বেলাশেষে
টিকিট কেটে ঘুরতেই পিছনে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্কার দিকে চোখে পড়ল। কিছুক্ষণ আগেও দেখেছি ইতস্তত ভঙ্গিতে দু’তিন কাউন্টার ঘুরছিলেন। শেষে দিনাজপুরগামী বাসের কাউন্টার থেকেই উনি টিকিট কাটলেন। গরমে তেতে ওঠা মধ্যবয়সী ফর্সা থমথমে মুখটা কেন যেন আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখলো তার কাছাকাছি। দিনাজপুর, কোথায়? টিকিটবিক্রেতার প্রশ্নে উদাস তাকিয়ে কিছু সময় পর উত্তর করলেন, লাস্ট স্টপেজে। আমার গন্তব্যও দিনাজপুর। দু’চার প্যাকেট চিপস আর মিনারেল ওয়াটার কিনে বাসে উঠতে ফের তার মুখোমুখি। টিকিট মিলিয়ে সিট খুঁজছেন। ছোট একটা হাতব্যাগ ছাড়া সাথে আর কিছু নেই। নিজের ছোট কিটব্যাগটা জায়গায় রাখতে রাখতেই খেয়াল করলাম পাশের সিটে বসে হাতব্যাগের আতিপাতি ঘেঁটে তিনি কিছু একটা খুঁজছেন। কিছুক্ষণ পর মোবাইল ফোন বের করে সামান্য নড়েচড়ে স্থির হয়ে বসলেন।
- কিছু মনে না করলে জানলার ধারের সিটটায় কি বসতে পারি?
দেখি, সোজাসুজি তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে। ওনার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সামান্য সরে তিনি জানলার ধারে বসলেন। বাইরে চোখ রাখলেন। বাস কিছুদূর এগুতে, জিজ্ঞেস করি, দিনাজপুরের কোথায় যাচ্ছেন? উত্তর না করে তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে ফের বাইরে চোখ রাখেন। ছলছলে চোখ, আমার দৃষ্টি এড়ায় না। ওদিকে তার মোবাইল ফোন বারবার বেজে উঠছে। প্রতিবার তিনি কাটছেন। কী এক অস্থিরতায় যেন তিনি আক্রান্ত। শেষে ফোনের সুইচ অফ করে ব্যাগে রেখে দিলেন। অচেনা কাউকে নিয়ে অযাচিত আগ্রহকে চোখ রাঙিয়ে নিজেও এবার ম্যাগাজিন খুলে বসি।
কিছুক্ষণ পর তিনি বলে ওঠেন, আপনি দিনাজপুরেই থাকেন?
হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ফিরতি প্রশ্ন ছুড়ি, আপনি?
- ঢাকা। কী নাম আপনার?
- ঐন্দ্রিলা। ঢাকায় একটা অফিসিয়াল কাজে এসেছিলাম। আপনি? বেড়াতে?
নিরুত্তর তিনি। ব্যাগ খুলে ফোন বের করে পাওয়ার অন করতে করতে বললেন, ফোন বন্ধ করলাম, কিন্তু ছেলেটা পাগলের মতো ফোন করেই যাবে।
- বলে আসেননি?
- না।
- রাগ করে বেরিয়েছেন?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, তিনি। অনেকটা দূর থেকে উত্তর করেন, আজ আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে। হতভম্ব হয়ে তাকাই, ছেলের বিয়ে আর আপনি দিনাজপুর যাচ্ছেন? ম্লান হাসেন তিনি। কী বুঝে তিনি আমার দিকে ফেরেন। বলেন, অনেক কষ্ট করে ছেলেটাকে একা বড় করেছি জানেন। বিয়ের পরের বছরই ছেলের বাবা আমাদের ফেলে পালিয়েছিল। তারপর থেকে আজ অবধি একাই তো, অথচ...
কোথাও হারিয়ে যান তিনি।
কী বলব না বুঝে চুপ থাকি। আপনমনেই বিড়বিড় করেন, এত বছরের কষ্ট, খেয়ে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়া, সমস্তকিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে ছেলেকে বড় করা, তার পড়াশুনো, সব এক নিমিষে মূল্যহীন হয়ে গেল..বিবাহের চুক্তিপত্রে আজও সবার আগে বাবার নাম লিখতে হয়!
একজীবনের রণাঙ্গনে এতদিন কোথায় ছিল সে? পিতৃপরিচয়? কোন অধিকার বলে?
এদের মাঝে আমার থাকার প্রয়োজনই বা কি!
বেলাশেষের আকাশটা হঠাৎ কেমন কালো হয়ে ওঠে।
তার হাতের মোবাইল ফোনটা একটানা বেজেই চলেছে..
গভীর
উত্তরমুছুনভাবনার বিষয়
উত্তরমুছুন