শনিবার, ১ জানুয়ারী, ২০২২

তরুণ মুখোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প

গোপালের ক্যারাম খেলা


একাদশীর দিন সকালে ঘুম ভেঙেই গোপালের মনে হলো, সব কিছু ফাঁকা। প্রচণ্ড মন খারাপ ওকে ঘিরে ধরলো। গতকাল গেছে বিজয়া দশমী। কত আলো, বাজনা, বাজি পোড়ানো। প্রতিমা ভাসানের সঙ্গে নাচ, সিঁদূর খেলা, হৈ চৈ। আর আজ সব শেষ। ঢাক-ঢোল-কাঁসি কিছুই বাজছে না। ঠাকুরমণ্ডপ খাঁ খাঁ করছে। লোকজনও তেমন নেই। আত্মীয়-স্বজন যারা এসেছিল, তারা অনেকেই চলে গেছে। কেউ বা আজই চলে যাবে। তাহলে গোপাল খেলবে কার সঙ্গে?

 

দাঁত মেজে-মুখ ধুয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় দাঁড়ায় গোপাল। নরম রোদ শিউলি গাছে। গাছের তলায় ম্রিয়মাণ কিছু শিউলি ফুল। কয়েকটা চড়ুই শালিখ লাফিয়ে লাফিয়ে উড়ছে। পোকা কি ফড়িং খুঁটে খাচ্ছে। আকাশটা সমুদ্রের মতো নীল।

অন্যদিন বাড়ির অন্যান্য ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে এসে তাকে ডাক দেয়, অ্যাই গোপাল, খেল্‌বি চল্‌। আজ কেউ নেই। গোপালের কান্না পায়।

 

দেখতে দেখতে বেলা বাড়ে। কিভাবে সময় কাটানো যায় ভেবে পায় না গোপাল। একমনে এক্কা-দোক্কা খেলে একা-একাই। কখনো ফাঁকা ঠাকুরদালানে কয়েকপাক চর্কির মতো ঘোরে। কখনো বা ঘরে এসে বইয়ের পাতা ওল্টায়। ছবি দেখে। মন বসে না। দুপুরে স্নান খাওয়া সেরে অন্যদিন গোপাল নতুন জামা পরে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু আজ বেলা যেন ফুরাতে চায় না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

 

শেষ বিকেলে ঘুম ভাঙে তার। আবার মন খারাপের পালা। আবার একা হয়ে যাওয়া। এঘর-ওঘর ঘুরে হঠাৎই দোতলায় তার চোখে পড়ে একটা ক্যারামবোর্ড। বাঃ, দারুণ তো। সন্ধ্যেবেলা সে তবে ক্যারামই খেলবে। কিন্তু কার সঙ্গে? গোপাল সঙ্গী খুঁজতে আবার এদিক-ওদিক ঘোরে। দ্যাখে, দাদা জামাপ্যান্ট পরে বেরোচ্ছে।

-              দাদা, ক্যরাম খেলবে?

-              এখন?

-              হ্যাঁ, চলো না।

-              ক্যারাম কোথায় পেলি?

-              কেন? দোতলার ঘরে।

-              ওহো, ওটা তো মামার ঘর।

-              মামা? মামা কে?

গোপাল যখন খুব ছোট, তখনই ওর একমাত্র মামা হঠাৎই হার্টফেল করে মারা যায়। বয়স মাত্র চল্লিশ হয়েছিলো। গোপালের দাদা জানে। গোপালকে এসব ঘটনা বলা হয়নি।

-              ঠিক আছে, তুই ক্যারাম সাজা। আমি দশ মিনিট পরেই আসছি। গোপালের দাদা বেরিয়ে যায়।

 

গোপাল উপরে উঠে আসে। ক্যারামের ঘুঁটি সাজায়। দাদা এলেই খেলা শুরু হবে। অপেক্ষা করে। মাঝে মাঝে একাই স্ট্রাইকার দিয়ে ঘুঁটি মারে।  

-              কি গোপাল, একা-একা খেলছো?

অচেনা স্বর শুনে গোপাল তাকায়। দ্যাখে, শ্যামবর্ণ ছিপছিপে একজন মানুষ, মাথায় বড়ো বড়ো চুল, হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

-              তুমি কে গো?

-              আমি মামা।

-              ওঃ, তুমিই মামা? খেলবে আমার সঙ্গে?

-              সেজন্যই তো এলাম। বোসো, খেলি।

গোপাল মামার খেলা জমে ওঠে। মামা এত ভালো খেলে, তা জানত না সে। খেলতে খেলতে মামা মজার মজার কথাও বলে। গোপাল হেসে কুটিপাটি খায়।

-              তুমি এতদিন কোথায় ছিলে মামা? গোপাল বলে।

-              আমি? আমি, মানে, এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।

-              কোথায়? আবার যাবে?

-              হ্যাঁ, যেতে তো হবেই।

-              আমাকে নিয়ে যাবে মামা?

-              না-না, তুমি বাচ্চা ছেলে। তুমি যাবে কেন?

-              ওখানে খেলনা পাওয়া যায় মামা?

-              -নে- কিছু পাওয়া যায়। নাও খেলো। এখনি গেম শেষ হবে।

আরো দুবার ঘুঁটি সাজানো হলো। মামা দুবারই জিতে গেলো। কিন্তু এজন্য গোপালের দুঃখ হলো না। সময়টা কি সুন্দর কাটলো। ঠিক তখনই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে মামা চমকে উঠে বললো, আচ্ছা গোপাল আমি এখন তবে যাই। বেশ ব্যস্তসমস্ত হয়ে মামা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দাদা এসে ঘরে ঢুকলো।

-              আমার একটু দেরি হয়ে গেলো রে গোপাল। একা একা বোর হচ্ছিস নিশ্চয়।

-              কই, না তো। এতক্ষণ তো মামার সঙ্গে বেশ খেলছিলাম। মামা কি দারুণ খেলে দাদা, আগে বলোনি তো!  

-              মামা? কোন্মামা?

দাদার প্রশ্নে গোপালের এবার অবাক হওয়ার পালা। তারপর দাদার কাছে মামার যে বর্ণনা সে দিল, তাতে অবিশ্বাসের হেতু নেই, সে সত্যি মামাকেই দেখেছে। আরো প্রমাণ, মামা সিগ্রেট খেয়ে বারান্দায় জ্বলন্ত টুকরো ফেলে রেখেছে। কিন্তু গোপালকে এসব কথা কি করে বোঝাবে। গোপাল আবার সরল মনে প্রশ্ন করে,  

-              দাদা, ওটা তাহলে মামা নয়?

-              না রে...

 

গোপালের ছোট মাথায় কিছুই ঢোকে না। কি সত্যি আর কি মিথ্যে, বুঝে নিতে গিয়ে তার দুই চোখ জলে ভরে যায়।।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন