বাদাম
ভেবে দেখতে গেলে শান্তনু যখন ঠিক করেছিলো যে ও কৃষ্ণনগর টাউন হলের মাঠের বই উৎসবে আসবে, তখনই ওর জানার কথা যে অরিত্রীও ওর সঙ্গী হতে আগ্রহী। কিন্তু বয়সের স্বাভাবিক নিয়মেই কলেজ-ছাত্র শান্তনু যথেষ্ট কেন্দ্রাপসারী এক সত্তা – লেখাপড়ায় তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থান করা এক সিরিয়াস ছাত্রী যে তার হাতে হাত রেখে বইয়ের পাতা ওল্টাতে চাইতে পারে, ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চারদের অন্যতম শান্তনু মিত্র নিজের সিঁদুরে জামের অভিমানে বুঝতে পারেনি।
তাই ফ্যামিলি বুক শপের স্টলে দাঁড়িয়ে যখন শান্তনু “The Three Musketeers”-টা তুলে লন্ডনের গ্লোব থিয়েটারে অভিনীত শেক্সপিয়ারের তেইশটি নাটকের ডিভিডি কালেকশানের বক্সটা – যা তাকে তার প্রথম ও প্রাক্তন প্রেমিকা সুনন্দা এনে দিয়েছিলো, তার বাবার সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণ সেরে ফেরার পথে শান্তনুর নরম বিক্ষত হৃদয়ের স্মারক হিসেবে – আরো কিছুটা সূর্যের শেষ রশ্মির মতো ঝলমলে হলে কেমন জমকালো ভাবে সে তার কলেজে বক্সটা নিয়ে গিয়ে জাঁক দেখাতে পারতো তার কল্পনাপ্রসূত দূর-সম্পর্কের মেজমামার, ভাবছিলো, তখনই অরিত্রী এসে তার কাঁধে হাত রাখতে সে ভালোই চমকে গিয়েছিলো। বইটা হাত থেকে রিফ্লেক্সে পড়ে যাওয়ায় পুনরায় হাতে স্থাপন করে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে শান্তনু একবার মার্জনা ভিক্ষা করলো দোকানদারের কাছে, তারপরে কটমটিয়ে অরিত্রীর দিকে চেয়ে বলল, ‘ক্যালানে নাকি? একটু তো বলতে হয় !’
অরিত্রীর মুখটা একটা মিচকে হাসিতে মাখামাখি হয়ে হার্ড-নোজড গুলির ন্যায়ে বলল, ‘এই সুইমিং পুলের মধ্যে তো কোনোদিন জল ছিলো না, শান…’
‘সুইমিং পুলটাই তো ছিলো না !’
‘তোর এই কন্সট্যান্ট ডিনায়ালই আমাকে ভাবতে বাধ্য করে, আই অ্যাম লাইং ইন দ্য আর্মস অফ আ স্ট্রেঞ্জার !’
‘শেষমেশ আমিও আগন্তুক ?’
হাতে হাতের ব্যারিকেডে লেগে সুস্মিতার অস্ফুট উচ্চারণ, ‘ইফ ইউ কিপ অন হোল্ডিং মাই হ্যান্ড লাইক দিস, আই উইল নেভার লেট ইউ গো !’
যেহেতু বহুদিন ধরেই শান্তনু অরিত্রীকে চেনে, তাই ও এই ধরনের অবাক মন্তব্যে ঘাবড়ালো না – অরিত্রীর বহু কথাই রূপকার্থে বলা স্বভাব। অবশ্য এসব সহ্য করে নেওয়ার ক্ষমতা রাজসূয় যজ্ঞের বাকল শান্তনুর বরাবরই ছিলো – তার জেতার তিতিক্ষা তাকে অবাধে নিষ্ঠুর ও নির্মমও হতে বাধ্য করে, বহু সম্ভাবনাময় ঘোড়ার হাঁটু ও অত্যন্ত বুদ্ধি খাটিয়ে, আইন বাঁচিয়ে, সূক্ষ্ম কলাকৌশল লাগিয়ে ভেঙে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। অরিত্রী নিজের আলোকসামান্য বিভ্রমের অপাক অস্তিত্বের ছটায় চারিদিক ঝাঁঝিয়ে দিয়ে যখন শান্তনুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো আনন্দ পাবলিশার্স-এর স্টলের দিকে ‘সুনীলের নীরা সিরিজ কিনে দিবি বলেছিলি…’ বলতে বলতে, তখন পড়ন্ত বেলার নিয়নের আলোয় মা-হারা ক্লান্ত শিশু চিতল হরিণের মতো উবু হয়ে বসা সময়ের ধাঁধাঁয় মানে হারিয়ে ফেলা বইপ্রেমী কম, আর সব বেশি লোকের মধ্যে নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করে না দেওয়ার কোনো কারণ দেখছিলো না শান্তনু।
নিজের হাওয়াই শার্টটার মধ্যে নিজেকে অপাঙ্গে গলিয়ে নিতে নিতে শান্তনু যখন ক্রমশ মিশতে শুরু করেছিলো ভিড়ে, স্বভাব দোষে অরিত্রী ওর জামার হাতা টেনে বলল মেলার মাঝখানের দিকে মৃদু হাস্য-সম্বলিত কচি শ্যামলা মিষ্টি মুখটা যে ভীষণ টাটকা টিনের কৌটোয় দাঁড়িয়ে চিনাবাদাম বিক্রি করছে, তার বিক্রির পয়সা কিছুটা বাড়াতে।
নিঃসন্দেহেই শান্তনু রাজি হল। বাদামের দাম মেটাতে মেটাতে আর গড়িয়ে পড়া তিলের তেল যাতে আনন্দের লাল প্যাকেট না ভিজিয়ে ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখতে রাখতে, শান্তনু হঠাৎ-ই – খুব সম্ভবত অরিত্রীর চোখে নিজের মহানুভবতা প্রমাণ করার জন্যই – ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘থাকিস কোথায় রে? বাড়ির খবর কী ?’
ছেলেটা চোখে বিষণ্ণতা ও মুখে হাসি নিয়ে করিমপুরি টানে বলতে শুরু করলো, ‘জানেন স্যার, বাবার খুব অসুখ। মা ভেগেছে পাশের বাড়ির কাকুর ছেলেকে নিয়ে ধানবাদে। গ্রামে ডেইলি বছরের বন্যাটা এ বছর একটু বেশিই জোরে এসেছে, ফসল উঠলো না ভালো করে। ঠাম্মা বেঁচে থাকতে বলতেন শিষের ডগায় সোনালী রঙ ধরা মাত্রই কাটা শুরু করবি কিছু, তাহলে অনাহারে মরবি না – তা এ বছর মরাই পাকতে না পাকতেই জলে ডুবে গেলো খেত। জানেন…’
প্রেম ও রাজসূয় এখন বাড়তি। বাংলার বুকের দাগহীন এক জোড়া যুবক-যুবতী নিজেদের আত্মকেন্দ্রিকতা পেরিয়ে এখন অপরাজিতা ফুলের মতো কালচে-নীলাভ মহাকাশের বুকে বিছিয়ে থাকা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে জমে আসা মানুষের ক্ষোভ ও অপ্রাপ্তির ইতিহাসের মধ্যে একাত্ম বোধ করতে শুরু করেছে – তাদের একাকীত্ব, অবসাদ সব এখন তুচ্ছ। রোমান্সের চেয়ে কষ্ট অনেকটাই বেশি রোম্যান্টিক। শ্মশানে শকুনের অতন্দ্র তত্ত্বাবধানে চুরুটের সুখটানে মনুষ্যত্বের চোখে যাম নামছে।
হাতের তিলের তেলের গরম ভাজা চিনাবাদাম হাতেই ঠাণ্ডা হতে থাকলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন