নিছক গল্প নয়
সূর্য পাটে বসার আগেই পলি চলে এসেছে নির্জন বটগাছটার তলায়। শেকড়ে পা ছড়িয়ে বসতেই দেখতে পেল কচুড়িপানা ঢাকা বিশাল পুকুরের কালো জলের ওপর জেগে উঠেছে প্রকাণ্ড কালো মাথা আর দুটি গভীর চোখ। তার মানে দূর থেকেই ওর পায়ের শব্দ বা গায়ের গন্ধ ঠিক টের পেয়েছে টিক্কা। মুঠো থেকে মুড়িগুলো ছড়িয়ে দিতে গিয়ে পলির দুচোখে জলের ধারা। আজ আর গল্পই করতে পারলো না ওর সঙ্গে।
এগারো বছরের পলির অনেক বন্ধু--ঘোষপুকুরের এই দশসেরি কাতলা টিক্কা, রেবাদের বাড়ির দীঘলচোখের শামলিগাই যে ওকে দেখলেই আদরের ডাক দেয়- হাম্বা, পাড়ার লালু-ভুলু-রাঙা-- রাস্তায় বেরোলেই পায়ে পায়ে-সঙ্গে ঐকতান,কার ডাক কোনটা একমাত্র জানে পলিই ,বাড়িতে একপাল বেড়াল--সবসময় আদরে গলে পড়ে ওকে দেখলেই।
মাঠপাড়ার ভ্যানরিক্সাচালক হারু মণ্ডলের মেয়ে এমন গোত্রছাড়া হ’ল কী করে কে জানে? ছোট্ট থেকেই ওর প্রাণের বন্ধু এরাই। ওদের সঙ্গে রোজ গল্প করা চাই-ই ওর। তৃতীয় শ্রেণিতে অনেক কষ্টে লেখাপড়া টেনে নিয়ে গিয়ে এত ক্লান্ত যে আর ওকে স্কুলমুখো করানো যায়নি। পরের দুটো ভাই স্কুলে যায়। মিড ডে মিলে চলে যায় তাদের। ভোরে বাবা বেরিয়ে পড়ে ভ্যানরিক্সা নিয়ে। মাও চলে যায় সকাল সকাল ইছামতীর পাশে তপার চরে। সেখানে গলদা চিংড়ি ছাড়নোর কাজ করে বহু মেয়ের সঙ্গে। কেজি দশেকের কাজ করতে পারলে সেদিনের চাল-ডাল-তেল-নুনের উপায়টা হয়ে যায়। সকালে তাই ব্যস্ততার শেষ নেই পলির। বাসন মাজা শেষ করেই কলসি নিয়ে বাবুপাড়ার কাছে টাইমের জল ধরতে ছোটা, ফিরে এসে ঘর লেপা, রান্না করা। মা ভাত নিয়ে চলে যায় আড়তে। মুশকিল হয় লালু-ভুলু-রাঙাদের নিয়ে। ওরা এমন করে ঘিরে ধরে যে কলসি নামিয়ে রেখে আদর করতে হয় ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে। মা এক এক দিন দেরির জন্য চড়-থাপ্পড় কষিয়ে দেয়। মা ভাত, একটা তরকারি করে নিয়ে বেরিয়ে গেলে পলি আগের দিন মায়ের কোল আঁচলে লুকিয়ে আনা চিংড়িকটা নিয়ে বসে। নুন হলুদে জ্বাল দিয়ে রাখা মাছগুলি ঝোল করে। বাবা দুপুরে খাবে, রাতেও হবে। ভাইদুটো স্কুলে বেরিয়ে গেলে। শুরু হয় বেড়ালদের দাবি। মাছের একটুখানি ঝোল মাখিয়ে ভাত দেওয়ামাত্র চেটেপুটে সব শেষ। তারপরে ওদের আদর করতে করতে কেটে যায় অনেকটা সময়। বাবার ভ্যানরিক্সার শব্দ শুনে লাফিয়ে ওঠে পলি। সর্বনাশ ! দুটোর ট্রেন কখন বেরিয়ে গেল শব্দই পায়নি! তাড়াতাড়ি মেঝেতে ঠাঁই করে বাবাকে খেতে দিয়ে চান করতে ছোটে পলি। কাপড় কেচে, চান সেরে ফিরে এসে খেয়ে, বাসন মেজে উঠতে চারটে বেজে যায়। বাবা সেই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার বেরনোর তোড়জোড় করে ততক্ষণে।
পলির সময় বাড়ন্ত। রোজ। বিকেলের আগে আসতে চাইলেও হয়ে ওঠে না। টিক্কা ওর জন্য অপেক্ষা করে। ছুটতে ছুটতে এসে বটের শেকড়ে বসতেই ভেসে ওঠে সে। আহা! ক্ষিদে পায়না বুঝি ওর ! সঙ্গে আনা মুড়িগুলি ছড়িয়ে দেয় ঘাটের কাছের ফাঁকা জায়গাটায়। টিক্কা কেমন ভেসে ভেসে এগিয়ে এসে কপ কপ করে খায় আর পলি গল্প জোড়ে তার সঙ্গে।
কালই পলিকে ওর মা পাঠিয়ে দিচ্ছে অনেক দূরে। কলকাতার কোন এক বাবুর বাড়িতে। সেখানে থাকা খাওয়া আর বাচ্চা দেখাশোনার কাজ। মাসান্তে মাইনের দু হাজার টাকা পলির মা গিয়ে নিয়ে আসবে আর মেয়েকে দেখেও আসবে। পলির দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে। ওর এই টিক্কা, ওর বেড়াল তিনটে আর তাদের ছানারা, ওর লালু-ভুলু-রাঙারা, ওর গল্প করার, আপন মনে কথা বলার জন্য কেউ নেই, কিচ্ছুটি নেই সেখানে।টিক্কা বোধহয় ওর কান্না টের পেয়েছে। সে ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে এসেছে একেবারে ঘাটের কাছে। কিছু বোধহয় বলতে চায় ও। পলি আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়, একটার পর একটা সিঁড়ি নামতে থাকে।
সূর্য ডুবে গিয়েছে। অন্ধকার তার ডানা ছড়িয়ে দিয়েছে কখন!
ভালো লাগলো । বিশেষত মাছের মুড়ি খাওয়া। পলি সবাইকে ছেড়ে কিভাবে শহরে থাকবে, ভেবে মন খারাপ হল।
উত্তরমুছুন