মেরুদন্ড
‘ইহার দ্বারা ইহাই প্রমাণিত হইল যে, সুজনবাবুকে যে মেরুদন্ডহীন মানুষ বলা হইয়া থাকে তাহা ঠিক নহে, বরং বলা যাইতে পারে, সুজনবাবুরও একটা মেরুদন্ড আছে; তাহা দুর্বল হইতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনে কখনও সখনও সবল হইয়াও ওঠে’।
বস্তুত কোনো মানুষেরই মেরুদন্ড আমি স্বচক্ষে দেখিনি। পিওর সায়েন্সের ছাত্র ছিলাম। বায়োসায়েন্স পড়লে ভবিষ্যতে ডাক্তারি পড়ার একটা সুযোগ জুটে যেতে পারত। আর তাই যদি হতো, তাহলে নিজের চর্মচক্ষে মানুষের মেরুদন্ড দেখারও সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু জীবনে যা ঘটেনি, তা ঘটেনি। কারও মেরুদন্ড নিয়ে আমার কোনো চিন্তাভাবনা বা মাথাব্যথাও ছিল না। এমনকি নিজের মেরুদন্ড নিয়েও নয়। কিন্তু ইদানিং আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে চলেছে, আগেও ঘটত, তা অনেকেরই কাছে অন্যায় অবিচার বলে মনে হচ্ছে। তা সে জাতি-বর্ণ-ধর্মের রাজনীতিকরণেই হোক বা রাজনীতিকে জাতি-বর্ণ-ধর্মে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েই হোক, সামাজিক ও পারিবারিক অনাচার ও দুষ্কর্মের কারণেই হোক অথবা শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন দমননীতির প্রেক্ষিতেই হোক। মোটামুটিভাবে প্রচলিত সবরকম বিভাজনের তালিকায় সম্প্রতি নথিবদ্ধ করা হয়েছে একটি নতুন বিভাজননীতি, যথা মেরুদন্ডযুক্ত মানুষ এবং মেরুদন্ডহীন মানুষ। যাদের সহ্যশক্তি কম, কোদালকে কোদাল বলেই মনে করে, তারা মেরুদন্ডযুক্ত; আর যারা নিছকই শান্তিপ্রিয়, চাপে পড়লে কোদালকে খুরপি বলে মেনে নিতে পারে, তারা মেরুদন্ডহীন।
তা কথাটা হচ্ছিল আমাদের সুজনবাবুকে নিয়ে। তিনি নামে সুজন, কিন্তু কোদালকে খুরপি বলে মেনে নেওয়ার কারণে তিনি নিজেকে মেরুদন্ডীহীন প্রতিপন্ন করেছেন। কিছুদিন আগে পাড়ারই মেয়ে লক্ষ্মীকে যখন উঠিয়ে নিয়ে গেছিল হাবিবগুন্ডার দল, সুজনবাবুর তার সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু কোর্টে কেস উঠলে তিনি সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অজুহাতে যেদিন সেই এলাকারই একদঙ্গল সমাজবিরোধীতত্ত্ব আগুন লাগিয়েছিল মুসলিম বস্তিতে, ঘটনাচক্রে তারও তিনি অন্যতম আইউইটনেস ছিলেন। অথচ ঘটনার প্রতিবাদে যে বিক্ষোভমিছিল বেরিয়েছিল, তিনি তাতে সামিল হননি, এমনকি পুলিশি এনকোয়ারিতেও তিনি ঘটনার দিন শহরের বাইরে ছিলেন বলে দাবি করেছিলেন।
না, শুধু সুজনবাবুকে নিয়ে কারও তেমন কোনো শিরঃপীড়া নেই। আমার তো নেইই। আসলে আমাদের অনেকেরই মেরুদন্ড ওই সুজনবাবুর মতোই তো! নিজের ফুটো উন্মুক্ত রেখে অন্যের ফুটো বন্ধ করার কথা ভাবাও হাস্যকর।
একটা ঘটনা ঘটল। সুজনবাবুর বড়ছেলে আমার ছেলেবেলার বন্ধু লাল্টু প্রেমে পড়েছিল রেহেনার। আমরা কিছুই জানতাম না। জানার কথাও নয়। এসব কী আর সবাইকে জানিয়ে হয়! তাছাড়া রেহেনা লাল্টুর স্বধর্মের নয়। রেহেনা আমারও বন্ধু। আমি লাল্টু রেহেনা একইসঙ্গে স্কুলে ও কলেজে পড়েছি। আমাদের পাশের মুসলিম পাড়ায় থাকত। অদূর ভবিষ্যতে লাল্টু ও রেহেনার সম্পর্কের পরিণাম কী হতে পারে, জানি না। কিন্তু সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি গতরাতে রেহেনা গণধর্ষিতা হয়েছে। ধর্ষণ করেছে তারকগুন্ডার দল। একটা দাঙ্গার পরিস্থিতি চারিদিকে।
দিন সাতেক পরে লাল্টুর ফোন পেলাম। তুই আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসিস। লাঞ্চ একসঙ্গে করব।
-সে কী! কী ব্যাপার?
-আমি ও রেহেনা বিয়ে করেছি।
- মানে? আর তোর বাবা?
-বাবাই পার্টি দিচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন