বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১

শতাব্দী দাশ-এর ঝুরোগল্প


দূরভাষ

বিট্টু আজ বসল না পাশে। লাস্ট বেঞ্চে সরে বসলাম। আড়চোখে একবার দেখল, তারপর ফিফথ বেঞ্চের কোণে ব্যাগ রেখে অপুকে আলতো হাতে ঠেলা দিল। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। বিট্টু আর কথা বলবে না। কাল ওর চোখে ঘেন্না ছিল। দলা দলা থুতু, বমি দৃষ্টিতে। এমনিতে আর দুটো মাস। তারপর টেস্ট। স্কুল শেষ। কেন যে বলতে গেলাম বিট্টুকে! আর কাঁধে হাত রাখবে না। বছরের দোস্তি, স্কুল পালানো, নদীর ধার, রেললাইনে ব্যালেন্স করে হাঁটাসব শেষ!

 

সামনের বেঞ্চে বিজু ঢলে পড়ছে রাজীবের গায়ে। খুব হাসছে। বায়োলজি ক্লাসে মোহিনীবাবু চার্ট ঝুলিয়ে বোঝাচ্ছেন। হাসাহাসি দেখে অনুমান করি, জননতন্ত্র। একটা সুঠাম ছেলের ভিতর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পেলভিসের মধ্যে প্যাঁচ পয়জার। ঝাপসা চোখে লিঙ্গ দেখি। পিছনে দুই থলি শুক্রাশয়দের ধারণ করেছে যত্নে। পা দুটো জড়ো করে বসি। ভুলে যেতে চাই শত্তুরকে। যেন কিছু নেই পায়ের ফাঁকে।

 

টিফিনে বেরিয়ে গেল বিট্টু। আমিও বেরোলাম। সুদাস আচারওয়ালার কাছে ঘুরঘুর করলাম।কা বাবুয়া? আজ বোন্দু এল না?’ সুদাস আজও বিনি পয়সায় কারেন্ট নুন দিল। কাল নুন চাটতে চাটতে আমরা স্কুলবাড়ির ছাদে উঠেছিলাম। আমি আর বিট্টু। শনশন হাওয়া। দুটো ঘুড়ি উড়ছিল। বিট্টু বলছিল, 'সবুজ লালকে কাটবে।অথচ আমি সবুজ আর লালের ঢলাঢলি দেখছিলাম। যেন হঠাৎ চুমু খেয়ে পালাচ্ছে। কথাগুলো বলতে চাইছিলাম। বিট্টুকেই বলা যায় শুধু। ছেলেরা 'লেডিজ' বললে বিট্টু আমায় আগলায়।

 

বলতে চেয়েছিলাম, আনন্দলোক থেকে নায়িকাদের ছবি কাটা হলে যখন আমায় বইটা দিয়ে দেয়, আমি খালি গা ছেলেদের দেখি। শিরশির করে। মাঝে মাঝে বিট্টু কাঁধে হাত রাখলেও আজকালবিট্টু ছিটকে সরে গিয়েছিল। চোখ দিয়ে ওয়াক তুলেছিল।

 

পাঁইপাঁই সাইকেল চালিয়ে নদীর ধারে এলাম ছুটির পরে। নেমে সাইকেলটাকে লাথ কষিয়ে দিলাম। নীরবে কাত খেয়ে পড়ল সে মাঠে। মাথার উপর ঘুড়িরা কাছে আসে, সরে যায়। জাম গাছের ছায়ায় বসে কাঁদি। গাছ বলে, ‘কী হল?’ ভয়ে চুপ থাকি। গাছ যদি ওয়াক তোলে? পাতারা সরসর করে বলে, ‘হলটা কী?’ চিৎকার করে বলি, 'আমি কি মন্দ? আমায় ঘেন্না পাও না?’ গাছ মৃদু হেসে দুটো জাম ঝরিয়ে দেয় কোলে। পচাৎ করে জাম ফাটে। সাদা প্যান্টে ঋতুমতীর মতো লজ্জার দাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াই।

 

সাইকেলে নদীর পাড়ের চায়ের দোকান পেরোচ্ছি। রেডিওতে তিনশ সাতাত্তর নামের কোনো আইন বদলের খবর পড়ছে। কঠিন শব্দ সব। যেন কত দূরের কথামালা। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। কাকুরা চা খাচ্ছে নির্বিকার। আমি নামি। কান খাড়া করে সাইকেল গড়াই। দূরের ভাষা আমায় ডাকে।

1 টি মন্তব্য:

  1. বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ আর এই বিষয়ে এমন ছোট্ট চেহারার অসাধারণ মর্মস্পর্শী গল্প আর পড়েছি কিনা মনে পড়ছে না। অজস্র বক্তৃতা, বিতর্কে যা হয় না, এসব গল্পের দ্বারা সেই কাজ হয়... মানুষের মনের বন্ধ দরজাটা খুলতে বাধ্য করে এমন গল্প।

    উত্তরমুছুন