই নাগরিক মনস্কতার একটা বিশিষ্ট ছাপ আছে বণিকখণ্ডে খুল্লনার প্রেম ও দাম্পত্য জীবনে। মধ্যযুগের সমাজ ছিল পুরুষ প্রধান, নারীরা ছিল কেবল ভোগের সামগ্রী। কিন্তু মুকুন্দের নাগরিক মানসিকতা যেভাবে খুল্লনাকে ধনপতির আনন্দসঙ্গিনী রূপে গ্রহণ করার কথা কাব্যে ব্যক্ত করেছেন তা আমাদের বিস্মিত করে।
‘‘খুল্লনারে বলে সাধু আন প্রিয়া পালা।
তোমা সঙ্গে রসরঙ্গে গোঞাইব নিশা।’’
তেমনই আরও অবাক করে কাব্যে নারীর যৌন চেতনার স্পষ্ট প্রকাশ। দীর্ঘ প্রবাসের পর স্বামী বাড়ি এলে খুল্লনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে এই ভেবে সতীন লহনা তাকে ভয় দেখিয়েছে-
‘তুহু বালা খিনবলা নাহি জান রতিকলা
না জাইহ প্রভুর নিকটে।’
খুল্লনার প্রত্যুত্তর-
‘শুনগো লহনা দিদি প্রাণের বহিনি
রমণী রমণে মরে কোথাহ না শুনি।’
যৌনতা সম্পর্কিত খুল্লনার এই উক্তি কোন গ্রাম্য নারীর নয়, তা এক নাগরিকার। কালকেতু ফুল্লরার দাম্পত্য জীবন গ্রামীণ হলেও ধনপতি খুল্লনার দাম্পত্য জীবন খানিকটা ‘আরবান’।
মুকুন্দের কাব্যে নাগরিক পরিচয় পাই সতীন সমস্যার রূপায়ণ কবি যেভাবে ঘটিয়েছেন সেক্ষেত্রে। এ গ্রাম্য কবির কাজ নয়। টাকার মাপকাঠিতে সেখানকার বণিকরা খুল্লনার সতীত্ব নির্ধারণ করতে চাইলে ধনপতি সে বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করতে চায় ও ধনপতির কথা শুনে খুল্লনা তা নাকচ করে- ‘আজি ধন দিলে দিবে বৎসরে বৎসরে।’ মধ্যযুগে এক সুপ্রতিষ্ঠিত ধনী কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ যেমন অভাবনীয় তেমনি খুল্লনার ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতা তা যে সম্পূর্ণ কবির নাগরিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ যেন সেই নারী যে আপন ভাগ্যকে জয় করার ক্ষমতা রাখে।
দুই. ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল :
সম্ভবত হর-পার্বতীর দিকে লক্ষ্য রেখেই রবীন্দ্রনাথ গ্রাম্য সাহিত্য আলোচনায় অন্নদামঙ্গলকে টেনে এনেছেন। কিন্তু তার বিদ্যাসুন্দর তা তো গ্রাম্য নয়। সেটি সৌন্দর্যসম্ভাগের কাব্য যা নিঃসন্দেহে তার নাগরিক চেতনার ফল। এই নাগরিক চেতনা ভোগবাদী জীবনদর্শনে বিশ্বাসী যার মধ্যে রয়েছে রূপজ প্রেমের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ। বিদ্যাসুন্দরের প্রেমের সেই আকর্ষণ বিকর্ষণে সেই রূপজ প্রেমের লীলা। সে রূপ দেহকে ঘিরে লীলায়িত হয়েছে। তবে তা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দেহজ প্রেমের মতো অশ্লীল নয়। এই শরীরী সৌন্দর্যের একধরণের ‘আরবান’ কালচার ভারতচন্দ্রের এই ‘আরবান’ বৈশিষ্ট্যকে ভালোভাবে চিনেছিলেন এক বিশিষ্ট নাগরিক চেতনার লেখক প্রমথ চৌধুরী। তিনি তার লেখা ‘ভারতচন্দ্র’ প্রবন্ধে বলেছেন, “ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতার মধ্যে art আছে, অপরের আছে শুধু nature.” বিদ্যাসুন্দরের লেখক যদি সত্যিই গ্রাম্যই হতেন তাহলে প্রমথ চৌধুরীর মতো রুচিশীল নাগরিক তাকে কোনমতেই গ্রহণ করতে পারতেন না। ভারতচন্দ্র যে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার কবি ছিলেন তা সকলেরই জ্ঞাত। এই রাজসভা ছিল মূলত গ্রামীণ। গ্রাম্য মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল এখানে। ধনের প্রাচুর্য এখানে খানিকটা জৌলুস সৃষ্টি করলেও, চরিত্রগত দিক থেকে তা ‘আরবান’ নয়। তাহলে বিদ্যাসুন্দরের সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব হল? এর উত্তরে বলতে পারি তা বিদেশী জাতির সংস্পর্শ সঞ্জাত, আর তা হল ফরাসি। কারণ, তাঁর প্রথম যৌবন কাটে চন্দননগর অর্থাৎ ফরাসডাঙায়। প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কে ফরাসি জাতির যে বোধ ও তাদের যে জীবনযাপন তা তিনিও প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করেছিলেন। তাই প্রেমের যে শরীরী বিলাস তা বিদ্যাসুন্দরে এমন সজীব হয়ে উঠেছে। রোমান্টিকতা যে শুধু কল্পলোকের জিনিস নয় তার একটা বাস্তব উষ্ণতা আছে, তা ভারতচন্দ্র দেখিয়েছেন। এভাবেই তার নাগরিক সংস্কার গড়ে ওঠে। তাই পরে কৃষ্ণনগরে রাজসভায় গেলেও কবি মনে পূর্ব সংস্কার জমাট হয়েছিল। যার ফল ‘বিদ্যাসুন্দর’। আর ‘প্যারিসে ফরাসি জাতীয় গ্রন্থাগারে (বিব্লিওতেক নাসিওনাল)’ বিদ্যাসুন্দরের পুঁথির সংরক্ষণ দেখে বোঝা যায় ফরাসিদের কাছেও এর গুরুত্ব কিছু কম ছিল না।
অতএব দেখা গেল ভারতচন্দ্রের কবিসত্তায় প্রধাণত দুটো স্থান ক্রিয়াশীল- ১) কৃষ্ণনগর ২) চন্দননগর। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের তিনটি খণ্ডের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টিতে মানুষ ও দেবতার সহাবস্থান যা প্রধাণত কৃষ্ণনগরীয় সংস্কৃতির ফসল। আর দ্বিতীয় খণ্ডটি একটি স্বতন্ত্র্য কাব্য বিদ্যাসুন্দর ‘এটি চন্দননগরীয় ’ যা মূলত নাগরিক। এভাবেই ভারতচন্দ্রের হাতে গ্রাম্য সাহিত্যের নগরায়ণ ঘটেছে। এছাড়াও ‘অন্নদামঙ্গল’-এ ধর্মকেন্দ্রিক নগর হিসেবে কাশীর ছবি পাই এবং তার প্রতিস্পর্ধী হিসেবে ব্যাসকাশী প্রতিষ্ঠার বৃত্তান্তও গুরুত্ব সহকারে চিত্রিত হয়েছে।
তিন. বৃন্দাবনদাস রচিত চৈতন্যভাগবত :
বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে দেখা যায় চৈতন্যের বিদ্যাবিলাস ও ভক্তিবিলাসের দুটি ক্ষেত্র ছিল- একটি নবদ্বীপ, অন্যটি বঙ্গদেশ (অধুনা বাংলাদেশ)। নবদ্বীপ তার জন্মস্থান, বঙ্গদেশের শ্রীহট্ট তার পিতৃভূমি। চৈতন্যভাগবতের আদি খণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কবি নবদ্বীপ ও আদি খণ্ডের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বঙ্গদেশের নাগরিক জীবনের সুন্দর বর্ণনা করেছেন।
চৈতন্যের জন্মস্থান নবদ্বীপ তা তো বিখ্যাত হবেই তবে নবদ্বীপের ক্ষেত্রে আরও তিনটি কারণ ছিল – (১) রাজনৈতিক- সেকালে রাজধানী গৌড়ের প্রবেশদ্বার বা গেটওয়ে ছিল এটি। (২) অর্থনৈতিক- গঙ্গাতীরের বাণিজ্যকেন্দ্র (৩) শিক্ষাকেন্দ্র- বিদ্যাচর্চার মূল কেন্দ্র, সেকালের অক্সফোর্ড। কাজেই দেখা গেল কোন স্থানকে নগর আখ্যা দেওয়ার জন্য যে যে বৈশিষ্ট্য কাম্য তা নবদ্বীপের ক্ষেত্রে পুরোটাই বর্তমান। বিশেষত শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে নবদ্বীপ সে সময় যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। অন্য কোনদিক বিচার না করে শুধুমাত্র সেই কারণটি বিশ্লেষণ করলে ও নবদ্বীপের নাগরিকতা বুঝতে বিশেষ কোন অসুবিধা হয় না। তাই আমরা প্রথমেই বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসাবে নবদ্বীপের গুরুত্ব কতটা ছিল তা বিবেচনা করে দেখি।
নবদ্বীপে বিদ্যাচর্চা প্রসঙ্গে বৃন্দাবন দাস লিখেছেন- ‘‘চতুর্দিগে হৈতে লোক নবদ্বীপে যায়।
নবদ্বীপে পড়িলে সে বিদ্যারস পায়।।’’
এই নবদ্বীপে চৈতন্যের বিদ্যাবিলাস এক উজ্জ্বল কীর্তি। যেমন- বিদ্যার্জন, তেমনই অধ্যাপনা। পড়া ও পড়ানোতেই তিনি ব্যস্ত থাকতেন। মুরারি গুপ্ত চৈতন্যের বিদ্যাবিলাস দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন- ‘এতাদৃশ পাণ্ডিত্য কি মানুষের হয়।’ ব্যাকরণ শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য তাকে অভিভূত করে।
গঙ্গাদাসের মতে তার টোলের ‘সর্বশিষ্য শ্রেষ্ঠ’ ছাত্র নিমাই মাত্র ষোল বছর বয়সে নবদ্বীপে পণ্ডিত হিসাবে খ্যাত হন এবং নিজেই টোল খুলে অধ্যাপনা শুরু করেন। ব্যকরণ ও অলংকার তার প্রিয় বিষয় হলেও তিনি একেবারে নীরস ‘ব্যাকরণিয়া’/ বৈয়াকরণ ছিলেন না। সুগায়ক মুকুন্দ ছিল তার বিদ্যাচর্চার সঙ্গী। যার বৃতান্ত বৃন্দাবনদাস তার চৈতন্যভাগবতে দিয়েছেন।
এরপর নবদ্বীপে নিমাই গদাধর পণ্ডিতের সঙ্গে ন্যায় শাস্ত্র বিচারে প্রবৃত্ত হন। যা নবদ্বীপে সাড়া ফেলে দেয়।
‘মনুষ্যের এমত পাণ্ডিত্য আছে কোথা,
হেন শাস্ত্র নাহিক অভ্যাস নাহি যথা।। ’
নবদ্বীপে অধ্যাপক রূপে নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি তাঁকে অসাধারণত্বে উন্নীত করল। দিকে দিকে এই মহিমা প্রচারিত হওয়ায় নবদ্বীপে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র সমাগম হতে থাকে। নিমাই বিষয়, সংশয়, পূর্বপক্ষ, সিদ্ধান্ত ও সঙ্গতি- এই পাঁচটি ন্যায়ক্রম ধরে অধ্যাপনা করতেন, বৃন্দাবন দাসের কথায়-
কেহ বলে এত তেজ মনুষ্যে নয়।
কেহ বলে এ ব্রাহ্মণ বিষ্ণু অংশ হয়।।
কেহ বলে বিপ্র রাজা হইবেক গৌড়ে।
সেই বুঝি এই হেন কখন না নড়ে।।
এইভাবে তার বিদ্যাচর্চা সর্বত্র পূজিত হয় আর বিদ্যাচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে নবদ্বীপ অন্যতম নগরে পরিণত হয়।
এছাড়া আরও কিছু ঘটনা নবদ্বীপের নাগরিক বৈশিষ্ট্যকে সহজেই আমাদের সামনে তুলে ধরে। যেমন- (১) জাতপাতের গণ্ডী ভেঙে সকলকে এক জায়গায় আনা। নবদ্বীপে সেই সময় চলছিল সুলতান হোসেন শাহের শাসন। ফলে মুসলমানদের অত্যাচারও সেখানে চলছিল প্রবলভাবে। তারা বহু হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মান্তরিতও করেছিলেন। এছাড়া ছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের আধিপত্য। যাদের প্রভাবে সমাজে এক শ্রেণির মানুষ অন্ত্যজ পর্যায়ে পৌঁছালো। জাতিভেদের এই কলুষময় পরিবেশেই আবির্ভাব ঘটল চৈতন্যের। চৈতন্যভাগবতে আমরা দেখতে পাই চৈতন্য সংকল্প করেছিলেন যে, স্ত্রী, শূদ্র, মূর্খ আদি চণ্ডালে প্রেমভক্তি দান করে তিনি তাদের উন্নত করবেন ও তার এই প্রচেষ্টায় সমাজে সব জাতপাতের গণ্ডী ভেঙে গিয়েছিল। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজন ইসলামের বিপরীতে দাঁড়াল বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে। যে বৈষ্ণবধর্মে মানুষ সবার ওপরে। এ যেন এক নতুন সমাজ বিপ্লব। এই সর্বধর্ম সমন্বয়ের যে চিত্র বৃন্দাবনদাস এঁকেছেন তা যেন আমাদের আধুনিক কালের বিবেকানন্দের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
(২) যে যুগে পণপ্রথা সমাজে কন্যা বিবাহের একটা অঙ্গ ছিল সেই সময় নিমাই স্বনির্বাচিত পাত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিয়ে করেছিলেন বিনা পণে। লক্ষ্মীপ্রিয়ার দরিদ্র পিতা বল্লভাচার্য বলেছেন-
‘সবে এক বচন বলিতে লজ্জা পাই,
আমি সে নির্ধন কিছু দিতে শক্তি নাই।’
তবে একথা বলার কোন প্রয়োজন-ই তার ছিল না, কারণ নিমাই ও তার পরিবারবর্গ কোন পণই দাবী করেননি। দরিদ্র বল্লভাচার্য পাঁচটি হরিতকি দিয়ে কন্যাকে দান করেন। কোন পণ ব্যতীত যে বিয়ে নিমাই সে সময় নবদ্বীপে করেছিল তা সেই সময় সেখানকার উন্নত নাগরিক সমাজেরই পরিচয় বহন করে।
এরপর আসি বঙ্গদেশ প্রসঙ্গে। নবদ্বীপে চৈতন্যের জীবন কাটছিল বিদ্যাবিলাস ও গার্হস্থ্য ধর্মে। তবে হঠাৎই ‘বঙ্গদেশে মহাপ্রভু করিলা প্রবেশ।’ এবং তার আগমনবার্তা চারিদিকে রটে গেল। ‘অধ্যাপক শিরোমণি’ নিমাই এর ছাত্র হবার ইচ্ছা অনেকরই ছিল তাই তারা আবেদন করল-
‘সবে এক নিবেদন করিয়ে তোমারে।
বিদ্যা দান কর কিছু আমা সবাকারে।।’
চৈতন্য তাদের ফেরাতে না পেরে সেখানেও সকলকে বিদ্যাদান করতে লাগলেন। বিদ্যাচর্চার জোয়ারে ভাসল বঙ্গদেশ, (অধুনা বাংলাদেশ) ফল-নানা জায়গা থেকে সেখানে প্রচুর ছাত্রের সমাগম। ফলে নাগরিক বৈশিষ্ট্যের যে অন্যতম শর্ত বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র, সেই হিসাবে বঙ্গদেশও মর্যাদা পেল সে সময়ের অন্যতম নগর হিসাবে।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অপ্রধান কয়েকটি নগর, নাগরিক বৈশিষ্ট্য-
এক. চর্যাপদ:
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ। এই চর্যাপদের রচয়িতারা ডোম্বী, কামলি, শবর প্রমুখ অন্ত্যজ শ্রেণির ব্যক্তি এবং চর্যাগীতির পাত্রপাত্রীরাও ডোমল, চণ্ডালি, শুন্ডিল, শবরী প্রভৃতি অস্পৃশ্য শ্রেণিভুক্ত। তাদের বাসস্থান ছিল নগরের বাইরে, নগরের প্রাণকেন্দ্র থেকে বহুদূরে জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের গুহায়, মালভূমির ওপর। ফলে নগর জীবনের চিত্র চর্যাপদে একেবারেই অনুপস্থিত। সমাজের অভিজাত উচ্চবর্ণীয়েরা বাস করত নগরে ও তারা যে নিম্নবর্ণীয়দের সম্পর্কে এক ধরণের শুচিবায়ুগ্রস্ত জুগুপ্সা পোষণ করতেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কাহ্নপাদের একটি চর্যায়-
‘নগর বাহিরে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ সো ব্রহ্মনাড়িআ।।’ (চর্যা – ১০)
সুতরাং দেখা গেল যারা এই চর্যাপদগুলির প্রধান চরিত্র তাদের যেহেতু নগরের মধ্যে কোন স্থান নেই, তাই এখানে নগর ও নগরজীবনের চিত্র অধরাই থেকেছে।
দুই. বড়ু চণ্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন:
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে প্রধাণত দুটি নগরের উল্লেখ আছে- ১) মথুরা ২) বৃন্দাবন৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বৃন্দাবন খণ্ড, যমুনা খণ্ডে বৃন্দাবন নগরের কথা থাকলেও কাব্যটি মূল কাহিনী আবর্তিত হয় মথুরা নগরকে কেন্দ্র করে। কাব্যে দেখা যায় মথুরা ছিল সে-যুগের প্রধাণ বাণিজ্যকেন্দ্র। রাধা বড়াই-এর সঙ্গে প্রতিদিনই সেই মথুরার হাটে যেত দুধ দই বিক্রি করতে।-
‘দধি দুঁধে পসরা সজাআঁ। নেহ বাস ও হাড়নদিআঁ।। ল রাধা
সব সখিজন মেলি রঙ্গে। এক চিত্তে বড়ায়ির সঙ্গে।। ল রাধা
নিতি জাত্র সর্বাঙ্গ সুন্দরী। বনপথে মথুরা নগরী।। ল রাধা।।’
একদিন যাওয়ায় পথে রাধা পথ হারিয়ে বড়াই-এর সঙ্গছাড়া হলে বড়াই-এর সঙ্গে কৃষ্ণের দেখা হয় ও কৃষ্ণের কাছে সে রাধাকে খুঁজে পাবার জন্য রাধার রূপ বর্ণনা করে যা শুনে কৃষ্ণ রাধার প্রেমে পড়ে আর এরপর রাধার নিত্যদিন মথুরার হাটে যাওয়াকে কেন্দ্র করে এ কাব্যের ঘটনা। কোন বিশেষ অঞ্চলে কোন বিশেষ জায়গা বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি পেলে তাকে নগর আখ্যা দেওয়া যায়, সেই দিক থেকে মথুরা সে অঞ্চলের একটি বিশেষ নগর হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত। তবে বৃন্দাবনের উল্লেখ থাকলেও সেখানকার নাগরিক জীবনের কোন চিত্র এখানে নেই।
তিন. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল:
মনসামঙ্গল কাব্যে আমরা বেশ কয়েকটি নগরের উল্লেখ পাই। যেমন-
১) দেবী মনসা মনুষ্য সমাজে প্রথম পূজা প্রচার করতে যায় গোয়ালা সমাজে, চম্পক নগরীতে।
২) মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র চাঁদ সদাগর বণিক হল চাম্পাই নগরের।
৩) চাঁদ সদাগরের সপ্তমপুত্র লখিন্দরের বিয়ে হয় নিছনি নগরে সায় অধিকারির কন্যা বেহুলার সঙ্গে।
কাজেই আমরা এখানে তিনটে নগরীর উল্লেখ পেলাম। তবে এ প্রসঙ্গে যে কথাটা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য তা হল, এই তিনটি নগরী-ই কাল্পনিক, কবি কল্পিত। বাস্তবে এদের কোন ভৌগোলিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে কাব্যে আরও কয়েকটি জায়গার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন- মথুরা, বর্ধমান, ত্রিবেণী ইত্যাদি। এই জায়গাগুলি অবশ্য আমাদের সকলেরই পরিচিত। কাল্পনিক ও বাস্তব বিভিন্ন নগরের উল্লেখ মনসামঙ্গলে থাকলেও নাগরিক জীবনের কোন চিত্র পাওয়া যায় না এখানে।
চার. অনুবাদ সাহিত্যঃ (রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণবিজয়)
কৃত্তিবাসী রামায়ণে অযোধ্যা, কাশীরাম দাস অনূদিত হস্তিনাপুর, মিথিলা, মালাধর বসুর অনূদিত শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে বৃন্দাবন, মথুরা প্রভৃতি নগরের উল্লেখ পাই। তবে আমাদের বাঙালি কবিরা এই সমস্ত নগরের যেভাবে বর্ণানা দিয়েছেন তাতে সেগুলিকে মহাকাব্যের কোন নগর বলে মনে হয় না। মনে হয় তা যেন আমাদের অতি পরিচিত বাংলাদেশের নগর ও নাগরিক জীবনেরই চেনা ছবি।
পাঁচ. বৈষ্ণব পদাবলী
বৈষ্ণব পদাবলীতে নগর বা নাগরিক জীবনের ছবি তেমনভাবে পাওয়া যায় না। তবে ‘মাথুর’ পর্যায়ের পদাবলীগান এই মথুরা প্রবাসকে কেন্দ্র করেই রচিত। ‘মাথুর’ এবং ‘ভাবসম্মিলন’-এর কয়েকটি পদে ‘মথুরা’ নগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন- ‘অব মথুরাপুর মাধব গেল / গোকুল মাণিক কো হরি নেল’ কিংবা ‘দুখিনীর দিন দুখেতে গেল। / মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল।’
শেষকথা
সাহিত্যে নগর বা নাগরিক জীবনের প্রতিফলন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের খুবই চেনা এক ছক। আর প্রাগাধুনিক যুগের সাহিত্য মানেই আমাদের ধারণা গ্রাম্যজীবন ও গ্রামীণ সংস্কৃতি তার মেরুদণ্ড। কিন্তু উপরিউক্ত আলোচনা প্রাগাধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের এই বস্তাপচা ধারণার পরিবর্তন ঘটায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, জীবনীকাব্য, পদাবলী সাহিত্য প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে নগর ও তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত জীবনের ছবি নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে তা সত্যিই আমাদের বিস্মিত করে। বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা কিংবা তিলোত্তমা কলকাতার বিজ্ঞাপনী মোহমায়া হয়তো আমরা প্রাগাধুনিক সাহিত্যে পাই না, তথাপি গ্রামজীবনের পাশে সেকালের নাগরিক জীবনের ছবি স্বতন্ত্র আস্বাদ এনে দেয়। সেসব শহর মেট্রো সিটি বা টাউনশিপের জৌলুসে চোখ ধাঁধায় না, কিন্তু নাগরিক চাতুর্য, জটিলতা এবং রাজনীতির আবর্ত থেকে যে মানবজীবন সেকালেও মুক্ত ছিল না, সেকথা আমরা আজকের দিনেও বুঝে নিতে পারি।।
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকাপঞ্জি
গ্রন্থ
১) অরবিন্দ পোদ্দার। মানবধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ। পুস্তক বিপণি, ১৯৯৪।
২) আশুতোষ ভট্টাচার্য । বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস। এ মুখার্জি এবং সপ্তর্ষি। মে ২০১৫।
৩) ক্ষুদিরাম দাস । বৈষ্ণব রসপ্রকাশ। প্রথম দে’জ সং ২০০৯।
৪) গীতা চট্টোপাধ্যায়। ভাগবত ও বাংলা সাহিত্য। ঋক্ প্রকাশন, দ্বিতীয় সং ১৪০১।
৫) নির্মল দাস সম্পাদিত । চর্যাগীতি পরিক্রমা। দে’জ, সপ্তম সং ২০১০।
৬) বিমলাকান্ত মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত। কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃত শ্রীশ্রী চৈতন্যচরিতামৃত। প্রজ্ঞাবিকাশ, মার্চ ২০০৩।
৭) সত্য গিরি সম্পাদিত ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ । রত্নাবলী, ২০০৩।
৮) সনৎকুমার নস্কর সম্পাদিত । কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’। প্রজ্ঞা বিকাশ, দ্বিতীয় সং ২০১৫।
৯) ঐ সম্পাদিত । কবিকঙ্কণ-চণ্ডী । রত্নাবলী, তৃতীয় সং ২০১০।
১০) রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘চৈতন্যভাগবত’। সাহিত্য সঙ্গী, তৃতীয় প্রকাশ, ২০১০।
পত্রিকা
১) দীপঙ্কর মল্লিক সম্পাদিত ‘এবং একলব্য : সময়ের সংলাপ’। মঙ্গলকাব্য বিশেষ সংখ্যা। অক্টোবর, ২০১৫।
২) সত্যবতী গিরি এবং সনৎকুমার নস্কর সম্পাদিত ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য গবেষণা পত্রিকা’। প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। ২০০২।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন