প্লাসিবো
সেল্যুলার বায়লোজি হাসপাতালের মেমোরি ফরমেশন সেন্টার। না। এলোপ্যাথি প্রাকৃতিক মানসিক হাসপাতাল মঠ মিশন কোনটাই নয়। চিরোপ্রাকটর ও বলব না। এ এক অত্যাধুনিক প্লাসিবো চিকিত্সা। ওই গোলাপী ফর্সা খোকা ডাক্তার আসছে। খট খট খট। চশমার ফাঁকে পেয়াজ খোসা রঙের চোখ যেন চুম্বক। ছেলেটা ডাক্তারের পোশাকে, তবু ডাক্তার নয়। আংটির মতো গোলগোল থোকা চুল, বুদ্ধের মত কান। মুখে পবিত্র হাসি। কিন্তু ওকে দেখলেই বেডে শুয়ে থাকা সব পেশেন্টের মুখ আতঙ্কে হাঁ হয়ে যায়। এইরে! আমিও ঘেমে উঠলাম। সেই আকাশ ছোঁয়া মেরী গো রাউন্ডে বন বন করে ঘোরার ভয় ঢুকে গেল মাথায়। বহুদিন আমার চোখ পলকহীন ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘিলুর ভিতরে কোথায় যে ঘুম সংকেত লুকিয়ে ছিল জানিনা,ডাক্তারের তীব্র সম্মোহক চোখে চোখ পড়া মাত্র আমার চোখের পাতা আর ধরে রাখতে পারছিনা। আমার মেরুদণ্ড ভাঙ্গা। ছয় নম্বর গাঁঠ ড্যামেজ। বসতেই পারিনা। ডাক্তার কাছে এসে বলছে, ‘চোখে চোখ রাখো। আমি তোমাকে উঠিয়ে বসাবো। প্রথমে ভীষণ ব্যাথা পাবে। মনে হবে এর চেয়ে মৃত্যু ভালো। কিন্তু সহ্য কর। যখন জিভে চার ফোঁটা অমৃত ঢালবো তখন কল্পনা করো তুমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসছ,আর যা যা কল্পনাতে মনে আসবে তাই তাই করবে’।
আমি তাই করতে লাগলাম। কাঁধে হাত ঢুকিয়ে ও আমাকে তুলে যেন একটা চলন্ত ট্রেনের চাকার নিচে ফেলে দিল। আমার সারা দেহ দলা পাকিয়ে একটা রক্ত মাংসের ঢেলা হয়ে গড়গড় করে নিচে নামতে লাগল। দেখলাম মেরু দণ্ডের ঘা থেঁতলে চুরচুর। আমার রোজনামচা ডায়েরীর একটা ছেঁড়া পাতা কোত্থেকে উড়ে এসে ঢেকে দিল হৃদয় ঘড়ি। কিছু যেন লেখা রয়েছে? ট্রান্সেন্ডেন্টাল স্টেট? আমি মৃত্যুর কাছে গিয়ে আবার ফিরছি? আমি পুনর্গঠিত হচ্ছি? ডাক্তারের প্রবল তুষার ফুঁ আমার মাংসপিণ্ডকে একটা দিগন্ত বিস্তৃত হাওয়াচাদর বানিয়ে ফেলল। শৈশব কৈশোর যৌবন স্মৃতিগুলো এক একরকম সুন্দর ফুলের পাপড়ি হয়ে সেঁটে গেল সেই চাদরে। অদ্ভুত সাবলীল জীবনীশক্তিতে ভরপুর সেগুলি। ভালো কর্মঠ স্মৃতিগুলি রেখে কষ্ট ও দুঃখময় সব মুছে গেল। ডাক্তারের বেগুনি চোখ তখন অসংখ্য ছুঁচের মত আলো দিয়ে আমার মাংস চাদর সেলাই করতে লেগে গেছে।
আমার অর্বুদ অর্বুদ জিন শুয়োপোকার মত কিলবিল কিলবিল করছে হাওয়া কাঁথার উপর। নানান অঙ্গের আকার নিতে চাইছে কি? শূন্য থেকে কেউ যেন বলছে বলছে দুই মুখে অন্ধগলি। উর্দ্ধগামী হও। আমার চোখ তো এখন নেই? এবার মনশ্চক্ষু খুলল। সর্বত্র নীল দেখলাম। উর্দ্ধমুখে তাকাতেই দেখি আকাশব্যাপী সেই ডাক্তারের দুই নীল রঙের হাত। নিচে জিন ক্রোমোজম শেপ নিচ্ছে। মেরুহাড় অস্থি মজ্জা পাকস্থলী ফুসফুস। সবগুলো দৃষ্টিনন্দন মাংসের সুচারু পুনর্বিন্যাস। আমি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলাম। বিশাল গগনসদৃশ হাত আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমার দেহচোখ ফুটলো। তাকিয়ে দেখি আমার বেডের পাশে আমি দাঁড়িয়ে। সবাই হাততালি দিয়ে আমায় স্বাগত জানাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন