সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

তরুণ মুখোপাধ্যায়-এর প্রবন্ধ


 নারীভাবনায় গান্ধীজী

সালটা ১৯৪৬ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর হানাহানিতে সারা বাংলা রক্তাক্তবিধ্বস্তবিপন্ন। ভয়ংকরভাবে নোয়াখালি আক্রান্ত হলো ১০ অক্টোবর। দিল্লিতে খবর পেয়ে বিচলিত হলেন গান্ধীজী। সিদ্ধান্ত নিলেন অসুস্থ শরীরেও যাবেন নোয়াখালি। বললেনওখানে হত্যালুঠধর্ষণ চলেছে। মানতে পারা যায় না। বিশেষভাবে প্রার্থনাসভায় বললেন :   

নারী দুঃখের কাহিনী আমাকে সর্বদাই বিচলিত করেআমি তাদের চোখের জল মোছাতেসান্ত্বনা দিতে নোয়াখালি যাবতারা কোনোই অপরাধ করে নাই।           

                                                                                                                               (নোয়াখালির পথে পথে

তৎকালীন প্রাদেশিক কংগ্রেসের মহিলা-বিভাগের সম্পাদিকা কমলা দাশগুপ্ত প্রাগুক্ত লেখায় জানিয়েছেনকীভাবে মহাত্মাজী ৭৭ বছর বয়সেও আর্ত  অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ধর্ষিতা নারীদের বিবাহ করার জন্য যুবকদের আবেদন জানিয়েছেন। কমলাদেবী নিজে অন্তত ৮৬টি চিঠি এই মর্মে  পেয়ে তা দিয়েছেন গান্ধীজীর হাতে। নোয়াখালি পরিক্রমার সময় তাঁকে শুধু চোখে দেখার জন্য এসেছে উৎসুকভীত গ্রামবাসীরা। আর ভীতআর্ত নারীরাও দলে দলে এসেছেন তাঁকে প্রণাম করতে। তিনি তাদের প্রার্থনাসভায় যেতে বললেফেরার সময় সন্ধ্যায় কী হবেতারা জানতে চায়। গান্ধীজী বলেন, ‘ভয় কিআমি আছিএসো আমার সঙ্গে 

 

নারীর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস  ভালোবাসা। নারীশক্তিকে তিনি সম্মান করেন। স্পষ্ট ভাষায় বলেন,

নারীকে আশ্রয়ের জন্য পুরুষের মুখাপেক্ষী হইবার প্রয়োজন নাই। পুরাকালের দ্রৌপদীর ন্যায় তাহাকে নিজের চরিত্রবলনিজের শক্তি এবং সর্বোপরি ভগবানের উপর নির্ভর করিতে হইবে।

নারীর অধিকার নারীকেই অর্জন করতে হবে। ‘আমি কন্যা  পুত্রকে সম্পূর্ণ সমপর্যায় গণ্য করিব’ বলেছেন গান্ধীজী। নারীর অধিকার প্রসঙ্গেও তিনি সরবনারীকে তিনি পুরুষের সমপর্যায়ভুক্ত করেছেন এবং তাঁর বিশ্বাস আইনত কোনো বাধা বা অসুবিধা নারী-পুরুষের সমানাধিকারে থাকার কথা নয়। কারণ নারী  পুরুষ ‘পৃথক বস্তু’ নয়তারা একই বস্তুর দুটি সমান ভাগ মাত্র। তাদের সমস্যার মানও সমান। উভয়ে আসলে এক আত্মা এবং পরস্পরের পরিপূরক। নারীর গৌরব ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষকেও নিষ্প্রভ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেএকথা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তবে তার জন্য চাই শিক্ষা  কর্ম। স্বরাজ সাধনায় তিনি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছিলেন : Swaraj is to be obtained by educating the masses to a sense of their capacity মেয়েরা রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে তেমন উৎসাহী নয় দেখে তিনি বলেনতারা বাল্যকাল থেকে পিতামাতা ভাই  স্বামী কর্তৃক শাসিত  পরিচালিত। এখন থেকে তাদের শেখাতে হবে স্বাধীনভাবে চিন্তা করাআত্মসম্মানবোধ। পুরুষের আধিপত্যে নারী নিজেকে হীন  দুর্বল ভাবেএটা বাঞ্ছনীয় নয়। নারী কোনোভাবেই অপকৃষ্ট নয়। এমনকি নিরক্ষরতার দোহাই দিয়ে মেয়েদের সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো সঙ্গত যুক্তি পুরুষের নেইএকথা বলতেন তিনি। পুরুষের হাতের পুতুল বা ভোগ্যবস্তু হওয়া কখনোই নারীর বিধিলিপি হতে পারে না। বিবাহিতা নারীদের কর্তব্য ভূমিকা প্রসঙ্গেও গান্ধীজী সরব হয়েছেন। তাঁর কিছু বক্তব্য উদ্ধার করা যেতে পারে :   

) আমি বিশ্বাস করি, পুরুষ যেমন পশুশক্তি প্রণোদিত সাহসে নারী হইতে শ্রেষ্ঠ, নারীও সকল সময়ে আত্মত্যাগের শক্তিতে পুরুষের চেয়ে অধিক বলীয়সী।

) যতদিন একটি নারীকেও আমরা আমাদের লালসার জন্য উৎসর্গ করবো ততদিন আমাদের সব পুরুষের মাথা লজ্জায় নত হওয়া উচিত।

) স্ত্রী স্বামীর দাসী নয়, স্ত্রী স্বামীর সহযাত্রী সহকর্মী। স্বামীর সকল সুখ-দুঃখের অংশভাগিনী। নিজের কর্তব্য বাছিয়া লইতে স্বামীর যতটুকু অধিকার আছে, স্ত্রীর অধিকারও তাহা হইতে বিন্দুমাত্র কম নহে।

-প্রসঙ্গে আমরা কস্তুরবা গান্ধীর কথা ভাবতে পারি। গৃহবধূ হয়েও যিনি স্বামীর সকল কাজের সঙ্গিনী হন। কিছু ক্ষোভ বঞ্চনার বেদনা তাঁরও ছিল। গান্ধীজী যে-আদর্শ প্রচার  করেছেন, নিজের পুরুষ অহং-এর জন্য অনেক সময় তা মানেননি। জীবনের গোপনীয়তা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেরর গোপনীয়তা অগ্রাহ্য করেছেন গান্ধীজী। তবু তাঁর স্ত্রী মেনে নিয়েছেন, বৃহত্তর স্বার্থে তা মনে রাখেননি। তবু স্বামীর স্বরাজ সাধনায় কস্তুরবা লবন আইন ভঙ্গের সময় ৩৭ জন নারী সদস্য নিয়ে সবরমতী আশ্রমে সত্যাগ্রহ করেছিলেন।

 

অসহযোগ আন্দোলনে তিনি নারীদের চেয়েছিলেন। চরকা কাটায় যুক্ত করেছিলেন। গান্ধীজীর ডাকে সেদিন সাড়া দিয়েছিলেন সরোজিনী নাইডু, অমৃতা কাউর , সুশীলা নায়াল, হেমপ্রভা প্রমুখ। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মেয়েদের পিকেটিং পুলিশের লাঠিচার্জের বিবরণ লিখতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘Our women came to the front and took charge of the struggle’ কারা ছিলেন সেই আন্দোলনে? Women of the upper or middle classes’ এবং peasant women, working class women, rich women, poor women’ পুলিশের লাঠির সামনে নারীশক্তির এই প্রকাশ সেদিন সত্যই ছিল বিস্ময়কর। লবণ কর রদের জন্য সত্যাগ্রহে পনেরো হাজার সদস্য নিয়ে যোগ দেন কমলা চট্টোপাধ্যায়। এরপর লালা লাজপত রাই-এর কন্যা পার্বতী দেবী পাঁচ হাজার নারী নিয়ে মিছিল করেছিলেন। কলকাতায় নারী পিকেটিং হয়। গান্ধীজীর ভাষায় হলো great awakening যদিও সেই দেশনায়িকাদের নীরব ভূমিকা আমাদের জাতির কাছে চিরকাল অজানাই থেকে যাবে, এও তিনি জানতেন।


মদ বর্জন, বিলাতি কাপড় বর্জন, চরকা কাটা বা পিকেটিং- গান্ধীজী মেয়েদের অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ছেলেদের দেখাতে চেয়েছিলেন, নারীও শক্তিময়ী। যেজন্য সুচেতা কৃপালনী বলেছিলেন :

Gandhi extolled these qualities of sacrifice and suffering in Indian womanhood and drew upon their inner strength and courage to bring them into the freedom struggle.

সুচেতার চোখে গান্ধীজী মেয়েদের সেই নেতা শিক্ষক, যাঁর অনুপ্রেরণায় অভিজাত, ধনী, দরিদ্র, এমনকি খুব রক্ষণশীল পর্দানশীন পরিবারের মেয়েরাও উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ নির্বিশেষে দেশের কাজে স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে যোগ দিয়েছিলেন। আবার গান্ধী উদ্‌ভাবিতটলস্টয় ফার্ম নারীরাই ছিলেন সক্রিয় শক্তি কর্মী। স্বরাজ আন্দোলনে নারীদের তিনি পাশে পেয়েছেন ব্রতের সহায় রূপে যেমন, আমেদাবাদে বস্ত্র আন্দোলনে তাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন অনুসূয়া বেহেন। ইনি ছিলেন সূতিবস্ত্রের মালিক অম্বালাল সারাভাই-এর বোন। খাদি-কে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন গান্ধীজী। এজন্য চরকা কাটায় নারীদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। উপার্জন করার উপায় ছাড়াও খাদি ছিল তাঁর ধারণায় পুনর্জন্ম আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। কলকাতায় চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অন্যান্যরা অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যে অহিংস প্রতিরোধ হয়েছিল, সেখানে মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মদান ভুলে যাবার নয়। আসামে কমলা বরুয়া পাঁচশজনকে নিয়ে মিছিল করেছিলেন গান্ধীজীরই প্রেরণায়।

 

গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন, নারী ভগবানের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাই পুরুষের ইন্দ্রিয়লালসা মেটানোই তার একমাত্র কাজ হতে পারে না। এজন্য বাল্যবিবাহকে তিনি সমর্থন করতে পারতেন না। এটা তাঁর কাছে ভোগপ্রবৃত্তির লক্ষণ। এক্ষেত্রে পিতাকেই কন্যাকে রক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলতেন তিনি। আবার আপত্তি ছিল বিপত্নীকের বিবাহেও। তাঁর ভাষায় : বালবিধবাকে দেখিলে আমি শিহরিয়া উঠি। সদ্য বিপত্নীক স্বামীকে নিষ্ঠুর নির্মমতার সহিত পুনরায় বিবাহ করিতে দেখিলে আমি রাগে কাঁপিতে থাকি

বিদ্যাসাগর-অনুরাগী গান্ধীজী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাই বলেন, বিধবা বিবাহে কোনো পাপ নাই পণপ্রথা তাঁর মতে নারীর অপমান। তাই বর বধূর মধ্যে ভালোবাসা স্বাধীন সম্মতিকেই তিনি বিবাহের একমাত্র শর্ত বলে মনে করতেন। তাছাড়া নারীকে বাদ দিয়ে যেহেতু পুরুষের অস্তিত্ব থাকে না এবং দেশের ভবিষ্যৎ নারীরই হাতে; তাই প্রাচীন শাস্ত্রবচন মেনে তিনি নারীকেনরকের দ্বারভাবতে চাননি। মেয়েরা তাঁর কাছে শান্তির দূততাদের পরিচয় কর্মে গুণে, নিছক সাজসজ্জায় নয়। তিনি নারী পুরুষ উভয়কেই সরল জীবনযাপনের উপদেশ দেন। স্পষ্টভাবে বলেন, যে সকল শৃঙ্খল নারীর স্বাধীন ইচ্ছাকে প্রতিহত করিয়া রাখিয়াছে আমি সেগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে চাই মেয়েদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর একান্ত কাঙ্ক্ষিত ছিলো। তাই সুচেতা কৃপালনীর এই মূল্যায়ন যথার্থ বলেই মনে করি :  

Many a leader and reformer has espoused the cause of woman in this country, but none held women in such esteem as did Father of the Nation’.  


ঋণস্বীকার :

) গান্ধী পরিক্রমা / শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত

) ইতিহাস সাহিত্য প্রবন্ধমালা (দ্বিতীয় খণ্ড) /  রাজীব বসু সম্পাদিত

) গান্ধীজীর দৃষ্টিতে নারী / ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন