ম্যাক্সিম গোর্কি : কবির চোখে
Like Gorky, I sometimes follow my doubts
Outside to the yard and question the sky,
Longing to have the fight settled, thinking
I can’t go on like this, and finally I say
All right, it is improbable, all right, there
Is no God. [‘Staying Power’ by Jeanne Murray Walker]
বিশ্বসাহিত্যের ভুবনে মাত্র একটি বই শতবর্ষ পার হয়ে আজও অম্লান, জ্যোতির্ময়। দেশ-বিদেশের যথার্থ যারা পাঠক তাঁরা সকলেই জানেন ‘মাদার’ (মাৎ) নামের বহুখ্যাত, বহুল প্রচারিত এবং বহুভাষায় অনূদিত উপন্যাসটির নাম। ম্যাক্সিম গোর্কি ও ‘মা’ যেন সমার্থক। তাঁর আর কোনো গল্প-উপন্যাস-নাটক না-ই পড়া থাক, ‘মা’ কারোর অজানা নয়। এই সেই উপন্যাস, যা রুশ বিপ্লবের বার্তাবহ। সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়, অবিচার, ধর্ম আর ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে মূর্ত প্রতিবাদ ‘মা’ (এখানে কৃষক-চরিত্র রীবিন বলে : They have fooled us about God too!)। কী চেয়েছেন গোর্কি? হিংসা, দ্বেষ, পাপ ও যুদ্ধকে পৃথিবীকে থেকে মুছে দিতে। যেজন্য লেনিন বলেছিলেন :
‘আপনার শিল্পকৃতি ও প্রতিভার দ্বারা আপনি রুশিয়া এবং বাইরের সমস্ত শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে বিরাট সেবা করেছেন – ভবিষ্যতে আরো মহত্তর ভাবে করবেন।’
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে গোর্কির জন্ম। তাঁর জন্মগত নাম আলেক্সি ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ। ছেলেবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে দাদু-দিদিমার কাছে প্রতিপালিত হন। ভয়ঙ্কর, বিচিত্র অভিজ্ঞতায় বেড়ে ওঠেন। প্রত্যক্ষ করেন মানুষের দুর্দশাম দারিদ্র্য, বর্বরতা। তার পাশে দিদিমার ক্ষমা, সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসা তাঁকে মানবিক হতে শিক্ষা দেয়। তাই বড়ো হয়ে তিনি যা-কিছু লেখেন সবই তাঁর নিদারুণ অভিজ্ঞতার ফসল। হতমান, দীন, নিপীড়িত মানুষ, খেটে খাওয়া নিচুতলার মানুষেরাই তাঁর লেখার উপজীব্য। যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই; মানুষ যাদের শ্রম ও অশ্রুর মূল্য দিলো না, তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন ম্যাক্সিম গোর্কি – যা তাঁর ছদ্মনাম। রুশ ভাষায় গোর্কি শব্দের অর্থ তিক্ত। জীবনযাপনের বিষতিক্ত স্বাদ নিয়ে তিনি সাহিত্যের অমৃত দান করে গেছেন। এমন এক মানবদরদী সাহিত্যিক কখনো নির্দিষ্ট দেশকালের সীমানায় আবদ্ধ থাকতে পারেন না। এজন্য তাঁর ‘মাদার’ (১৯০৬/০৭) উপন্যাসটি সারা বিশ্বের প্রায় ১২৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এমন এক মহৎ লেখকের প্রতি তাই বাঙালি কবিরাও শ্রদ্ধায় আনত হয়েছেন। তিনি যেন সেই ঝড়ের পাখি, যাঁর ডাক শুনে আমাদের স্থবিরত্ব ঘুচে গেছে। তাঁর ‘ঝড়ের পাখির গান’ কবিতায় গোর্কি লিখেছিলেন :
আর সেই পাখি, পরাক্রান্ত একা পাখি, মাথা-তোলা
ঝড়ের পাখি ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ায়, বিদ্যুৎ-চমকের মধ্যে
ঘন বজ্ররবে, গর্জনাম, উত্তাল তরঙ্গ রাশির মাথায়,
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত তার গর্বোদ্ধ্বত ডাক,
যেন বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী ...
উঠুক, উঠুক ঝড় – (অনুবাদক : সিদ্ধেশ্বর সেন)
।। ২।।
বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পর নতুন সুর ও স্বর আনতে চেয়েছিলেন তিরিশের কবিরা। তাঁরা গোর্কি, হুইট্ম্যান পাঠে উজ্জীবিত হয়ে বেছে নিয়েছিলেন দীনহীন, হতমান, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত মানুষদের। প্রেমেন্দ্র মিত্র ঘোষণা করেছিলেন ‘আমি কবি যত ইতরের’। যুবনাশ্ব বা মণীশ ঘটক ভিক্ষুক সমাজ নিয়ে লেখেন ‘পটলডাঙার পাঁচালি’ (১৩৬৩)। তাই তাঁর কাছে ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন মানবতাবাদী ও দরদী লেখকের আদর্শ এবং অনুপ্রেরণা । যে-কারণে তাঁর কাব্যাদর্শ ও জীবনবোধ প্রসঙ্গে কবি বলেন : ‘মূলত আমি বস্তুতান্ত্রিক’। কিংবা বলেন, ‘কবিতা আমার মনুষ্যত্বেরই পূর্ণতার একটি সোপান’। তাঁর ‘একচক্রা’ কাব্যের ‘গোর্কি’ কবিতাটি এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়, যা ১৯৩৬-এ গোর্কির মৃত্যুকে স্মরণ করে কবির শ্রদ্ধানিবেদন। কবিতাটির রচনাকাল ১৯৩৮ সাল। যদিও কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ গোর্কির জন্মশতবর্ষপূর্তির সময়ে। চতুর্দশপদী বা সনেটে মণীশ ঘটক খুব স্পষ্টভাবে গোর্কির সাহিত্যিক ভূমিকা কি বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রথম স্তবকেই বলেছেন :
তুমিই খুললে চোখ। তোমার কীর্তির
দূরাগত পরিচয়ে এলো করে ভিড়
ভাগ্যহত ভবঘুরে লাঞ্ছিত ভিখারি
বিড়ম্বিত জীবনের নীচতলার সারি।
দ্বিতীয় স্তবকে কবি আত্মসমালোচনা করেছেন। আমরা যারা চাকচিক্যে মুগ্ধ তাদের প্রতি বিদ্রুপও করেছেন ‘মোহান্ধ ছিলাম’ শব্দবন্ধে। ষট্ক বা পরের ছয় পঙ্ক্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়, শোষণ, পীড়ন, বঞ্চনার কথা বলেছেন। দেখেছেন সর্বত্র
ধনিকে শ্রমিকে ভেদ, মালিকে প্রজায়
ধূর্ত চোর নিক্তি হাতে পিঠে ভাগ করে –
গোর্কির কাছে তিনি এই শপথ নিতে চান, এই বিভেদ-বৈষম্য তিনি যৌবন-বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন। তাঁর আহ্বান তাঁকে উজ্জীবিত করে, তাই প্রণতি জানান।
চার বা চল্লিশের দশকের কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় সাম্যবাদী ভাবনায় দীক্ষিত। মার্ক্স ও লেনিন তাঁর শ্রদ্ধাভাজন। স্বাভাবিকভাবেই এই কবিও চান দেশে অসাম্য, অবিচার দূর হোক। শ্রমজীবী মানুষেরা প্রাপ্য সম্মান ফিরে পাক। কাজেই গোর্কির মানবতাবাদী ভূমিকা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখেন, ‘ঝড়পাখি’ – যা গোর্কির প্রাগুক্ত ‘ঝড়ের পাখির গান’ (দি সং অফ দি স্টর্মি পেট্রেল)-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত মনে হয়। এ-প্রসঙ্গে আমার ক্ষোভ ও বিস্ময়ের কথা ও বলি। চল্লিশের মার্ক্সবাদী কবিদের কবিতায় লেনিন, মার্ক্স, হো-চি-মিনের বন্দনা থাকলেও গোর্কি নিয়ে কোনো কবিতা চোখে পড়েনি। পরবর্তী পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের কবিরাও এ-ব্যাপারে উদাসীন। এর কারণ কি, আমি জানি না। যদিও তাঁরা প্রত্যেকেই গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস বা ‘নিচের মহল’ (১৯০২) নাটক ও ছোটগল্প পড়েছেন। শ্রদ্ধাও করেন। কিন্তু লিখিতভাবে কোনো নিদর্শন রাখেননি। এক্ষেত্রে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ব্যতিক্রম।
ম্যাক্সিম গোর্কির দীর্ঘ কবিতাটির একটি সংহত রূপ এঁকেছেন মঙ্গলাচরণ। দেখেছেন,
উন্মাদ হাওয়ায় ঘুরে ইচ্ছার পাতালে ঝাঁপ-উড়ে দূরে, ঘুরে
ঝাপট ঝাপটায় মেঘে আশার উত্তুঙ্গ বিন্দু ঘুরে ঘুরে –
যে-ঝড়ের পাখি আলো-অন্ধকার ছেনে আনতে চায় আলোর বার্তা। যার ঠোঁটের খড়কুটো ঘাসে আছে নীড়ের আশ্বাস। কবিতার অন্তিম পঙ্ক্তিতে কবির অন্বেষণ – ‘সমস্ত ঝড়ের কেন্দ্রে খুঁজি সেই পাখির স্বনন’। অর্থাৎ গোর্কির কাছেই পেতে চান বিদ্রোহ ও মুক্তির বার্তা।
চল্লিশের স্বল্পালোচিত কিন্তু বিশিষ্ট কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত তাঁর ‘এই এক সময়’ (১৩৮০) কাব্যের ‘তোমাকে জানি বলেই’ নামের কবিতাটি ‘ম্যাক্সিম গোর্কিকে নিবেদিত’ বলেছেন। মার্ক্সীয় ভাবনায় উজ্জীবিত কবি বলেন,
তোমাকে জানি বলেই আমি
মানুষের মহৎ অনুভবে
হীরে-মানিক জ্বলতে দেখি;
শিল্প মহিমায়
বিপ্লবেরই অবাক প্রকাশ
মহিমান্বিত দেখি;
গোর্কির ‘নিচের মহল’ নাটকের ব্রাত্য, উপেক্ষিত, দরিদ্র মানুষদের যন্ত্রণার কথা স্মরণ করে এই কবি আরও বলেন,
পাতালের অন্ধকারেও
মায়ের চোখ জ্বলতে দেখি।
এখানে ‘মা’ গোর্কির ‘মাদার’এর পেলাগেয়া নিলভনা – যিনি সন্তান পাভেলের আরব্ধ বৈপ্লবিক কাজ স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদও গোর্কির প্রতি শ্রদ্ধাবান। জন্মের দেড়শো বছর উপলক্ষে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ‘ম্যাক্সিম গোর্কি স্মরণে’ চতুর্দশপদী কবিতায় তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, চারিদিকে এত অন্যায়-অবিচার; সেখানে ‘আর কত ধরে থাকি রক্তবর্ণ হৃদয় আমার?’ যে-গোর্কি তাঁর লেখায় ‘মানুষের স্তব’ রচনা করেছিলেন, আজ সেই মানুষেরা অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। কেউ ‘সন্তান হত্যার যজ্ঞে’ মাতে; মায়ের স্নেহ ব্যর্থ হয় ‘অপ্রেমের সর্বগ্রাসে’। কবি স্মরণ করেন তলস্তয়, চেখভকে। কবি কল্পনা করেন, বাংলার মায়েরা হয়তো সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবেন। এবং ভাঙা বিশ্বাস গড়তে -
বাঙলার মায়েরা হয় পাভেলের মায়ের মতোই
ত্যাগ-তিতিক্ষায় দেখো, মিছিলেই কেঁদে ওঠে কেহ।
‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার সম্পাদক অনিল আচার্য পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক। মুখ্যত প্রাবন্ধিক। গোর্কির জন্মশতবর্ষে পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন কবি তরুণ সান্যালের উৎসাহে ১৯৬৮ সালে (১৩৭৫ বঙ্গাব্দ)। এখানে একাধিক প্রবন্ধ ও অনুবাদের পাশাপাশি সংকলিত হয়েছিলো তাঁর সেই যুবক বয়সে লেখা একটি কবিতা ‘উপলক্ষে’। এই কবিতায় তিনি লিখেছেন, আমাদের কর্মকাণ্ডের অলক্ষ্য দর্শক যেন গোর্কি, যারা দিন আনে, খায় কিংবা যারা সুচতুর ভাবে সমরজয়ী তাদেরই একজন প্রতিনিধি এই কবি। তাই বলেন,
সামান্য বুড়োর মুখে আমার সময় থেমে গেছে
লালনীল কণ্ঠস্বর রাত্রির মশারিকে ছিঁড়ে দেয়
*** ***
আমার নিদ্রার মুখে নুড়ি জ্বালে, মৃতের মতন চোখে
জেগে থাকে সারাটা শরীর।
গোর্কির ভাবনা ও লেখা এভাবেই জাগিয়ে রাখে। সুখনিদ্রা দিতে দেয় না। ‘এক-মনুমেন্ট-গর্জনের নিচে’ হঠাৎ দেখা হয় ‘হাত-পা-ওয়ালা দুটো পুতুলের’। যে-সমাবেশে তারা করমর্দন করে। শোষক ও শোষিত, ধনী ও দরিদ্র একমঞ্চে ঠাঁই পায়। কবির মনে হয়, এখানে ‘সময় হঠাৎ স্থির, পরাজিতও বা’। অর্থপূর্ণ হাসিতে ‘মঞ্চের বুড়োটা তখনও হাসছিল’। অন্যদিকে ষাটের অশীতিপর কবি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি লেখা তাঁর চতুষ্পদীটি নিবেদন করেন গোর্কির প্রতি, সেখানে গোর্কিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি লিখেছেন :
মৃত্যু থেকে ফিরে এসে দিয়ে গেছ জ্ঞানলব্ধ মন,
দিশা কত দিয়ে গেছ ম্রিয়মান জীবনের কূলে;
সেসব সৃজন আজ বিশ্বময় প্রাণের আবেগে
গভীরে সে গেছে বহুদূর আলোকিত মূলে। (গোর্কিকে)
।। ৩।।
বাঙালি কবিরা গোর্কির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এতে সন্দেহ নেই। ১৯২৯-এ রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’য় গোর্কির ‘মা’ পড়তে দেখা যায় লাবণ্যকে। ‘রক্তকরবী’র সর্দারতন্ত্র, গোঁসাইয়ের ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামি এবং সোনার খনির শ্রমিকদের প্রতিবাদেও গোর্কির ‘মা’-এর চরিত্রদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। পরে ‘রক্তকরবীর’ প্রেরণায় চলচ্চিত্ররূপে পাই সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’(১৯৮০), সেখানেও অলৌকিকতার মোড়কে শ্রমিক বিদ্রোহ ও অত্যাচারী রাজার পতন। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত গোর্কির মৃত্যুর পর ‘পরিচয়’-এ একটি সম্পাদকীয় লেখেন ‘মাক্সিম্ গর্কি’ নামে ১৯৩৭-এ,যা অত্যন্ত মেধাবী একটি প্রবন্ধ। সেখানে গোর্কির ‘বিপ্লববিলাস’ বা উপন্যাসের নীতিমূলকতায় অনাস্থা পোষণ করলেও, তাঁর সশ্রদ্ধ মন্তব্য :
‘...তাঁর ছোটগল্প ও জীবনস্মৃতি বৈচিত্র্যের বাহুল্যে, তথা অপরিচয়ের বিস্ময়ে আমাদেরও মন মজায়। ‘দি বার্থ অফ্ এ ম্যান’, ‘ইন দ্য অটম্’, ‘টোয়েন্টিসিক্স মেন্ অ্যাণ্ড্ এ গর্ল্’ এবং সর্বোপরি ‘দি লোয়ার ডেপথ্স্’ পড়লে, আর সন্দেহ থাকে না যে গর্কি রুষ সাহিত্যের মহাপথে চলুন বা না চলুন, তাঁর রূপনৈপুণ্য অন্য কারও চেয়ে কম নয়; এবং সেই কলাকৌশলের উপভোগ যদিও দুর্লভ বৈদগ্ধ্যের ধার ধারে না, তবু আদর্শ ও যাথার্থ্য, বাদানুবাদ ও তন্ময়তা, চিত্তশুদ্ধি ও রোমাঞ্চপ্রীতি, কালোপযোগিতা ও অবৈকল্যের এ-রকম অপরূপ সংমিশ্রণ তাঁর আগে আমাদের কল্পনার অতীত ছিল’।
গোর্কিকে নিয়ে কবিতা না লিখলেও এই গদ্যের মাধ্যমে তিনি সেই অভাব পূর্ণ করেছিলেন। অন্যদিকে সমর সেনের’ কবিতাতে গোর্কির উল্লেখ থাকলেও তা যৎসামান্য। রবীন্দ্রনাথকে এখানে ঈষৎ ব্যঙ্গ করাও হয়েছে দেখা যায় :
নারকীয় অন্ধকার পার হয়ে তারা আসে পাহাড় চূড়ায় :
লেনিন, স্টালিন, জুখভ ও গোর্কি
তাদের আমরা চিনি। কিন্তু চিনি না তাকে,
দুধ ও তামাকে সমান আগ্রহ যার,
দু’নৌকার যাত্রী এই বাঙালী কবিকে,
বুঝি না নিজেকে। (২২শে জুন)
পঞ্চাশের আরেক বামপন্থী কবি তরুণ সান্যাল (১৯৩২-২০১৭) গোর্কির প্রতি আমৃত্যু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, শতবর্ষে গোর্কির ‘মাদার’ নিয়ে মননশীল প্রবন্ধও লেখেন তিনি। সেখানে তাঁর আক্ষেপ : ‘সমাজতন্ত্রের জন্য দায়বদ্ধ বাঙালি পাভেলদের এখন পুঁজিবাদ বাড়িয়ে তোলার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। এখন বিশ্বায়নের ঘোড়ায় সওয়ার তাদের সাধ’। তবু শেষজীবনে লেখা ‘কলাবতীর রূপকথা’ কাব্যনাটকে ‘মাদার’-এর পাভেলদের মিছিলের লাল নিশান ও উড়াল পাখিটিকে তিনি সংগ্রামী স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে এনেছেন।
সেই ম্যাক্সিম গোর্কির ১৫০তম জন্মদিবস এ-বছর উদযাপিত হয়েছে গোর্কি সদনে মার্চ মাস জুড়ে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় শ্রদ্ধার্ঘ্য, পুনর্মূল্যায়ন প্রকাশিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ পাবে আগামী দিনে, গদ্যে-পদ্যে অনেকেই সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এই উপলক্ষে আমি তাঁকে প্রণতি জানিয়ে একটি কবিতা নিবেদন করতে চাই। যে-কবিতায় গোর্কির জীবন-দর্শন ও বিদ্রোহকে আমি স্মরণ করতে চেয়েছি। জীবনমন্থনজাত বিষ পান করে যে গোর্কি আমাদের জন্য রেখে গেছেন মায়ের স্নেহ, সাহিত্যের অমৃত, তাঁকে কি ভোলা যায়? এই চতুর্দশপদীই তাঁর প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি :
জীবনমন্থনে বিষ, অমৃত কি নেই?
চরাচরে আর্তস্বর, এত হাহাকার?
অন্নজল-রুটিহীন মানুষেরা কাঁদে
যারা সব পেয়ে গেছে, তারা নির্বিকার!
শুধু তুমি জেনেছিলে সেই তেতো স্বাদ,
জেনেছিলে প্রতিকার নেই কারো কাছে;
সম্মিলিত প্রতিবাদ ছাড়া মুক্তি নেই –
নিজেকে পোড়াও তুমি বিদ্রোহের আঁচে।
সমুদ্র উত্তাল, ওঠে ঝড়; বাজপাখি
ঝাপটায় ডানা; দিগন্তে ছড়ায় কার
আগুনের স্বর – ‘জাগো যত হতমান,
মাথা নিচু আর নয়; ভাঙো কারাগার!’
কোথায় রয়েছ ‘মা’গো, ডাক দাও পথে –
মানব-প্রাচীর গড়ি শপথে শপথে।। (রচনাকাল : ২৫ মে, ২০১৮)
ব্যবহৃত গ্রন্থসমূহ
১) ম্যাক্সিম গোর্কি (২০১৬)। জ্যোতির্ভূষণ দত্ত। গ্রন্থতীর্থ, কলকাতা।
২) সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধসংগ্রহ (১৩৯০) । হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ফাউন্ডেশন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
৩) মণীশ ঘটক : কবিতা ৫০ (২০১৪)। তরুণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও সংকলিত। দীপ প্রকাশন, কলকাতা।
৪) শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৩)। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ভারবি, কলকাতা।
৫) সমর সেনের কবিতা (১৩৬১)। সিগনেট প্রেস, কলকাতা।
৬) অনুষ্টুপ (১৯৬৮) : বিশেষ গোর্কি সংখ্যা । সম্পাদক : অনিল আচার্য। কলকাতা।
৭) কবিতাসংগ্রহ (২০১৫)। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত। পাঠক, কলকাতা।
৮) গোর্কির ‘মাদার’ : বহুস্বরসংগতি (২০১৭) : ঋতম্ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত। বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
৯) কাব্যসমগ্র ৬: জ্বলদর্চি রক্তমেঘ (২০১৭)। তরুণ সান্যাল । আন্তর্জাতিক প্রকাশন, কলকাতা।
১০) poetryfoundation.org (in appreciation of Maxim Gorky at the International Convention of Atheists, 1929)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন