বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১

সুস্মিত হালদার-এর ঝুরোগল্প


অবসর

আমি অশীতিপর এক বৃদ্ধা নারী আগামী ২০শে মার্চ পঁচাশি বছর বয়স হবে। জন্মদিন পালিত হয় না এখন আর যে ঘরে আমি থাকি সেই ঘরে আমার সদ্যপ্রয়াত স্বামীর একটা ফটো আছে ফটো থেকে সে আমাকে উইশ করে এই ঘরটা একসাথে চলার দীর্ঘ তিরিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের সাক্ষী। আনোয়ার শাহ রোডের উপরে এই তিন কামরার ফ্ল্যাটটা স্বামী কিনেছিলেন এখন থাকি আমি,আমার ছেলে,বউমা আর বারো বছরের নাতি বুবাই।      

     ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমি রোগে পঙ্গু হলেও আমার মাথাটা সতেজ খবরের কাগজে বেরোতে থাকা হিংসা-প্রতিহিংসার খবর এখনও আমার চেতনাকে উত্তেজিত করে কিন্তু এই উত্তেজনা ভাগ করে নেওয়ার কেউ নেই ঘরের যারাতারা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ততাদের ‘রোসো’, ‘একটু থামো’ বলা ছাড়া আর কোনো কথা হয় না প্রতিবেশী আমার মতন যে জন আছেনতারা এতটাই সাংসারিক যে আমার সঙ্গে মানসিক কম্পাঙ্ক মেলে না সেই অর্থে আমি নির্বান্ধব         

     সারা জীবন কেটেছে স্কুলে পড়িয়ে মেরুদন্ড সোজা করার কাজে ছিলাম মগ্ন তখনকার জীবন এক ঘোরে কেটেছিল অবসরের পর থেকেই কেমন যেন পালটে গেল অফুরন্ত সময় কিছু একটা করা যেতেই পারত। কিন্তুঠিক তখনই শরীরটা বিগড়োতে শুরু করে স্পন্ডাইলোসিসের শিকার হয়ে আস্তে আস্তে ফ্ল্যাটের সীমিত গণ্ডীর মধ্য বন্দি হয়ে পড়ি এক মানসিক বিষন্নতা আসতে থাকে  মনে হতে থাকে আমার যতটুকু ব্যক্তিগত স্বাধীনতা প্রাপ্য এই বয়সেঈশ্বর তা কেড়ে নিয়ে আমাকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে দিলেন।        

     ক্রাচে ভরসা করে চলাফেরা করি। বেলা টা দশটা নাগাদ এবং আবার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ সামনের বারান্দায় বসে লোকজনের যাতায়াত দেখি। ঐটুকু সময় আমার বাইরে জগতে আনাগোনা। হৃদয়ের দরজা খুলে আলো প্রবেশ করে। বিষন্নতা কাটে। আর একটা জিনিস এখন আমার নিত্য সঙ্গী। একটা মোবাইল ফোন। ছেলে দিয়েছেআপৎকালীন অবস্থায় আমি যাতে যোগাযোগ করতে পারি। ছেলে শিখিয়েও দিয়েছে কি করে কল করতে হয়আর কল রিসিভ করতে হয়।   

     বারান্দা ছাড়া এই সময় কাটানোর আরেকটা সুযোগ পেয়ে আমি খুব খুশি। মোবাইলে আমার অনেকটা সময় কাটে আমার একমাত্র বোনের সঙ্গে কথা বলে। যেতে পারি না তার কাছেসেও আসতে পারে না। দুটো কথা বলে আমার একাকীত্ব কাটে।

     ছেলে রাতে বাড়ি ফিরে খুব উত্তেজিত হয়ে আমার ঘরে ঢোকে। হাতে একটা চিঠি মতন কিছু। আমি রাতে শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।তোমার মোবাইল ফোনে কত বিল এসেছে জানোপনের তিরিশ টাকাযত না ইন-কামিং কল তার থেকে অনেক বেশি আউট-গোয়িং কল। এত কার সঙ্গে ফোন করে কথা বলোআমি আগেও বলেছিএবারও বলছিএত বিল এলে আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। তুমি বরং  মোবাইলটা কাল সকালে আমাকে ফেরত দিও। বুবাইকে দেব। ওর টিউশানি থেকে কল করতে সুবিধা হবে। ওর একটা মোবাইল প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’    

    এরপর থেকে আরেকটা রোগে পড়লাম। রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন