ক্যামোফ্লেজ
নিঃশব্দ প্রাসাদোপম শুভ্র এ সি ঘর। বেলজিয়াম থেকে আনানো কাঁচের জানালা দিয়ে শীতল ছায়া আলো ঢোকে ঘরের ভিতরে। রূপোর তারের মিনে করা কারুকাজের ভারী সাদা পর্দা। সাদা কার্পেট। সোফা টেবিল চেয়ার বুক সেলফ সবই শুভ্রতায় মোড়া। তিনি সোফায় বসে। সাদা টুপি,আঙুল অব্দি ঢাকা সাদা কুর্তার হাতা,সাদা পাজামা। বুদ্ধি দীপ্ত চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা। পাঁচটা মনিটরে চোখ রেখেছেন। টেবিলে কয়েকটি স্মার্ট ফোন ও তিনটে ল্যান্ড ফোন।
একটি মনিটরে চোখ রেখে একটা মোবাইল তুলে বললেন,’দেখ,লঙ্গরখানায় খানা যেন কম না পড়ে। আর সবমানুষের ফটো ভিডিও তুলে রাখবে। মানুষ গোনা চাইই’।
আরেকটি মোবাইল তুলে বললেন, ‘ঘুর্ণিঝড়ে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার পর্যালোচনায় টিম পাঠিয়েছি স্যার। এমন সাজিয়েছি, কেন্দ্র বাপ বাপ করে তিরিশ হাজার কোটি দিতে বাধ্য। এখন রাখছি’।
অন্য একটি মোবাইলে, ‘কী? ঘর ধ্বসেনি? ভাঙা দেখানো মাস্ট। পরিবার বেরচ্ছেনা? চালাগুলো ফেলার ব্যবস্থা কর। হ্যাঁ মড়াগুলোর হিসেব রাখো। পরিদর্শন হবে। হাসপাতালগুলোর বেডে যেখান থেকে পারো রুগী শোওয়াও।
অন্য একটা মনিটরে চোখ রেখে ফোন উঠিয়ে বললেন, ‘মুনরেকার ইনভেস্টমেন্টের পাঁচ লাখ শেয়ার ঝেড়ে দাও। দেউলিয়া হলে কার বাপের কি’?
আর একটি মনিটরে তখন কোনও একটি জনআন্দোলনের পুরভাগে তাঁর ভাষণ সমানে চলছে। আসেপাশে প্রচুর সর্বহারা বিষন্ন বদনে মানুষজন ভিড় করে আছে। কেউ করজোড়ে কাঁদছে। কেউ পায়ের ধুলো চাটছে। তাঁর মুখের ভাব সর্বমঙ্গলকারী দুঃখনিবারি মহাত্রাতা। নিজের ভাবমূর্তি দেখে তাঁর চোখে জল এলো। পরক্ষণেই হো হো হাসি। ভিখারী লোকগুলো বেশ জব্বর অভিনয় করেছে।
সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মনিটরে চোখ গেল। লাইভ টেলিকাস্ট। সরকারী ইন্টারন্যাশন্যাল এয়ারবাস থেকে একজন নামছে। প্রচুর পুলিশ প্রশাসন। একটি আন্তর্জাতিক আততায়ী। দেখে তিনি সটান উঠে দাঁড়ালেন। মুখের ভাব কঠিন হোলো। তিনটে মোবাইলে সমানে আদেশ দিলেন। জলদি তৈরি হতে হবে। রেসকিউ চাই।
বাথরুমের বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে পোশাক খুলে নগ্ন হলেন। যতবার তিনি শুভ্র পোশাক খোলেন ততবার বিস্মিত ও মুগ্ধ হন। যত দিন যাচ্ছে শরীরের লোমগুলো ঘন কালো চকচকে আর থকথকে হচ্ছে। তত তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তির বিকাশ ও অর্থ প্রতিপত্তি। যেদিন তিনি পলিটিক্সে পা রেখেছিলেন, সেদিন থেকেই শরীরে কী জানি কেন ঘন থোক থোক চুলের উদয় হোলো। সারা শরীর জুড়ে এই বাড়ন্ত লোমের কথা একজনই জানতো। সেই ডাক্তার বলেছিল এটা একটা হাইপারট্রাইকোসিস রোগ। তাকে আর ইহলোকে থাকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন আর কেউ জানে না। এখন উনি খুব যত্ন করেন তাঁর নিকষ কালো লোমগুলোকে। এ তাঁর মন প্রাণ দেহের সম্পদ। এ তো ঈশ্বরের দান! এ তো পয়মন্ত!এই কারণেই তো এই শুভ্রতার ক্যামোফ্লেজ।
তিনি একটু ঝুঁকে দাঁত খুলে হাসলেন। তাঁর ক্যানাইন দাঁত ও গলায় সোনার মোটা চেন সহ হীরের লকেট কুচকুচে কালো লোমের উপর ঝকঝক করে উঠলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন