সন্ধান
বেশি খুঁজতে হলো না। প্রিয়া সিনেমা থেকে দু’পা এগিয়েই প্রাসাদোপম সেই প্রায় খন্ডহর। সময়ের একটু আগেই এসে পড়েছি। রাস্তা থেকে তিনধাপ উঠে বিরাট বারান্দা, ধূলি-ধূসরিত,সামনের রুদ্র পলাশের ঝাঁকড়া গাছ থেকে ঝরে পড়া রাশিকৃত পাতা বাতাসে উড়ে এসে দখল নিয়েছে সেখানে।
ডোরবেল টিপলাম কয়েকবার। কারও সাড়া নেই। অগত্যা সময় খরচ করার জন্য সামনের চা দোকানটায় গিয়ে চিনি ছাড়া এককাপ লিকার নিয়ে দেখছিলাম বাড়িটাকে। বিশাল তিনতলা বাড়িটার খড়খড়ির জানালা থেকে টুকরো অনেক কাঠ খসে গিয়েছে। কত বছর যে রঙের পোঁচ পড়েনি কে জানে! নীচের লেটার বক্সটার ভগ্নদশা। উপচে পড়ছে কাগজ আর ম্যাগাজিনে। একদা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ভিসি-র বাড়ি! তাঁর কন্যা যাঁর খোঁজে এখানে আমার আসা সেই ইংরেজিতে গোল্ড মেডেলিস্ট এখন অশীতিপর অনীতা ব্যানার্জির বিচিত্র জীবন কথা জানতে উদগ্রীব আমি। এক্সক্লসিভ খবর হবে--কেননা দীর্ঘ পাঁচ দশক কেউ তাঁর খবর রাখেনা। ভাগ্যিস স্বাধীনতাসংগ্রামী কমলা মুখার্জি তাঁর কলকাতায় আসার খবরটা দিয়েছিলেন।
হঠাৎ চোখে পড়ল একজন পরিচারক গোছের লোক, খালি পা, মলিন জামাকাপড়, ছোট ছোট করে ছাঁটা পাকা চুল, কাঁধে বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় উঠে চাবি খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। কালবিলম্ব না করে চায়ের দাম মিটিয়ে প্রায় ছুটে গিয়েও ধরতে পারলাম না। অগত্যা আবার ডোরবেল। সাড়া নেই। আবার একবার বাজাতেই দরজা খুলে বিরস মুখে সেই পরিচারক মেয়েলি গলার রুক্ষস্বরে শুধালো, কাকে চাই। নাম বলতেই, অসন্তুষ্ট গলায় বলল, ‘এখনও দশ মিনিট বাকি। ঠিক আছে ভেতরে এসে বসুন।’ হন হন করে ভেতরে চলে গেল সে।
প্রকাণ্ড ঘরটি যে লাইব্রেরি ছিল তা বলে দিতে হয়না। মলিন কাচের আড়ালে একটি আলমারিতে শুধুই আইনের বই। আরও তিনটিতে বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত বই সব। মুগ্ধবিস্ময়ে দেখছিলাম।
‘বলুন কী বলতে চান!’ গলার স্বরে চমকে উঠে বলি, অনু দেবীকে একটু ডেকে দিন না। বলুন কমলাদি পাঠিয়েছেন। উত্তর এল, যা বলবার বলুন, আমিই অনু ব্যানার্জি। আমার তখন বাক্যস্ফুর্তি হচ্ছেনা। সামনে দাঁড়নো খালি পা, খাকি রঙের ঢোলা প্যান্ট, চেককাটা পুরনো একটা সার্ট গায়ে, পরিচারক ভেবেছিলাম যাকে --ইনিই তিনি!
ইন্টারভিউ দিলেন। আগেই কমলাদির কাছে জেনেছি সময় দশ মিনিট, তার মধ্যে যা প্রশ্ন করার,জেনে নেবার নিতে হবে।
বাঁকুড়ার কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলার স্বর একবারই একটু কোমল হল। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, তাঁত বসিয়ে দিয়েছেন কয়েকটি। তাতে শাড়ি-গামছা, খেস, শতরঞ্জি তৈরি হয়। উলের মাফলার সোয়েটার দস্তানাও তৈরি করে তারা। সেগুলি ঘাড়ে নিয়ে বেচতে যান তিনি নিজেই কয়েকজনের সঙ্গে। এবারও এনেছেন কিছু--কলকাতায় বিক্রির জন্য। সকালে নিয়ে বেরিয়েছিলেন পরিচিত কয়েকজনের কাছে, বিক্রি করেছেন।
পায়ে জুতো পরা ছেড়েছেন কবে থেকে? রেগে না গিয়ে শান্ত জবাব, ষোলো বছর বয়স থেকে।
গান্ধীজীর জীবনী অনুবাদের কাজ কতটা এগল?‘ কয়েকটা খণ্ড হয়েছে, সম্পূর্ণ হলে জানানো হবে।’
শেষ প্রশ্ন, কোন কোন কাগজে এই মুহূর্তে লিখছেন? নীরস সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘দিল্লি-মুম্বাই-এর সব লিডিং কাগজেই লিখি কেননা ওটাই আমার প্রধান জীবিকা।’
---‘দশ মিনিট শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। এবার আসুন। আমাকে আবার বেরতে হবে।’ বলেই পিছন ঘুরলেন। প্রণাম করার সাহসই হলো না। তাড়াতাড়ি নেমে এলাম পথে।
ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন