বুধবার, ১ জুন, ২০২২

তরুণ মুখোপাধ্যায়-এর প্রবন্ধ

অন্তরের খুদ : জ্যোৎস্না পেতে রেখেছি উঠানে

পেশা শিক্ষকতা রক্তে কবিতা যদিও নিভৃত সাধনা পছন্দ করেন তাই তাঁর ২০০০  ২০০৩- প্রকাশিত দুটি কাব্যগ্রন্থের কথা (যথাক্রমে 'উড়াল  পিঞ্জরএবং 'ভস্মজন্ম') অনেকেই জানেন না জানতাম না আমিও তাঁর স্বামী বিশিষ্ট জীবনানন্দ-গবেষক গৌতম মিত্র সম্ভবত স্বামীর খ্যাতি আর প্রচারের আড়ালে থেকে গেছেন তাঁর নাম শাশ্বতী মিত্র ২০১৯  বেরিয়েছে তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'অন্তরের খুদ' (ঋত প্রকাশনী) সাড়ে তিন ফর্মার বই তবু প্রকাশক আশি টাকা দাম রেখেছেন

 

শাশ্বতী মিত্রের 'অন্তরের খুদকাব্যের তিনটি পর্ব – যামিনী বিন্যাস ; চোখের আকাশ ; তিনটি ঘুঁটির ঘোর কটাক্ষ প্রথম দুটি পর্বের কবিতাগুলি শিরোনামহীনসংখ্যাচিহ্নিত এবং মিতায়তন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'ছিন্নবিচ্ছিন্ন', শঙ্খ ঘোষের 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দএবং ভাস্কর চক্রবর্তীর 'জিরাফের ভাষাকাব্যগ্রন্থের ছাঁদ মনে পড়ে

 

কাব্যগ্রন্থের নামকরণে ‘বিদুরের খুদএমন পুরাণের অনুষঙ্গ মনে আসে সামান্য কিন্তু অসামান্য – ধূলিমুঠি আসলে সোনামুঠি এই তাৎপর্য পাঠক ভাবতেই পারেন তৃতীয় পর্বে ‘বিবাহ’ নামাঙ্কিত কবিতায় পড়ি:

 

'দাউদাউ অগ্নিতে সানাইয়ের সুর

নিমন্ত্রন পাতে পড়ে অন্তরের খুদ

সে খুদ যেমন হোক রুচিকর হয়'

 

এক শ্যমাঙ্গী যুবতীর বিবাহ বর্ণিত হয়েছে সেখানে ‘চন্দ্রমার ডালায় হবে  বধূবরণ ’ ; অথচ ‘রহস্যে বাসর ’, আর ‘নশ্বরে বারি ঝরে বিবাহ আড়ালে ’ এই জল অশ্রুই বিবাহের আপাত মাধুর্য কত নশ্বর বোঝা যায় সানাইয়ের সুরে দাউদাউ আগুনের ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘বধূকবিতার চকিতে মনে উঁকি দেয় – সবার মাঝে ফিরি একেলা সকলকে নববধূ আপন করতে চায়  অন্তরের খুদে তাদের মনের খিদে দূর করতে চায় – পারে না কবি শাশ্বতী মিত্রও ভাবেন তাঁর কবিতাগুলি সেই  'অন্তরের খুদ’, তা কোনো বেদরদীর জন্য নয়

মহিলা কবিশব্দবন্ধে নারীবাদীরা আপত্তি জানান  আমার মনে হয়এতটা স্পর্শকাতরতা ঠিক নয়  ‘পুরুষ কবিবললেই সমতা আসবে এও যথাযথ যুক্তি নয়  তাছাড়া মেয়েরা যখন কবিতা লেখে তার ভিতরে তাদের নিজস্বতানারীসত্তার প্রভাব থাকে  যা কখনো কোনো পুরুষের লেখায় পাওয়া সম্ভব নয়  তাই মহিলা-কবি বলা অশ্রদ্ধেয় হতে পারে না  বরং এইভাবে বলা  দেখার মধ্যে সেই কবির সিগনেচার খুঁজে পাওয়া যায় 

 

আমার সীমিত জানা  পড়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছিমহিলা কবিরা (উনিশ শতক বাদেএকালে প্রেম  যৌনতাকে গুরুত্ব দেন  পুরুষ কবির লেখায় যেহেতু অবাধ যৌনসম্ভোগের ছবি আঁকা হয়তাঁরাও প্রতিস্পর্ধায় আরও খোলাখুলি লিখে দুঃসাহসিকা হন  আরেকদল মহিলা কবির বিষয় পুরুষ আধিপত্যযৌনলাঞ্ছনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ  নানাভাবে তাঁরা বুঝিয়ে দেন সমাজে  সংসারে নারী নিপীড়নের শিকার  আসামী পুরুষ – স্বামী বা প্রেমিক  কবিতার ছন্দআঙ্গিক নিয়ে কমই ভাবতে দেখা যায়  শাশ্বতী মিত্র এঁদের থেকে ব্যতিক্রম  তাঁর কবিতায় প্রেম  যৌনতা এতই গোপনআড়াল এত বেশিতাঁর বক্তব্য সর্বদা অনুধাবন করা বেশ কষ্টকর  একালে যে পোষ্টমডার্নিজমের চর্চা চলেছেতাও দেখি তাঁর কবিতায় ছায়া ফেলেছে  ব্যক্তিগত অথচ নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে তিনি তাঁর কথা বলেন  সরাসরি পাঠকের সমবেদনাসহমর্মিতা দাবি করেন না  সংকেতময়তা তাঁর কবিতায় প্রতীকী ব্যঞ্জনা আনে।

 

১। জানো তো ছায়া পেলে চারাগাছ

 জন্মান্তরের বিহ্বল স্বপ্ন দেখে ফেলে 

 

২। এক একটি প্রদীপ ভাসাই

 প্লুতস্বরে জল ডেকে যায় 

 

৩। হেমন্তের বিকেলে কেউ ডাকলে

 তাকে বড়ো গাছ মনে হয় 

 

৪। স্বপ্ন  প্রদীপের কথা তোমাকে বলিনি

 কক্ষে তো রজনী আরব্য হয়ে যায় I 

পাঠকআরব্যরজনী বিপর্যাসে এক নতুন দ্যোতনা লক্ষ্য করুন দ্বিতীয় পর্বে গুরুত্ব পেয়েছে চোখ শুধু চোখ নিয়ে এত ভাবনা, এত আবেগ, এত বিন্যাসআগে কোথাও পড়িনি অথ দৃষ্টান্ত:

 

১। চোখ আজ প্রাজ্ঞ আকাশ

২। আলো চোখ নিত্য পান্থশালা

৩। চোখ দেখবে চোখের আকাশ

৪। চোখ আঁকে বিরহ প্রস্তাব

৫। চোখ খোঁজে অতৃপ্ত কথা

৬। শব্দস্পর্শে চোখ অভিধান

৭। চোখ আমার চন্দ্র অভিমানী

 

কবি অরুকুমার সরকার বেঁচে থাকলে নিশ্চয় বলতেন – ‘ দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের পাব কি পরশ যৎসামান্য’ ?

 

তৃতীয় পর্বে  ‘ডোম্বিনী' কবিতা চর্যাপদাশ্রিত যে- চর্যাগানে হরিণা আপন মাংসে বৈরী সেখানে নোনা ভালোবাসা মুছে দিয়ে কবি লেখেনশবর দেখে সকলেই জ্যোৎস্নার মায়া ’; তাইডোম্বিনীর নুন আজ মাংসহীন থাক প্রেমে-বিরহে শিহরিত কবিতামৌদুপুর শেষ পঙক্তিতে পড়ি  ‘নিভন্ত আজ মৌদুপুরের আলো

 

তবে শাশ্বতীর কবিতার আলো নিভন্ত নয় কাব্যরসিকদের জন্য কবি বলেন – ‘জ্যোৎস্না পেতে রেখেছি উঠানে’  (মশারি)পাঠক হিসেবে আমরাও তাঁর কবিতার উঠানে বার বার ফিরে আসতে চাই।





 

1 টি মন্তব্য:

  1. আবদুর রাজ্জাক: সুন্দর বিশ্লেষণ, ভালো লাগলো। সত্যিই চোখ বিন্যাস আগে পড়িনি ।

    উত্তরমুছুন