আর একটা কথা না বললে চলছে না। শরৎচন্দ্র পতিতাকে প্রথম নারী হিসাবে দেখেছেন, তাদের প্রেম, আনন্দ, বেদনা, তাদের মানবিক সত্তার খবর রেখেছেন্, এই কথাটা অনেকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসে পতিতা চরিত্র সৃষ্টি করেননি ঠিকই, তবে তাঁর কবিতায় কখনও কখনও আমরা পতিতা চরিত্রের দেখা পাই। তারা সমাজের রক্তচক্ষুতে বিধ্বস্ত হলেও মানবিক মূল্যবোধ তাদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় দেখা যায়। ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতায় সত্যকামের জন্ম দিয়েছেন বারবণিতা জবালা। সত্যকাম যখন তাঁর কাছে পিতৃপরিচয় জানতে চায় তখন কিন্তু কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেন না, তাকে তার সত্য পরিচয় দেন। এছাড়াও পতিতা নারীর সঙ্গে আমাদের দেখা হয় ‘কাহিনি’ কাব্যগ্রন্থের ‘পতিতা’ কবিতায়। এখানে পতিতা মেয়েটির মধ্যে যে মানবিকতার প্রকাশ কবি দেখেন তাঁর বিপরীতে মন্ত্রীর নাগরিক মনোভাব বড়ই বিসদৃশ হয়ে দেখা দেয়। নিষ্পাপ তরুণ ঋষ্যশৃঙ্গের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তাকে এমন বেদনা দেয় যে মরমে মরে গিয়ে সে সে বলে ওঠে,
আমি হয়ে ছাই তোমারে লুকাই
এমন ক্ষমতা দিল না বিধি।
কবির কাব্যনাট্যগুলিতে যেসব নারীকে দেখি তাদের বিভিন্ন রূপের মধ্যে কবির নারী সম্বন্ধে নানা দৃষ্টিভঙ্গী ধরা পড়ে। ১৮৯৩ সালে ‘বিদায় অভিশাপ’ কাহিনি কবিতাটি লেখা হয়। কচ দৈত্যগুরু শুক্রের কাছে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিক্ষা লাভ করতে এসে তাঁর কন্যা দেবযানীর সঙ্গে পরিচিত হন। তরুণ-তরুণীর একান্ত সান্নিধ্যে যে প্রণয় তার পরিণতি সম্ভব ছিল না কারণ কচকে দেবতাদের কাছে ফিরে গিয়ে সঞ্জীবনী মন্ত্র তাদের দান করতে হবে, মন্ত্রবলে তাদের বাঁচিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু এই বিচ্ছেদ দেবযানীর কাছে সহ্যের অতীত হয়ে পড়ে। দুজনের বিদায় সম্ভাষণ এই কবিতার বিষয়। এখানে নারীকে দেখি সম্পূর্ণ ধৈর্যহীন, কর্তব্যের আহ্বান সম্বন্ধে উদাসীন। সে কেবল তার প্রেমেষ্পদকে চায়, তাকেই জানে। কচ তাকে যতই বোঝায় তার কর্তব্যের গুরুভারের কথা, সে তা মানতে পারেনা। পুরুষের কাছে নারীর প্রেমই যে একমাত্র সাধনার ধন হতে পারেনা তা দেবযানী মানে না, মানতে পারেনা। কচ তাকে যখন প্রশ্ন করে ,
কচ। |
শুচিস্মিতে, সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে এরি লাগি করেছি সাধনা ?
|
দেবযানী বলে, |
কেন নহে? বিদ্যারই লাগিয়া শুধু লোকে দুঃখ সহে এ জগতে? করে নি কি রমণীর লাগি কোনো নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে অনাহারে কঠোর সাধনা কত? |
তিনসঙ্গীর পরিশিষ্টে অচিরার কাছে শুনি,
কচ ও দেবযানী ব'লে একটা কবিতা আছে। তার শেষ কথাটা এই, মেয়েদের ব্রত পুরুষকে বাঁধা, আর পুরুষের ব্রত মেয়ের বাঁধন কাটিয়ে স্বর্গলোকের রাস্তা বানানো।
এই হল রবীন্দ্রনাথের কাছে নারীর নিত্যমূর্তি বা paradigm। অচিরা কবির শেষজীবনের সৃষ্টি অত্যন্ত আধুনিক শিক্ষিত নারী। কিন্তু নারীর নিত্যমূর্তিতে তাতে কোনও ফারাক দেখি না। নারীর জন্য বিশুদ্ধ জ্ঞানান্বেষণ তো নয়ই, পুরুষের বিশুদ্ধ জ্ঞানাণ্বেষনে সে সহকর্মীও তো হতে পারল না। তবে কবির নারীভাবনায় কোনও পরিবর্তন হয়নি তা কিন্তু নয়। দেবযানীর মধ্যে যে প্রেম তা বাসনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে নি। তাই কচকে সে ‘প্রসন্ন বিদায়’ দিতে পারে না। সে তাকে অভিশম্পাত করে,
তোমা পরে
এই মোর অভিশাপ—যে বিদ্যার তরে
মোরে কর অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার
সম্পূর্ণ হবে না বশ—তুমি শুধু তার
ভারবাহী হয়ে রবে করিবে না ভোগ
শিখাইবে পারিবে না করিতে প্রয়োগ।
মননসমৃদ্ধ, কর্তব্যে স্থিরমতি পুরুষের পাশে কতই না হীন হয়ে যান নারী। তিনি তো হৃদয়সর্বস্ব, তাই গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা এবং কচের মতো উন্নতমনা পুরুষের সহস্রবছরের সখী হয়েও তাঁর মধ্যে কোনও উত্তরণ আমরা দেখলাম না। কিন্তু অচিরার মধ্যে এই উত্তরণ হয়েছে। অচিরার চোখে জল আসে, কিন্তু সে প্রসন্নমনে পুরুষকে তার কর্মময় বৃহত্তর জগতে মুক্তি দেয়। নারী তার বাসনার ঊর্ধ্বে উঠে পুরুষকে শক্তি যোগাতে পারে সেটুকু অন্ততঃ শেষজীবনে (১৯৩৪) অচিরার মধ্যে
কবি দেখিয়েছেন। নারী কর্মজীবনে সুস্থিত হয়েছে এমনটা রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনই দেখাতে পারেন নি, দেখাতে চাননি। পশ্চিমের মেয়েদের পুরুষের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নামা তাঁর চোখে ছিল নারীত্বের অবমাননার সমান। কিন্তু এখানে কবি শেষপর্যন্ত হেরেই থেকেছেন তাই বা কি করে বলা যায়? চিত্রাঙ্গদার বিশদ আলোচনায় পরে আসব, কিন্তু সেখানে বাহুবলে বলীয়ান বলে চিত্রাঙ্গদাকে ছোট করা হয়নি সেকথা তো আমরা সবাই জানি। অর্জুন চলে এলেন তাঁকে ছেড়ে, আর চিত্রাঙ্গদাই তো বাহুবলে রাজ্যরক্ষা করলেন যেমন তিনি অর্জুনের সঙ্গে দেখা হবার আগেও করেছেন।
কিন্তু কবির মনের গতি বড় বিচিত্র। যিনি চিত্রাঙ্গদার শৌর্যের কাছে অর্জুনকে নত হতে দেখিয়েছেন সেই তিনিই কোনো এক দিন ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে সম্পূর্ণ উলটো কথা বলঞ্ছেন। সেখানে স্পষ্টই চোখে পড়ে নারীর স্থান রবীন্দ্রনাথ কোথায় নির্দিষ্ট করেছেন।
সুমিত্রা
তোমরা পুরুষ, দৃঢ় তরুর মতন
আপনি অটল রবে আপনার 'পরে
স্বতন্ত্র উন্নত; তবে তো আশ্রয় পাব
আমরা লতার মতো তোমাদের শাখে।
তোমরা সকল মন দিয়ে ফেল যদি
কে রহিবে আমাদের ভালোবাসা নিতে,
কে রহিবে বহিবারে সংসারের ভার?
সুমিত্রা যা বলছেন তাই সংসারের নিয়ম। কবি এখানে অন্ততঃ সেই নিয়মটুকু মেনে নিয়েছেন, কারণ এখানে নারীকে তিনি দেখান গৃহকার্যে রত, পুরুষের আজ্ঞাদাসী না হয়ে রাজ্যরক্ষায় উদ্যোগী হতে, কিন্তু তার কি বিষময় ফল!সুমিত্রা বাইরে আসামাত্র কি প্রলয় উথলে ওঠে রাজ্যময়! তিনি আক্ষেপ করে বলেন,
সুমিত্রা
আমি দুর্ভাগিনী নারী কেন আসিলাম
অন্তঃপুর ছাড়ি। কোথা লুকাইয়া ছিল
এত অকল্যাণ। অবলা নারীর ক্ষীণ
ক্ষুদ্র পদক্ষেপে সহসা উঠিল রুষি
সর্প শতফণা। মোরে কিছু শুধায়ো না।
কি বলতে চাইছেন এখানে কবি? ‘অবলা নারী’ যত মানসিক বলে বলীয়ান হোন না কেন, তাঁর কি অন্তঃপুর ছেড়ে বাইরে আসা উচিত নয়?
‘রাজা ও রানী’ কবির অপেক্ষাকৃত কম বয়সের রচনা (১৮৮৯)। তিনি ১৯২৯ সালে এই নাটককে পরিবর্তিত রূপে নতুন করে লেখেন ‘তপতী’। ‘তপতী’-র ভূমিকায় তিনি নিজেই বলেন যে প্রথম নাটকটিতে অনেক ত্রুটি ছিল এবং তা তাঁকে পীড়া দিয়েছে। এই আলোচনার পক্ষে যে পরিবর্তনটি প্রাসঙ্গিক তা এই যে এখানে রাজ্যের প্রচন্ড অরাজক অবস্থায় রানী সুমিত্রা পিতৃভূমি কাশ্মীরের দেবালয়ে এসে আশ্রয় নিলেন ও তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিক্রমের আসক্তি থেকে মুক্তি হল। নারী ঘরের বাইরে পা ফেলার জন্য কোনো বিপর্যয় ঘটেছে এমন চিন্তা এখানে দেখি না। এতগুলো বছরে রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনায় এই স্পষ্ট পরিবর্তনটুকু চোখে পড়বার মতো। কিন্তু এই পরিবর্তনের সবটুকুই যে সামনের দিকে এগোনো তা মনে হয় না। ‘রাজা ও রানী’-র সুমিত্রার মনে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব। রাজাকে যখন তিনি বোঝাচ্ছেন, তখনও তিনি তাঁর ভালোবাসার কথা বলছেন। তাঁর উঁচু মন, অনেক সাহস, তবু তিনি প্রেম ও মানবিক দুর্বলতায় একজন পূর্ণ নারী হয়ে ওঠেন। কিন্তু ‘তপতী’-র সুমিত্রা একান্তই দেবী। তিনি দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। তাঁর রূপবর্ণনায় বারবার আগুনের প্রসঙ্গ। তিনি অগ্নিস্নানে শুদ্ধা, রুদ্রের কাছে তিনি আত্মনিবেদন করেছেন। চিতায় প্রবেশের আগে তিনি বলেন,
রুদ্রের কাছে বহুদিন পূর্বে আত্মনিবেদন করেছিলুম। ব্যাঘাত ঘটেছিল, সংসার আমাকে অশুচি করেছে। তপস্যা করেছি, আমার দেহমন শুদ্ধ হয়েছে। আজ আমার সেই অনেকদিনের সংকল্প সম্পূর্ণ হবে। তাঁর পরমতেজে আমার তেজ মিলিয়ে দেব।
বঙ্কিমের আদর্শ নারী প্রফুল্ল এমন সম্পূর্ণভাবে একটি দেবীধারণা না হলেও সে যেমন দোষেগুণে গড়া নারী না
হয়ে কেবল এক আদর্শ হয়ে রয়ে গেছে, ‘তপতী’-র সুমিত্রাও কেবলই এক জ্যোতির্ময়ী নৈর্বক্তিক ‘ধারণা’ হয়ে রয়ে গেছেন, রক্তমাংসের নারী হয়ে ওঠেন নি।
একটা কথা মনে রাখতেই হয় যে কবির নারীভাবনা সবসময় সরলরেখায় অগ্রসর হয়নি। সময়ানুক্রমের বিচারে তিনি প্রথমে একরকম ভেবেছেন, পরে নারী সম্বন্ধে মতাদর্শ পালটেছেন এমন কথা পুরোপুরি মানা যাবে না, কারণ তাঁর চিন্তায় নানা সময়ে নানা জটিলতা ও বিরুদ্ধচিন্তা ছিল যা জটিল কবিমনের পক্ষে থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবু একটা কথা বলতেই হয় যে দোলাচলের মধ্যে দিয়ে এগোলেও রবীন্দ্রচিন্তায় আধুনিকতার ছাপ ক্রমেই পড়েছে, এবং সর্পিল গতিতে হলেও তাঁর নারীভাবনা ধনাত্মক পথেই অগ্রসর হয়েছে বলেই মনে হয়। তাঁর সাহিত্য মনে হয় তারই সাক্ষ্য দেয়। সময়ের দিক থেকে ভাবলে কাব্যনাট্যে তাঁর এগিয়ে যাবার কথাই মনে আসে। ‘রাজা ও রানী’’ লেখা হয় ১৮৮৯ সালে, ‘বিদায় অভিশাপ’ ১৮৯৩, এরপর ১৮৯৬ সালে ‘মালিনী’। ‘মালিনী’-তে নায়িকা বিশুদ্ধ সৌন্দর্যপ্রতিমা, সে মূর্তিমতী প্রেম। তার কর্মযজ্ঞে প্রবেশের প্রশ্নই সেখানে ওঠেনি। কিন্ত সেখানে নারীর চিরন্তন মোহিনীরূপ যা পুরুষের ব্রতভঙ্গ করে বলে চিরদিন সমাজে বর্জনীয়, সেই রূপের কথাই বলে ক্ষেমঙ্কর,
এ সংকল্প দৃঢ় রেখো মনে। জেনো ভাই,
অন্য অরি নাহি ডরি, নারীরে ডরাই।
তার কাছে অস্ত্র যায় টুটে, পরাহত
তর্কযুক্তি, বাহুবল করে শির নত--
নিরাপদে হৃদয়ের মাঝে করে বাস
রাজ্ঞীসম মনোহর মহাসর্বনাশ।
কিন্তু মালিনী তো কেবল রূপে ভোলায় না। তার কাছে তথাগত বুদ্ধের অমিয়বাণী। সেবা, দয়া, প্রেমধর্মের বাণী তার কাছে। তার বিশ্বাসের পুণ্যজ্যোতি সবাইকে বিমোহিত করে। সে অনেকটাই রূপক। আবার সে ঘরের মেয়েও। মালিনীর মধ্যে নারীর বিশ্বাসের শক্তি দেখা যায়, দেখা যায় প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে নবধর্ম, প্রেমধর্ম বরণ করার মতো সাহস ও দৃঢ়তা। এ মেয়ে দেবযানী বা সুমিত্রা নয়। তার মধ্যে নারীর অনেকখানি উত্তরণ কবি দেখিয়েছেন। সে পথে নেমেছে রাজকন্যার বেশ পরিত্যাগ করে সামান্যা নারী হয়ে। কিন্তু তার চরিত্রের অসামান্যতায় মানুষের মন জয় করে সে আবার ঘরে ফিরে এসেছে। ঘর থেকে নারী বাইরে পা রাখলেই দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে এই চিন্তা ‘তপতী’ নাটকের মতো এই নাটকেও নেই। কিন্তু মালিনীকে সকলেই সৌন্দর্যপ্রতিমা এবং মূর্তিমতী অনাদিধর্ম বললেও সে ‘তপতী’-র সুমিত্রার মতো নীরক্ত অগ্নিকন্যা নয়। সুপ্রিয়ের কথায় তার কপোল আরক্তিম হয়, তার মধ্যে মানবিক দুর্বলতার অনেক প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। এই প্রথম বোধহয় রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা সামনের দিকে স্পষ্ট পদক্ষেপ নিল।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন