শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

সম্পাদকের নিবেদন

সম্পাদকের নিবেদন


বাংলা সাহিত্যে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (জন্মঃ ১৯ মে ১৯০৮ - মৃত্যুঃ ০৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬) স্থান এক  বিচ্ছিন্ন পর্বতশৃঙ্গের মতো, কারোর সঙ্গে তাঁর মিল নেই, আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। মানুষ সমাজকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণে চিত্রিত করেছেন তিনি, যার তুলনা একমাত্র তিনি নিজেই।

কল্লোল যুগের তরুণ সাহিত্যিকরা তখন বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিয়েছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন বস্তি মানুষদের জ্বালা যন্ত্রণা। শৈলজানন্দ এনেছেন কয়লাখনির মানুষদের। চাষী, খনি-শ্রমিক, দালাল, ভবঘুরে, সর্বহারাদের চরিত্রগুলি তখন কল্লোলের লেখকদের কলমে জীবন্ত হচ্ছে। বাংলা সাহিত্য যখন এক নতুন মোড়ে পৌঁছতে চলেছে, এরকম যুগ সন্ধিক্ষণে খুব সহজভাবে একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে প্রবেশ করলেন মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যে বাস্তবতা প্রসঙ্গে তাঁর ছিল একটি নিজস্ব জীবনদর্শন : “… ভদ্রজীবনের সীমা পেরিয়ে ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল নীচের স্তরের দরিদ্র জীবনের সঙ্গে। উভয় স্তরের জীবনের অসামঞ্জস্য, উভয় স্তরের জীবন সম্পর্কে নানা জিজ্ঞাসাকে স্পষ্ট জোরালো করে তুলতো। ভদ্রজীবনে অনেক বাস্তবতা কৃত্রিমতার আড়ালে ঢাকা থাকে, গরীব অশিক্ষিত খাটিয়ে মানুষের সংস্পর্শে এসে ওই বাস্তবতা উলঙ্গরূপে দেখতে পেতাম। কৃত্রিমতার আবরণটা আমার কাছে ধরা পড়ে যেতো। মধ্যবিত্ত সুখী পরিবারের শত শত আশা আকাঙ্খা অতৃপ্ত থাকার, শত শত প্রয়োজন না মেটার চরম রূপ দেখতে পেতাম নীচের তলার মানুষের দরিদ্র পীড়িত জীবনে।…”

জীবন পৃথিবী সম্পর্কে এই বিশেষ জিজ্ঞাসা নিয়েই তিনি লিখেছেন ৩৭টি উপন্যাস প্রায় ২০০ মতো ছোটোগল্প। তাঁর মানসিক রাজনৈতিক বিশ্বাসের ধারাবাহিক বিবর্তনের ছবি খুঁজে পাওয়া যায় সব গল্প উপন্যাসে।

মাণিকের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলির মধ্যেপ্রাগৈতিহাসিকহারানের নাতজামাইদুই বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত। প্রথমটিতে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্বের প্রভাব অনুভব করা যায়। ভিখু পাঁচীর মধ্যে যে সম্পর্ক তা পরিবেশগতভাবে বাংলা সাহিত্যে নতুন।

হারানের নাতজামাইছোটো বকুলপুরের যাত্রীগল্প দুটিকে অনেকেই যুগের জীবনমুখী সাহিত্য আন্দোলনের ইতিহাসে দুটি মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত করেন।

তাঁর উপন্যাসগুলিতে জীবনের বহু বিচিত্র রূপ রঙ রস উদ্ভাসিত হয়েছে।পদ্মানদীর মাঝিতে আমরা দেখি, অভিনব পটভূমি চলমান পদ্মার তরঙ্গিত বুকে ক্ষুদ্র মানবজীবনের ক্ষণস্থায়ী লীলার অপরূপ সৌন্দর্য ক্ষুধা কামের দুরন্ত আকর্ষণ বিকর্ষণ।

পুতুলনাচের ইতিকথাপ্রসঙ্গে মাণিক নিজে বলেছিলেন : “এই বইখানা মানুষকে যারা পুতুলের মত নাচায় তাদের বিরুদ্ধে দরদী প্রতিবাদ। প্রচণ্ড বিক্ষোভ নয়, স্থায়ী দরদী প্রতিবাদ।…” এই উপন্যাসের একটা বড় দিক হচ্ছে, প্রতিটি চরিত্রের টানাপোড়েনে সব দিক দিয়ে উপন্যাসটি আধুনিক। শশী ডাক্তারের ফ্রাস্ট্রেশন যেকোনো আধুনিক মানুষের ফ্রাস্ট্রেশন। তার জন্য অপেক্ষা করছিল একটা বিরাট বিশ্ব, যা সে দেখেনি, অথচ দেখবার ইচ্ছাটা ষোল আনা ছিল। অবস্থার প্রতিকূলতায় সারাটা জীবন যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বন্দী হয়ে তাকে কাটাতে হয়। 

জননী’, ‘দিবারাত্রীর কাব্যথেকেশহরতলী’, ‘শহরবাসের ইতিকথাথেকেসোনার চেয়ে দামী’, ‘শুভ-অশুভথেকেহলুদ নদী সবুজ বন’… — সর্বত্রই মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নিপুণ শল্য চিকিৎসকের মতো তন্ন তন্ন করে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থার প্রকৃত সুরটি নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রকাশ করেছেন। 

একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পর্ধিত সম্রাটের মতো চিরকাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেন।


রঙিন ক্যানভাস’-এরজন্মদিন সংখ্যাপ্রকাশিত হল। সকল লেখক পাঠককে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা অভিনন্দন। 

সকলে ভালো থাকুন। 


রোশনি ইসলাম

সোনালি বেগম 

 

1 টি মন্তব্য:

  1. প্রথমেই অভিনন্দন জানাই সম্পাদিকাদ্বয়কে যারা এই কর্পোরেটশাসিত সময়ে দাঁড়িয়েও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রাসঙ্গিক আলোচনার স্তরে নিয়ে এসেছেন। ছোট লেখা হলেও মাণিকবাবুর লেখালিখির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো উঠে এসেছে যথাযথ। ধন্যবাদ জানাই আবারও এবং অকপট। রঙিন ক্যানভাস আরও বেশি গ্রহণীয় হয়ে উঠুক পাঠের প্রযত্নে, সেই প্রত্যাশা রাখি। সাহিত্যানুরাগী মনগুলো সজীব ও সক্রিয় থাকুক অনেক দীর্ঘ সময়জুড়ে। শুভেচ্ছা চ

    উত্তরমুছুন