মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

কামাল হোসেন-এর ঝুরোগল্প

বাজপাখি

অবিনাশের মস্তিষ্কের কচুরিপানায় ভুল করে জন্ম নিল এক ঝলমলে বাজপাখি।

অচেনা পরিবেশে প্রথমটা একটু অস্বস্তি লাগে। পূর্ব জন্মের স্মৃতি মনে পড়ে না। অথচ অস্তিত্বের ভেতর থেকে একটা খোলা আকাশ, বিশাল নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো নানা ধরনের মেঘ সেই ক্যানভাসে বিচিত্র সব ছবি আঁকছে।

মাথার খুলির মধ্যে সেই বাজপাখি শক্ত চঞ্চুতে ঠোকর মারতে থাকে। অবিনাশের গা বমি ভাব হয়। মাথা ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে সুতীব্র যন্ত্রণা রীতিমতো কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। অনেকটা মৃগী রোগীদের মতো শরীরে অদ্ভুত ঝাঁকুনি হচ্ছিল। তারপর অনেকক্ষণ হাত পা নিশ্চল থাকে। একটা বিচিত্র ঝিন ঝিন অনুভূতি গোটা শরীরে প্রবাহিত হয়। 

অবিনাশের এখন বয়স বছর তিরিশ। বিএ পাশ করে গতানুগতিক চাকরির পরীক্ষা। কিছুই হয় না। কয়েকটি টিউশনি। সেই সঙ্গে সেলস-এর কাজ। পাড়ার বিমলদার ছোটো ফিনাইল কোম্পানিতে। ব্যাগে করে কয়েক ডজন বোতল নিয়ে শহরতলির বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করা। বাজার দরের থেকে কম দামে গৃহবধূরা সংগ্রহ করেন। মাস গেলে কমিশন মন্দ নয়। পথে-ঘাটে আরো অনেক সেলসের ছেলে মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাঝে মধ্যে চায়ের দোকানে একসাথে গরম চা আর বাপুজি কেক খেতে খেতে বন্ধুত্ব জমে ওঠে।

অবিনাশের কোনোদিন একঘেয়েমি লাগেনি।  খুব উচ্চাশা তার কোনোদিন ছিল না। অথচ এই ছেলেমেয়েরা এখনও স্বপ্ন দেখে একটা ভালো জীবিকার, সাজানো গোছানো ঘর সংসার, ফিল্ম স্টারের মতো বউ কিংবা স্বামীর। কারোর কারোর মধ্যে সাময়িক প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কও লুকোনো থাকতো না।

দিনগুলো মন্দ কাটছিল না। শিপ্রা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। প্রথমদিকে সামান্য এলোমেলো কথা। পারিবারিক তথ্য বিনিময়। নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সংগ্রাম। ক্লান্তি। গ্লানি। নিজেদের স্বপ্ন দেখাকেও তারা অবিশ্বাস করতে শিখে গেছে।

শিপ্রা মেয়েদের সাজ প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করতো। বিক্রিবাটা ভালোই হতো। অবিনাশের ফিনাইলের বিক্রি তুলনায় অনেক কম। সেজন্য কোনো হীনম্মন্যতা ছিল না তার। 

কাজের পথেই এখানে ওখানে বসে গল্প করতো তারা। একদিন ওরা একটা পুরোনো কবরখানা দেখে ঢুকে পড়েছিল। 

অনেক গাছপালা বুনো ঝোঁপঝাড়। একটা ভাঙা বাঁধানো কবরের ওপর বসে এলোমেলো কথা বলছিল তারা।

চারপাশে লম্বা লম্বা দেবদারু গাছগুলো প্রহরীর মতো চোখ মেলে দেখছিল তাদের।

শিপ্রা খুব সরলভাবে বলল, এই সব মৃত মানুষরা একদিন বেঁচে ছিলেন। ওরাও কাউকে ভালোবেসে ছিলেন, বিয়ে-থা, ঘর সংসার কাচ্চা বাচ্চা। তারপর কোথায় সবাই হারিয়ে যায়।

অবিনাশ আত্মগতভাবে বলে, আমরাও একদিন জীবন থেকে মুছে যাবো।

শিপ্রা বলে, এসব নেগেটিভ চিন্তা আমরা করবো না। তোমাকে একদিন আমাদের সোনাপুকুর গ্রামে নিয়ে যাবো। সেখানে গ্রামের পাশে শান্ত ভাবে বয়ে গেছে রঙ্গিনী নদীটি। ওপারে সবুজ শস্যক্ষেত্র, তালগাছ, নারকেল গাছ, আমগাছের ওপর হালকা কুয়াশা।

কোনোদিন সেই স্বপ্নের গ্রামে তাদের যাওয়া হয়নি। শিপ্রা হঠাৎ অন্য কোনো চাকরিতে ঢুকে পড়েছিল। আর যোগাযোগ রাখে নি।  বিমলা ব্যবসায় লোকসানের জন্য কর্মী সংখ্যা কমিয়ে দিলেন। স্বাভাবিকভাবে অবিনাশকেও জীবিকা পাল্টাতে হয়েছে। এখন সে সুবর্ণ আবাসনের সিকিউরিটি গার্ড।

মাঝরাত্তিরে ইদানিং মাঝে মাঝে মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা হয়। নিজেকে একা বড়ো অসহায় লাগে। কোথায় যেন জ্বলে ওঠে বিদ্যুৎ ঝলক। ঝোড়ো হাওয়া। চুপচাপ মেঝের ওপর প্রায়-অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে থাকে অবিনাশ।

আর তখন অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে আদিগন্ত ছুটে চলে সেই ঝলমলে বাজপাখি। 

দিনযাপনের যন্ত্রণামাখা।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন