ধবলী
লাইব্রেরীর পুরোনো বইয়ের গন্ধ। মোহিত হয়ে যাই। মনে হয় এই জ্ঞানের পৃথিবীটা আমার চিরন্তন,জন্মজন্মান্তর। এটা আমার একার। লক ডাউন ওপেন হয়েছে ঠিকই,কিন্তু লাইব্রেরীতে কজন বা আসে? বড় গোলটেবিলটাতে বাসী নিউজ পেপারগুলো ছড়ানো। বইয়ের তাকের মাঝে অন্ধ গলি। এই সাত সকালেও ভিতরটা আঁধার। লাইব্রেরিয়ানকে দেখছি না। ভেতরে একজনকে অন্ধকারে বসে নিচের তাকে উবু হয়ে বসে বই হাতড়াতে দেখলাম। আমার মাস্ক চশমা গ্লাভস। ওর কিছুই নেই। আমি একটু দূরেই রইলাম। কম বয়েসী রোগা। হাতে দুটো বই। কাছে আসতে বুঝলাম ওটা মেয়ে। বুক পেট সমান। চুল ছেলেদের মতো ছাঁটা। ও এগিয়ে আসে। আমি ওর খোলা হাঁ মুখ দেখে পিছিয়ে যাই। ও দাঁত বের করে হাসে।
-ঘাবড়ে যাচ্ছেন স্যার? চিন্তা করবেন না। ও আমার আগেই হয়ে গেছে।
-কি হয়ে গেছে তোমার?
-ওই, যে বিষ রোগে আপনার আতঙ্ক? আমি তো পষ্ট আপনার চোখ দেখে বুঝেছি। ওই রোগ তো আমাকে তিন মাস আগে ধরেছিল। আমার শরীরে কি ওসব থাকতে পারে? আজ অব্দি অমন কয়েকটাই তো ধরেছে আর সরসর করে নেমে গেছে। যেমন পুলিশের খাতায় দাগীর নাম? তেমনি গবেষণাগারে আমার নাম। আমি তো গিনিপিগ গো? পরহিত তরে।
আমি ভয়ে সিঁটিয়ে যাই। দুপাশের বইয়ের তাকগুলো যেন ওই মেয়েটার কাছে আমাকে ঠেলে দিতে চাইছে। আমি পিছিয়ে এলাম।
-মিথ্যেই ভয় পাচ্ছেন স্যার। না আপনার কিছু আমার থেকে হবে, না আমার কিছু হবে। এই তো দুদিন আগে হাসপাতালে রক্ত দিয়ে এলুম। ওরা বলছিল, কোভিড থেকে সেরে যাবার পর আমার রক্তের সিরামে জীবনরস বেড়েছে। সুপার এন্টিবডি। ইউ নো এন্টিবডি?
আমি ওর চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। দেখে তো মনে হয় পাঁড় দেহাতী। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে যে ঘর মোছা বাসন মাজা করে,সেই ঠিকে ঝিটার মত অবিকল। এতো দেখি বিদুষী। আমি ঘাড় নাড়লাম।
-আমার এই কালো শুঁটকো গায়ের ভিতর ওই এন্টিবডি ছাড়াও বইছে আরো কিছু। যেটা ধবলী খুনকে লাল করে দেয়। রক্ত চন্দন বইছে দেহে। আমার হৃদয় যত ওটা ঘষা খাবে ততই নিখার। ফ্লুরোসেন্ট। সিন্টিলেটেড। চকমকে। কেন জানেন স্যার? পরহিত তরে। আমি নিডি মানুষের কাছে যাই, খলবল করে তার বিষ নেমে যায়।
আমার খুব কাছে এসে দুটো বই দু হাতে তুলে নাচতে লাগলো। -ধবলী ধবলী সার/ধবলীকে ধরিলে বিষ নাহি আর/ছাড়ে মাংস ধবলী ঘাটে/ধবলী ধরিবো তাহে বিষ নাহি উঠে।
ছড়া গাইতে গাইতে জিভ ছুঁচলো করে শীষ দিতে লাগলো। দেখলাম হাতে ধরা বহু পুরোনো জীর্ণ বইদুটো। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা তন্ত্র। আর অন্যটি কামাক্ষ্যা তন্ত্রসার। ও নাচতে নাচতে থামলো।
-আরশোলা। জানেন তো স্যার? কোটি কোটি বছর ধরে লুকিয়ে ঘরকুনো ভীতু কোয়ারেণ্টাইন হয়ে থাকতে থাকতে নোংরা এই প্রাণীটার রক্ত সাদা হয়ে গেছে। কোনো রোগ একে স্পর্শ করে না। এমনকি ভয়ানক রেডিয়েশনে পৃথিবীর সব মানুষ মরে গেলেও এর কিছু হবে না। পৃথিবীর বুকে সর সর করে ঘুরে বেড়াবে,ফর ফর করে দাপিয়ে বেড়াবে। কারণ? ওইযে বললাম স্যার, ধবলী। ধবলী।
মেয়েটা হাতদুটো ডানার মত ছড়িয়ে দিয়ে নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল। কি বলে গেল ও? তন্ত্র মন্ত্র? রক্তের দূষণ না ইমিউনিটি? দীর্ঘ বারবার কোয়ারেন্টাইনে রক্ত সাদা হয়ে যাবে? মানুষের? ধবলী কি কি কি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন