নারীর মধ্যে অসামান্য মানসিক বলের সম্ভাবনা কবি দেখিয়েছেন। চিত্রাঙ্গদার কথা বহু আলোচনায় উঠে এসেছে বহুবার, কিন্তু আমার মনে হয় যে তাঁকে পেরিয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের অন্য এক নারীচরিত্র যাঁকে নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা হয়েছে। বৃহত্তর কর্মজগতে না এসেও এক নারী মহীয়সী রূপে দেখা দেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্যে। তিনি গান্ধারী। তাঁর মধ্যে যে নারীকে কবি এঁকেছেন তিনি অনন্যা। অসামান্য ধীশক্তি, মনন ও ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ-বোধ নিয়ে তিনি কেবল নারী হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করেন। বঙ্কিমচন্দ্র বা শরৎচন্দ্রের কল্পনায় এমন নারীর অস্তিত্ব ছিল না কোনোদিন। বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ নারী দেবী চৌধুরানী পাপিষ্ঠ শ্বশুর এবং মেরুদন্ডহীন স্বামীকে বিনা বিচারে পূজ্য বলে মেনে নেয়। শরৎচন্দ্রের কাছে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠেন অন্নদাদিদি যিনি খুনী স্বামীকে বাঁচানোর জন্য গৃহত্যাগ করেন এবং নির্বিচারে তাঁর অত্যাচার সহ্য করেন। পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা অনুসারে এমন নারীরাই পুরুষশাসিত সমাজে মহীয়সী বলে সমাদৃত। স্বামীসেবা, স্বামীর প্রতি আনুগত্যই নারীর কাছে প্রার্থনীয়, তাতেই তিনি মহিমান্বিত হন। তাঁর নিজস্ব ধর্মবোধ, যা পুরুষের অন্যায়ের সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না, তা নারীর কাছে সমাজ চায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গান্ধারীর মধ্যে এমন নারীকে দেখালেন যিনি কোনোভাবে, কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে রাজি নন। যাঁর ন্যায়বোধ স্বামী-পুত্রকে অবলম্বন করে প্রকাশিত নয়, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে এক উচ্চতর নীতিবোধে অনুপ্রাণিত। এই নারীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সেই পুরোনো ধারণা, যে নারীর মধ্যে হৃদয়বৃত্তিই বড়, চিত্তবৃত্তি নয়, সেটা আর সত্য হয়ে ওঠে না।
‘পঞ্চভূত’ গ্রন্থের ‘অখন্ডতা’ নামক রচনায় রবীন্দ্রনাথ নারী সম্বন্ধে বহুল প্রচলিত একটি ধারণার পুনরাবৃত্তি করেনঃ
‘প্রকৃতির ন্যায় রমণীর ও কেবল ইচ্ছাশক্তি, তাহার মধ্যে যুক্তি, তর্ক, বিচার-আলোচনা কেন কী বৃত্তান্ত নাই’।
আমরা অবাক হয়ে দেখি যে গান্ধারীর চরিত্র রচনা করে কবি নারীচরিত্র সম্বন্ধে নিজের এই মতকেই যেন খন্ডন করেছেন। লক্ষ্যণীয় এই যে এই কাব্যনাট্যের কথোপকথন সম্পূর্ণ কাল্পনিক। মহাভারত থেকে চরিত্রগুলি এবং ঘটনা সমাবেশ নেওয়া হলেও গান্ধারীর মুখে যেসব কথা কবি উপস্থাপন করেছেন তা মহাভারতের শ্লোকের অনুবাদ নয় কোনোমতেই। দ্যুতক্রীড়ায় পরাজিত পান্ডবেরা যখন বনবাসে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন সেইসময় গান্ধারীর মনোভাব, এবং তাঁর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডবগণ ও দুর্যোধনের মহিষী ভানুমতীর কথোপকথন এই কাব্যনাট্যের বিষয়বস্তু। কবি এখানে পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে গান্ধারীর ন্যায়বোধ এবং দুর্যোধনকে অন্যায় থেকে বিরত করার প্রচেষ্টার কথা মনে রেখে গান্ধারীকে এক অসামান্যা নারী হিসাবে উপস্থাপনা করেছেন। ভারতীয় ধারণায় নারীর কোনো নিজস্ব ধর্মবোধ থাকবার কথা নয়, তার একমাত্র ধর্ম স্বামীর ধর্মে সঙ্গিনী হওয়া। কিন্তু এই কাব্যনাট্যের গান্ধারী নারী সম্বন্ধে সব প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিতেই যেন এসেছেন।
কাব্যনাট্যের শুরুতে দুর্যোধন আর ধৃতরাষ্ট্রের কথোপকথন। এখানে দুর্যোধন তার অধর্ম-আচরণের স্বপক্ষে পিতার কাছে নানা যুক্তি দেন। ধৃতরাষ্ট্র সেগুলো মানতে পারেন না, কিন্তু তিনি নিজেই বোঝেন যে তিনি স্নেহে অন্ধ, পুত্রকে শাসন করবার ক্ষমতা তাঁর নেই। প্রতিহারী এসে গান্ধারীর আগমনসংবাদ দিতেই দুর্যোধন পালানোর পথ দেখেন, আর তাঁর দুর্বল পিতা বলেন,
করো পলায়ন। হায়, কেমনে বা সবে
সাধ্বী জননীর দৃষ্টি সমুদ্যত বাজ
ওরে পুণ্যভীত! মোরে তোর নাহি লাজ।
আমরা একটু যদি বাংলা উপন্যাসের মাতৃভাবনার দিকে তাকাই তবে দ্গৃতরাষ্ট্রের এই প্রথম কথাগুলোতেই এক বিপরীতমুখী ভাবনার প্রকাশ দেখতে পাই। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে কোনো মায়ের চরিত্রের বিশেষ ভূমিকা নেই। প্রফুল্লের সন্তানপালন উপন্যাসের বাইরে থেকে গেছে, ভ্রমর, সূর্যমুখী ঔপন্যাসিকের মতে অসামান্যা নারী, কিন্তু তাঁদের সন্তান নেই। শান্তি, শ্রী, মনোরমা, কারোরই সন্তান নেই। এছাড়া বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ নারীকুল এত গভীরভাবে স্বামীর অনুবর্তিনী যে স্বামীর মতামতই তাঁদের কাছে শ্রেয়তম। তাঁদের কাছে গান্ধারীর ন্যায়নিষ্ঠা বা দৃঢ়তা আশা করা যায় না। তাঁদের সন্তান জানবে পিতা হি পরমন্তপঃ। মাকে দেখে কারও সন্তান পালাবে এমন কথা বোধহয় ভাবা যায় না। মাতৃমূর্তি নিয়ে ভাবিত ছিলেন শরৎচন্দ্র। কিন্তু তাঁর মায়েরা সন্তানকে কেবল স্নেহ দেন, তাদের ন্যায়নীতি শিক্ষা দেন না। মা আসছেন বলে সন্তান তাঁর রোষের ভয়ে স্থানত্যাগ করবে এ তো শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে কল্পনা করা যায় না! কিন্তু গান্ধারীর পৌরাণিক চরিত্র রবীন্দ্রনাথের মনকে স্পর্শ করেছিল। কবির কল্পনাকে প্রভাবিত করেছিল মায়ের সেই রৌদ্ররূপের ভাবনা, যে মূর্তি কেবল স্নেহ দেয় না, সৎপথে, ধর্মের পথে চালনা করে। ভাবতে অবাক লাগে যে আমাদের পৌরাণিক কাহিনিতে এবং ধর্মভাবনায় মায়ের এই রুদ্ররূপের চিন্তা খুব বেশি করেই আছে, এবং মায়ে করালরূপ বিশেষ করে বাংলা শ্যামাসঙ্গীতের প্রভাবে বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং পরিচিত। শক্তির উপাসকদের কাছে চিরদিনই অপরাধী সন্তানের দন্ডবিধায়ক হিসাবে কালীর রুদ্ররূপের চিন্তা। তবু যে কেন বাংলা সাহিত্যে কড়া ন্যায়বাদী এমন মায়ের কথা এত কম যিনি কেবল স্নেহ দেন না, শাসনও করেন, এটা বোঝা বেশ কঠিন।
রবীন্দ্রসাহিত্যে মা নানা সাজে, নানা রূপে আসেন। উপন্যাস বা ছোটগল্পের কথায় পরে আসব, আপাততঃ আমরা এক মাকে দেখেছি অমাবাঈয়ের মধ্যে। তিনি মাতৃরূপে পিশাচিনী। সন্তানের রক্ত পান করে তিনি ধর্মলিপ্সা, যশোলিপ্সা মেটান। তাঁর মধ্যে স্নেহের স্থান নেয় অন্ধ সংস্কার আর স্বার্থবোধ। মল্লিকার অশিক্ষা আর ধর্মান্ধতা তার সন্তানের মৃত্যু ডেকে আনে। সন্তানকে রক্ষয়িত্রী হিসাবে তিনি সম্পূর্ণরূপে অসার্থক। মায়ের পূর্ণ কল্যাণরূপ আমরা দেখি গান্ধারীর মধ্যে। সন্তান পাপের পথে চলছে দেখে তিনি চঞ্চল হয়ে ওঠেন তারই মঙ্গলকামনায়। স্বামীকে তিনি বলেন,
অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি
আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি
সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে;
কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।
ছললব্ধ পাপস্ফীত রাজ্যধনজনে
ফেলে রাখি সেও চলে যাক নির্বাসনে,
সন্তানকে ত্যাগ করবেন, এমন মনোবল ধৃতরাষ্ট্রের নেই, তিনি তাই বলেন যে তিনি তো পিতা, কেমন করে সন্তানকে ত্যাগ করবেন? কিন্তু প্রথমেই তো গান্ধারী তাঁর মাতৃহৃদয়ের গোপন আকুলতার কথা প্রকাশ করেন, কবি দেখান যে তিনি ধর্মপথে চলেন, তাই সবলে আপন স্নেহকেই শাসন করেন, কিন্তু মাতৃস্নেহ তাঁর কম নয়,
মাতা আমি নহি? গর্ভভারজর্জরিতা
জাগ্রত হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?
স্নেহবিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি
তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?
শাখাবন্ধে ফল যথা সেইমত করি
বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি
দুই ক্ষুদ্র বহুবৃন্ত দিয়ে-- লয়ে টানি
মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী,
প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি, মহারাজ,
সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ।
এখানেই অমাবাঈয়ের সঙ্গে গান্ধারীর প্রভেদ। অমাবাঈয়ের মধ্যে নারীসুলভ স্নেহ, প্রেমের অভাব। স্বামীর প্রতি যে নিষ্ঠা সতীত্বের সবচেয়ে বড় দাবি, সেই নিষ্ঠার একান্ত অভাব তাঁর মধ্যে। অমাবাঈ গান্ধারীর মতো ধর্মপথে চলেন না, চলেন সামাজিক রীতির অন্ধ পোষণের পথে, স্বার্থবোধে অন্ধ হয়ে স্বামী এবং কন্যার বিরুদ্ধাচরণের পথে।
গান্ধারীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে বিচারের ক্ষমতা ও গভীর চিন্তার বল দেখিয়েছেন, তা তাঁর মেয়েদের হৃদয়বৃত্তির প্রাবল্য সম্বন্ধে সব মন্তব্যের বিরুদ্ধে গিয়ে এক অসামান্যা অথচ পূর্ণহৃদয়ের সম্পদে ধনী সম্পূর্ণ নারীর চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরে। ধৃতরাষ্ট্র নিজের দ্বিধার কথা বলেন, ধর্মবোধ সম্পূর্ণ লুপ্ত না হলেও তিনি ভবিষ্যৎ ভেবে পান্ডবকে রাজ্যদান করতে চান নি,
অপমানক্ষত
রাজ্য ফিরে দিলে তবু মিলাবে না আর
পাণ্ডবের মনে-- শুধু নব কাষ্ঠভার
হুতাশনে দান। অপমানিতের করে
ক্ষমতার অস্ত্র দেওয়া মরিবার তরে।
এ হল রাজনীতির কথা। কিন্তু গান্ধারীর ধর্মবোধ ক্ষুদ্র রাজনীতির ঊর্দ্বে ওঠে। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে ধর্মশিক্ষা দেন,
ধর্ম নহে সম্পদের হেতু,
মহারাজ, নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু--
ধর্মেই ধর্মের শেষ। মূঢ়-নারী আমি,
ধর্মকথা তোমারে কী বুঝাইব স্বামী,
জান তো সকলই।
ধর্ম-আলোচনায়, তর্কে সম্পূর্ণ পরাজিত দুর্বলহৃদয় ধৃতরাষ্ট্র আর্তনাদ করেন,
প্রিয়ে, সংহর, সংহর
তব বাণী। ছিঁড়িতে পারি নে মোহডোর,
ধর্মকথা শুধু আসি হানে সুকঠোর
ব্যর্থ ব্যথা।
আত্মশক্তিতে সম্পূর্ণা যে নারীকে কবি সুমিত্রার মধ্যে দেখাতে গিয়েও পুরোনো ধারণাকে পেরিয়ে উঠতে পারেন নি, গান্ধারীর মধ্যে সেই নারীর কল্পনা সম্পূর্ণতা পেল।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন