কবি ও শিল্পী নাসের হোসেন
জন্মঃ ২.১.১৯৫৮, কলকাতা
মৃত্যুঃ ৯.১২.২০২০, কলকাতা
শৈশব ও কৈশোরঃ বহরমপুরে। জ্যাঠামশাই প্রতিষ্ঠিত ক্লাবে কবিতালেখা, ছবি আঁকা ও ব্রতচারী চর্চা।
শিক্ষা এবং শিক্ষালয়ঃ বহরমপুরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাপীঠ। কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এস.সি. পাঠরত অবস্থায় ‘দ্য
লাস্ট পেজ’ দ্বিভাষিক পত্রিকার সম্পাদনা।
১৯৭৪ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজেই প্রথম যৌথ চিত্রপ্রদর্শনী।
প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনীঃ ১৯৮৪ এপ্রিল বিড়লা একাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচার-এর
কনটেমপোরারি গ্যালারি-তে।
একক কাব্যগ্রন্থঃ ২৬টি। অপারেশন থিয়েটার। আলপিননামা। লাফ। প্রভৃতি...।
ই-বুকঃ জিমন্যাশিয়াম ২০১৩ ।
গদ্যরচনাঃ ১৯৭৫ থেকে কবিতা, চিত্র ও ভাস্কর্য বিষয়ে অজস্র গদ্য লিখেছেন।
অনুবাদকর্মঃ ১৯৭৫ থেকেই প্রচুর অনুবাদ করেছেন। আলিয়ঁস ফ্রাঁসে (ফরাসি), ম্যাক্সমুলার ভবন
(জার্মান) এবং সাহিত্য অকাদেমি আয়োজিত অনুবাদ ওয়ার্কশপে আমন্ত্রিত হয়ে অনুবাদ-
কর্মে অংশগ্রহণ করেছেন।
সম্পাদনাঃ ‘কবিতাপাক্ষিক’-এর অন্যতম সম্পাদক।
চারবছর ‘কবিতাপাক্ষিক’-এর প্রধান সম্পাদক।
‘রৌরব’ (১৯৭৫-২০০৪), ‘উতল হাওয়া’, ‘সৃষ্টিকোণ’, ‘নিনি’ এবং অন্য কিছু পত্রিকার
সম্পাদন-সহযোগী।
ছদ্মনামঃ অর্জুন মিশ্র। এবং আরো কিছু...।
পুরস্কার/সম্মাননাঃ ১৯৯৮ অনন্য রায় পুরস্কার। ২০০৬ অশোক মহান্তী পুরস্কার। ২০০৭ ‘মনীষা’ পত্রিকার
সম্মাননা। ২০০৮ সাল থেকে পাঁচ বছর সাহিত্য অকাদেমি (নিউ দিল্লি)-র
অ্যাডভাইসরি বোর্ডে কোর-কমিটির সদস্য কবি-ব্যক্তিত্ব। ২০১৩ বীরেন্দ্র পুরস্কার।
আরো কিছু।
মানুষের
আমি প্রকৃত মানুষ নই বলেই হয়তো মানুষের কথা
বলতে পারি
তার খুব নিকটে নেই বলেই হয়তো ঝুঁকে আছি
তার বুকের ভিতর
খুব জ্বর নাকি অসুখ দেখব বলে
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
তাকে খুব ঘৃণা করি বলেই হয়তো দাঁড়িয়ে রয়েছি
তার ঠিক পাশেই
আমার দিকে হাত বাড়ালে আমি সরে যাই আরো দূরে
আমার নাম ধরে
কেউ ডাক দিলে আমি দু-হাতে চাপা দিই কান
আমার দিকে যখন কেউ ছুড়ে দেয় পারমাণবিক বোমা
আমি লুফে নিই
তারপর লোফালুফি করতে করতে নিজেরই বিস্ফোরণের পর
মানুষের কথাই মনে পড়ে যায় খুব
ভৌতিক চোখ
বহুদিন মানুষেরা দেখে আসছে এইসব স্বপ্ন :
নারীর ফারকোটের নীচে মায়াবী পোশাক, কিংবা
রানী রাজকন্যা জনিত গোপন অসুখ...
মাঝে মাঝে স্লো মোশানে উঠে যাই
দশ ইঞ্চি উপরে –––
চোখ ভাসে নরক ও ত্রিনিয়তির কল্পচিত্র,
মানুষের চিরাঙ্কিত রাশিচক্র;
বাদুড়ের মতো ডানা ঝাপটিয়ে সন্ধে নামে
নাকি হিটলার?
ভয়ে ঠোঁট কাঁপে মেয়েদের, হাত থেকে খসে পড়ে
তীব্র শ্যাম্পেন...
অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে ফুটে থাকে
দুটি সাদা ভৌতিক চোখ!
রাম-রহিমের গপ্পো
আমিই রাম আমিই রহিম
আমি সাম্প্রদায়িকতার ভিতরে সাম্প্রদায়িকতা
আমি মৌলবাদীর ভিতরে মৌলবাদী
সম্প্রদায় বলতে মানুষকেই বুঝেছি
আর মৌলকথাটি হচ্ছে ভালোবাসা
আমিই রাম আমিই রহিম
আমিই মন্দির আমিই মসজিদ
জিদের ভিতরে জিদ হয়ে আমি জন্মগ্রহণ করেছি
মানুষকে বিদ্বেষমুক্ত করে তবেই যাব হে ঈশ্বর
রক্তপাত তো অনেক হল
এবার শান্ত থেকে শান্ত হোক সবকিছু
সব কান্না মুছে যাক
সব পুড়ে যাওয়া ঘর গড়ে উঠুক আবার
সব শিশু নেচে উঠুক জীবনের আনন্দে
আমি মহাকালের ভিতরে মহাকাল
কালের অন্তর্গত প্রেম নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি
সে একটি চন্দ্রমল্লিকা
হতে পারে সে একটি চন্দ্রমল্লিকা হতে পারে গোলাপযূথিকা
কিন্তু এ কোন আকাশ থেকে নেমে আসছে কালো বৃষ্টি
কালো বর্ষারাত মেয়ে, সে এখন কোথায় হাত পুড়িয়ে রাঁধছে
ও পাগল ভাই, তোমার ছোটোবোন এখন কোথায় কীভাবে
রয়েছে সে তুমি জানো না, মানো কি মানো না দুর্লভ সুযোগ পেলে
সেও একদিন ছুটে যাবে সুদূর আমেরিকা, লস অ্যাঞ্জেলেসের
কবিসম্মেলনে পড়বে কবিতা, তার আঁকা ছবিগুলি টাঙানো হবে
ক্যালিফোর্নিয়ার দর্শক সম্মুখে, কী বিশাল শো-রুম, আলৌকিক
সীমানা
তুমি তোমার বউ আর চন্দ্রমল্লিকা নামের ছোটোবোনটি তিনজনে মিলে
সে কি তুমুল হল্লা করেছিলে সেবার, মনে আছে, দিঘার ডাকবাংলোয়
বিপুল ঝড়ে ভেসে গিয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত
গভীর মৃদু স্বপ্নে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে আজ যে মেয়ে, সে এখন
কোথায় কার বাড়িতে ঠেলছে হেঁসেল, পান থেকে চুন খসিয়ে
খেপে উঠছে আর গালি পাড়ছে সুদূর অখ্যাত দাদাটিকে
সে কেন আসে না, সে কেন নিয়ে যায় না তাকে
বাপের বাড়িতে
মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে
দুষ্টু মিষ্টি কৈশোরের উষ্ণ তৎপরতা
খালি পাকস্থলির খিদের মতো ব্যাপ্ত পারাবারে
স্তব্ধ হয়ে আছে দুটি চোখ, অশ্রুরুদ্ধ, একটি নীল গাড়ি
থেকে নেমে এসে ভ্যানিটিব্যাগে রাখে হাত
চায়, পরি
তোমার বাড়িতে একটি শিশু-পরি এসেছে, চাঁদের আলোয়
ভাসতে ভাসতে এসেছে এই শিশু-পরি, কোথায় ছিল সে,
ছিল তোমার স্বপ্নের মধ্যে, আজ সত্যি এসেছে
তুমি তার ভরাট গালে চুমো খেয়ে জিজ্ঞেস করো, কোথায়
ছিলি এতদিন, শিশুর হাসির মধ্যে উত্তর উঠে আসে, যেন
সে বলেছে, তোমার ইচ্ছের মধ্যে ছিলাম
চিরকাল সেভাবেই তো থাকে, ছিল, আজ এই প্রথমবার
তোমার বাড়িতে এল, চলে যেতে নয়, অতিথি হিসেবে নয়,
থাকতে, ভালোবাসা থাকতেই চায়, এইটাই তার চাওয়া
দ্রুত
সিভ্কাবুর্কা একটি যাদুঘোড়ার নাম, বিশাল এবং
সুন্দর দেখতে। স্বাস্থ্যবান। সবসময় দূরে কোথাও
নিয়ে যাবার জন্য তৈরি। তার এক কান দিয়ে ঢুকে
অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে এলে মানুষ আরো বেশি
সাহসী হয়। যত ভয়ংকর অভিযানই হোক, সে
জিতবেই। আমি একটি ছোটো ছেলে এবং বাড়ির
ছোটো ছেলে। আমার দায়িত্ববোধ অন্য কারো থেকে
কম নয়। আমার নাম ইভান। কিন্তু তফাৎ যেটা
সেটা হল আমি বাড়ির বাইরেটা নিয়ে একটু বেশি
ভাবি। সবসময় মনে হয় পৃথিবীটা এত বড়ো
এবং সময় এত কম। সুতরাং যে-কাজ সারতে
হবে তা করতে হবে খুব দ্রুত। সিভ্কাবুর্কা-র
হ্রেষা আর খুরধ্বনিতে সওয়ার হয়ে ঝড়ের মতো
নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছি অসহায় মানুষদের মাঝে, শুনছি।
(ছবিঋণঃ কামাল হোসেন এবং রোশনি ইসলাম)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন