গন্তব্য
ষাট পেরিয়ে রিটায়ার করার পরই কোভিডের বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে পড়ল গোটা পৃথিবীজুড়ে। এতদিন রুটিন বাঁধা জীবনে ছোটাছুটি করে ঠিক সময়ের মধ্যে অফিসে পৌছাতাম, আর স্বপ্ন দেখতাম কবে আসবে অবসরের সেই অনন্ত ছুটির দিন। অথচ অবসর তো পেলাম, কিন্তু স্বাধীনভাবে ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা কেড়ে নিল সেই অদৃশ্য ভাইরাস।
কাজেই নিতান্তই অলসভাবে ম্লানভাবে দিন কাটছে।
বাইরে যাচ্ছি না। সুগার প্রেসার আছে। টিভিতে ডাক্তারবাবুরা নিষেধ করছেন। বাজার যেতে পারছি না। অল্প বয়সী ছেলেরা ভ্যানে করে টাটকা শাকসবজি মাছ মুরগী ঘরের দরজায় পৌঁছে দিচ্ছে তাই রক্ষা।
এখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মোবাইল। সহকর্মীদের যে ফোন নাম্বারগুলো সেভ করা ছিলো, তাদের একে একে ফোন করতে শুরু করলাম। সকলেই আমার মতো হাজার রকম সমস্যায় বিধ্বস্ত। ফোন করাতে অবশ্য কেউ বিরক্ত হয় না। সকলেই যেন এই গৃহবন্দি অবস্থায় পরস্পরের সঙ্গে মনের কথা শেয়ার করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
হঠাৎ একদিন বিকেল বেলায় এল অচেনা নাম্বারের ফোন। ভারি ব্যারিটোন কন্ঠস্বর।
চিনতে পারছিস?
কলেজ জীবনের স্মৃতি কীভাবে যেন মনে এসে গেল। দেবু?
যাক মনে রেখেছিস তাহলে !
আমাদের কলেজ জীবনের তুই ছিলি হিরো। তোকে কখনো ভোলা যায়? কিন্তু আমার ফোন নাম্বার পেলি কীভাবে ?তোর এক কলিগ ভুবনবাবু আমার প্রতিবেশী। তাঁর কাছে পেলাম।
ভালো আছিস? আমি রিটায়ার করেছি।
জানি তো। সব শুনেছি ভুবনবাবুর কাছে।
তোর খবর বল?
আছি রে। একটা ছোট বিজনেস করি। আমাদের আসলে ছুটি নেই। মাঝে মাঝে ফোনে তোর সঙ্গে আড্ডা মারব।
আমার খুব ভালো লাগছে দেবু। মনে হচ্ছে সেই সব হারিয়ে যাওয়া জীবন থেকে একজন কাছের মানুষের দেখা পেলাম।
মাঝে মাঝে ফোনে আমাদের আড্ডা চলতে থাকলো। সেই কলেজ জীবনের মতো উঁচু গলায় কথা বলার ভঙ্গি । এখনও গানের গলা সেরকম জমাটি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।
আমি লক্ষ্য করেছি, হাজার রকম কথাবার্তায় সে কখনো নিজের ব্যক্তিজীবন বা পরিবারের ব্যাপারে একটা কথাও বলেনি। জিগ্যেস করলে এড়িয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে লক ডাউন একদিন উঠে গেল। এক সময় লোকাল ট্রেন চালু হলো।
দেবু একদিন ফোন করে বলল, এবার যে কোনো দিন চলে আয় আমার বাড়িতে। শেয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেনে এক ঘন্টা। আমার সম্পর্কে তোর মনে অনেক কৌতূহল জমেছে বুঝতে পেরেছি। কলকাতা ছেড়ে অনেকদিন বাইরে আসিস নি। এখানে চলে আয়। রিয়্যাল পল্লীগ্রাম দেখাব। ভাবতে পারিস, এখানে এখনও বিদ্যুৎ ঢোকে নি। টিভি নেই। সভ্যতা নেই। সত্যিকারের প্রিমিটিভ লাইফ। হা হা করে উঁচু গলায় হাসতে হাসতে দেবু বলল, আমাদের গাঁয়ে পা রেখেই তোর গাইতে ইচ্ছে করবে , গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে !
সত্যিই এতদিন ঘরবন্দি অবস্থায় হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। একদিন দেবুকে জানালাম, এই রবিবার তোর কাছে যাচ্ছি।
সোৎসাহে দেবু বলল, স্টেশনে নেমেই আমাকে ফোন করবি। মোটর সাইকেলে তাড়াতাড়ি চলে আসব।
লোকাল ট্রেনে যথারীতি প্রচন্ড ভিড়। শেয়ালদা থেকে উঠে বসবার জায়গা পেয়েছিলাম, সেটাই রক্ষা।
অনেক কাল বাদে ছুটন্ত ট্রেনের ভিতর থেকে গাছপালা বাড়িঘর মানুষজন দেখতে খুব ভালো লাগছিল। জানলার বাইরে থেকে ছুটে আসা বিশুদ্ধ অক্সিজেন মুখের মাস্ক ভেদ করে কন্ঠনালীতে প্রবেশ করছিল।
ঘন্টা খানেক পরে পৌঁছে গেলাম দেবুর বলে দেওয়া স্টেশনে।
দিগন্ত জোড়া শস্যক্ষেত্রের পাশে ছোট্ট একটা স্টেশন।
যাত্রী আমি একাই। স্টেশনে নেমে মোবাইলে দেবুকে ফোন করলাম। ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।
স্টেশন মাস্টার আমাকে লক্ষ্য করছিলেন।
তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম।
আপনাকে কেউ বলে দেয়নি, এখানে নেটওয়ার্ক নেই । আপনি যেখানে যাবেন, তাদের কেউ এসে পৌঁছয় নি ?
মাথা নেড়ে মৃদু হেসে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। উদ্দাম বাতাসে সামনের চোখ জুড়ানো সবুজ শস্যক্ষেত্র মাথা নেড়ে আমাকে স্বাগত জানালো। সামনে শুয়ে থাকা একটি সরু রাঙামাটির পথে সত্যি সত্যি পা রাখলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন