মানাওয়াকার রূপকল্পে নীপাওয়ার ‘পিগম্যালিয়ন’
ধড়বিহীন গতরের চরণ দুটি দাঁড়িয়ে আছে মরুভূমির ‘পরে। বালিতে অর্ধপোঁতা অবস্থায় কাছেই পরে আছে ছিন্নভিন্ন মস্তক। দুই ভুরু কোঁচকানো; এককালের উপহাসের হাসিতে পারঙ্গম এক জোড়া জীর্ণ ঠোঁট বিকিরণ করছে বীভৎস চাহনি। সেই দাপুটে শরীরের অবশিষ্ট প্রত্যঙ্গের নেই কোনো অস্তিত্ব। বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের পরিবৃত্তে অচেনা বালির এই এক অন্তহীন সাম্রাজ্য, যেখানে বহাল তবিয়তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি পাদবেদী, যার জঠরে এখনো জড়িয়ে আছে অহংবোধে পরিপূর্ণ একটি পুরুষ হৃদয়ের উপহাসবাণী, “আমার নাম ওজিম্যান্ডিয়াস, আমি রাজাদের রাজা; আমি পরাক্রমশালী। আমার কাজ দেখো; আমার কর্মপ্রতাপে তোমরা আতংকিত হবে।“
ইংরেজ কবি পার্সি বিশ শেলীর (১৭৯২—১৮২২) ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’ কবিতার কথামালা দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের প্রবন্ধের প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদ। আলোচিত ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’ হচ্ছে ১৯তম রাজবংশের মিশরীয় ফারাও দ্বিতীয় র্যামসেসের (খ্রিস্টপূর্ব ১৩০৩—খ্রিস্টপূর্ব ১২১৩) গ্রীক নাম। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সিকুলাস (খ্রিস্টপূর্ব ৯০—খ্রিস্টপূর্ব ৩০) রচিত গ্রন্থে উদ্ধৃত দ্বিতীয় র্যামসেসের একটি বিশাল মূর্তির কিছু বিধ্বস্ত টুকরো এবং তাঁর একটি বাণীকে উপজীব্য করে রোম্যান্টিক কবি শেলী রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস-ভিত্তিক সনেট ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’। এই ফারাও দ্বিতীয় র্যামসেস ৬৭ বছর (খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৯–খ্রিস্টপূর্ব ১২১৩) একটানা (আমৃত্যু) ক্ষমতায় থেকে নাটকীয়ভাবে মিশরের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করেছিলেন। মিশর জুড়ে অসংখ্য নান্দনিক স্থাপনাসহ নিজের বেশ কিছু মূর্তিও তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরও, তিনি তাঁর তৈরি করা সমস্ত স্থাপত্যের মাধ্যমে একটি স্থায়ী এবং প্রতাপশালী উত্তরাধিকার রেখে যাবেন।
নাইল (নীল) নদীর পশ্চিম তীরে ‘সিটি অফ দ্য ডেড’ খ্যাত লাক্সোর নগরীর নেক্রপলিস সমাধিপাড়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত র্যামসেস যাদুঘরে মূর্তিটির সন্ধান পাওয়া যায়। রক্তিম গ্রানাইট পাথরে নির্মিত খ্রিস্টপূর্ব ১২৭০ সালে স্থাপিত ৮০ ইঞ্চি প্রশস্থ ও ১০৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই ভাস্কর্যের ওজন ছিলো ৭.২৫ টন, যার গায়ে খোদাই করা একটি বার্তা ছিলো এই রকম:
"King of Kings Ozymandias am I. If any want to know how great I am and where I lie, let him outdo me in my work."
শেলীর কবিতাটি ১১ জানুয়ারী ১৮১৮ প্রকাশিত হওয়ার তিন বছর পর, মহাপরাক্রমশালী এই ফারাওর ভগ্ন মূর্তিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রবেশ করে ১৮২১ সালে; শেলী সম্ভবত সিকুলাসের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে এই 'রাজাধিরাজ' সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছিলেন। অহংকারী রাজার শিলালিপিটি দাম্ভিকতাপূর্ণ হলেও সময় তাঁর দিকে ছুঁড়ে মেরেছে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। সেই হাসির উত্তাল তরঙ্গে কেবল এই মূর্তিটিই ধ্বংস হয়নি, পুরো রাজ্যটিও মানচিত্র থেকে খসে গিয়ে মিশে গেছে বালির মরুস্রোতে। ‘মরুভূমি’র মতো একটি শক্তিশালী চিত্রকল্প ব্যবহার করে শেলী তাঁর পাঠকদের কাছে নির্মম বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে – ইতিহাসের পাতা সমৃদ্ধ হয় সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনে। কোন ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়, একজন শাসক নিজেকে যতই সর্বশক্তিমান বলে মনে করুন। শুধু রাজা নয়, ‘রাজাদের রাজা’ও একদিন হয়ে যেতে পারেন একটি ‘প্রাচীন ভূমি’র বিস্মৃত অবশেষ ।
রাজা ওজিম্যান্ডিয়াস এবং তাঁর রাজ্য ধূলিকণা হয়ে যাওয়ার পরেও, প্রাণহীন পাথুরে বেদিতে খোদাই করা শব্দগুলো এখনো টিকে আছে প্রাণবন্ত হয়ে। এই শিলালিপিটি বেঁচে না থাকলে ওজিম্যান্ডিয়াসের নাম বা তাঁর দাম্ভিকতার কীর্তনকথা গ্রীক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সিকুলাসের পক্ষে জানা সম্ভব ছিলো না। সভ্যতার ইতিহাস সংরক্ষণে রাজনীতির চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ও স্থায়ী হাতিয়ার হিসেবে ভাস্কর্য-শিল্পের উত্থান হয়েছে শেলীর এই কবিতায়। ভাস্করের দক্ষতার কারণে ক্ষয়ে যাওয়া ভাস্কর্যের খণ্ড খণ্ড প্রতিটি টুকরো রূপান্তরিত হয়েছে একজন জীবন্ত অখণ্ড ফারাওর অহংলিপিতে। কবিতায় ব্যবহৃত মরুভূমির বালির উপরে মস্তকের বিচূর্ণতা, চেহারার বীভৎসতা, কুঁচকানো ঠোঁট ইত্যাদি চিত্রকল্পগুলোর মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে একজন অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ব্যক্তিত্ব ও ব্যঙ্গার্থক আবেগ। ব্যক্তির মৃত্যুর পরও তাঁর ব্যক্তিত্বকে জীবিত রাখার মাধ্যম হিসেবে একজন ভাস্কর্যশিল্পীর ক্ষমতাকে অসাধারণ উচ্চতায় আসন দিয়েছে এই কবিতা।
আমরা আরেকটি ভাস্কর্যের সন্ধান পেয়েছি জীন মার্গারেট লরেন্সের (১৯২৬ – ১৯৮৭) ‘দ্য স্টোন এঞ্জেল’ (১৯৬৪) উপন্যাসে। কাহিনিকার লরেন্সের জন্মস্থান ক্যানাডার ম্যানিটোবার নীপাওয়া শহরে হলেও, কাহিনির অধিবক্তা হ্যাগার কুরি বেড়ে উঠেছেন ম্যানিটোবার ‘মানাওয়াকা’ নামের ছোট্ট একটি কাল্পনিক পল্লীতে। ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’ কবিতাটি শেলী যেখানে শেষ করেছেন, ঠিক সেখান থেকে শুরু করেছেন লরেন্স তাঁর এই উপন্যাসটি। কাহিনিটি তিনি শুরু করেছেন মৃত্যুর আবহ দিয়ে। প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম লাইনেই দাঁড়িয়ে আছে কাহিনির কথক হ্যাগারের প্রয়াত মায়ের সমাধির ওপর স্থাপিত একটি পাথুরে এঞ্জেলের মূর্তি। গল্পের আবাদি জমিতে প্রবাহিত আভিজাত্য আর অহংবোধের সকল স্রোতধারা উৎসারিত হয়েছে মানাওয়াকা শহরের পার্বত্য ললাটে অধিষ্ঠিত নিরহংকার এই খোধাইকৃত প্রতিকৃতিটির পরিবৃত্ত থেকে। শেলীর ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’ কবিতাটি ইতিহাস-ভিত্তিক হলেও, লরেন্সের ‘দ্য স্টোন এঞ্জেল’-এর পুরো কাহিনিই বেড়ে উঠেছে কল্পনার কোমর জড়িয়ে। রাজা ওজিম্যান্ডিয়াস নিজের মূর্তি নিজেই গড়িয়েছিলেন জীবদ্দশায়; ‘দ্য স্টোন এঞ্জেল’-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি কিন্তু ভিন্নরকম। এখানে হ্যাগারের বাবা জেসন কুরি তাঁর স্ত্রীর অবয়ব দিয়ে কোনো মূর্তি গড়াননি। স্ত্রী রেজিনা মারা যাবার পর, তিনি ইটালি থেকে আকাশছোঁয়া দাম দিয়ে একটি এঞ্জেল তথা পরীর প্রতিমা এনে স্থাপন করিয়েছিলেন তাঁর সমাধির ওপর। সমাজে যাঁদেরকে তিনি নিম্নশ্রেণির আসনে বসিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে নিজের এবং কুরিবংশের উচ্চশ্রেণির আসনটি তিনি পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন বিত্ত ও বৈভবের পরিমল ছড়িয়ে। স্ত্রীকে ভালো না বাসলেও, প্রয়াত স্ত্রীর দেহাবশেষকে একটি কৃত্তিম উচ্চতা দিয়ে মানাওয়াকাবাসীকে এভাবে তিনি শ্রেণিবাণে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। এই প্রতিমার একজোড়া চোখ ছিলো, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি ছিলো না। কাহিনিকারের নিরীক্ষায় পরীটি (এঞ্জেল) দুইভাবে অন্ধ ছিলো – প্রথমত তার দেহখানি পাথর দিয়ে গড়া, দ্বিতীয়ত এই মূর্তির ভাস্কর্যশৈলীতে দেখতে পারার ভান করার অলংকরণটিও ছিলো না। শিল্পী তাঁর নেত্রগোলকটি ফাঁকা রেখেছিলেন। ‘টেরিবল এক্সপেন্স’-এর বিনিময়ে ইটালি থেকে আমদানিকৃত মূর্তির এমন অন্ধত্ব দেখে, লরেন্সের ধারণা, ভাস্কর্যশ্রেষ্ঠ বার্নিনির বংশধরদের মধ্যকার কোনো এক সংকীর্ণমনা রাজমিস্ত্রি এমন হীন কাজটি করেছেন। এই ধরণের ব্যঙ্গার্থক বিকৃতি সংযোজন করে প্রাণজ ভাস্কর্যে লরেন্স অলংকরণ করেছেন একটি ‘অবাঞ্ছিত’ দেশে নতুন ‘ফারাও’র সংস্করণ। উল্লেখ্য, জিয়ান লরেনজো বার্নিনি (১৫৯৮—১৬৮০) ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা ইটালিয়ান ভাস্কর্য, যিনি ভাস্কর্য নির্মাণ ছাড়াও ছবি এঁকেছেন, গল্প ও নাটক লিখেছেন। নাটক রচনা করে সেইসব নাটকগুলোর উপযোগী মঞ্চ নির্মাণের কাজও করেছেন। একজন পণ্ডিত বলেছেন,
"What Shakespeare is to drama, Bernini may be to sculpture: the first pan-European sculptor whose name is instantaneously identifiable with a particular manner and vision, and whose influence was inordinately powerful ..."।
মাঝবয়সে পৌঁছার আগেই হ্যাগার স্পষ্টত দেখতে পেয়েছিলেন, মানাওয়াকার ‘ফারাও’ হাঁটতে শুরু করেছেন মিশরীয় ফারাওর পথে। নব্বই বছর বয়সে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি মনে করার চেষ্টা করছেন – তিনি যখন শেষবার সমাধিপাড়ায় গিয়েছিলেন, মূর্তিটি তখনও তার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েছিলো। শীতকালিন তুষারপাত আর নিয়মিত পরিচর্যার অভাবজনিত কারণে তার শারীরিক ক্ষয়প্রাপ্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো। দুটি পাখা গুটানো ছিলো। পুরো শরীরটা তেরচা কিংবা একটু কাত হয়েই ছিলো। তাঁর ধারণা, সময়ের পরিক্রমায় হয়তো সে একদিন উপড়ে পড়ে যাবে; তখন হয়তো তাঁকে সরল কোণে দাঁড় করাতে কেউ আর সরল মনে এগিয়ে আসবে না।
প্রকৃতপক্ষে, জেসন কুরি ‘স্টোন এঞ্জেল’টির আমদানিকারক ও প্রতিষ্ঠাতা হলেও, জেসনকন্যা হ্যাগার কুরি শিপলীই এই উপন্যাসের শিরোনামের ‘স্টোন এঞ্জেল’। কাহিনির অগ্রসরমানতার এক পর্যায়ে ‘স্টোন এঞ্জেল’টি প্রাণহীনতা আর পূর্ণ স্থবিরতার একটি চিত্রকল্প হয়ে ওঠে। হ্যাগার এক পর্যায়ে নিজের অস্তিত্বকে হাতিয়ে দেখেন রূপজগতের প্রাণহীন প্রতিমার মজ্জায় মজ্জায়। ব্যবসায়ী বাবা নিজের সন্তানদের চাওয়া-পাওয়ার তোয়াক্কা না করে, তিনি তাঁদেরকে তাঁর ব্যবসার কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। দুই ছেলে বাবার স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিলেও মেয়ে তাঁর বাবার সকল স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। বাবার বিরোধিতার কারণে হ্যাগার শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসলেও, প্রতিশোধ হিসেবে বাবার সামাজিক মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি একজন অশিক্ষিত কৃষককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার ত্যাজ্যকন্যা হয়ে তিনি নিজেকে ‘ফারাওকন্যা’ ঘোষণা করেন। রক্ত-মাংসে গড়া হ্যাগার সেদিন থেকেই ‘স্টোন এঞ্জেল’-এ রূপান্তরিত হন, যেদিন তাঁর ছোটো ছেলে জন এক আকস্মিক সড়কদুর্ঘটনায় মারা যায়। ঈশ্বরের ওপর তাঁর খুব রাগ; কারণ, তাঁর বিশ্বাস, আমাদেরকে ঈশ্বর চোখ দিলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দৃষ্টিশক্তিহীন। তবে, রক্ত-মাংসের মানুষকে দৃষ্টিশক্তি থেকে বঞ্চিত করার দায়-দায়িত্ব ঈশ্বরের ওপর চাপালেও, তাঁর মা রেজিনার সমাধিতে পাথুরে প্রতিমাটির দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়ার জন্যে তিনি বার্নিনির উত্তরপুরুষকেই চিহ্নিত করেছেন। কাহিনিকার এখানে দৃষ্টিহীনতাকে চিত্রিত করেছেন অহংকারের চিত্রকল্প হিসেবে। এই অন্ধত্বের কারণেই তিনি পাথরের দৃঢ়তা দিয়ে তাঁর সমস্ত মানবিক আবেগকে দমন করেন। ছোটোবড়ো সবার ওপর কর্তৃত্ব খাটানোর নেশায় পেয়ে যায় তাঁকে। সন্তান, সেবিকা, মন্ত্রী কিংবা অন্য কেউ তাঁকে সহানুভূতি দেখাতে চাইলে তিনি তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। ছোটো ভাই অসুস্থ হয়ে মারা যাবার সময়ও তিনি তাঁকে সেবা দেননি। বড়ো ছেলে মারভিন ও পুত্রবধূ ডরিস তাঁকে সশ্রদ্ধ সেবাযত্ন দেয়ার পরও, তিনি তাঁদেরকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেন। ছোটো ছেলে জন বাউন্ডেলে হয়ে উঠলেও, বাবার দাম্ভিকতাকে বিচূর্ণ করার জন্যে, তিনি তাঁর ছোটো ছেলেকেই নিজের মতো অহংকারি করে গড়ে তুলতে থাকেন। অশিক্ষিত স্বামী ব্রাম শিপলীর বেপরোয়া চালচলনে তিনি অতিসমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠলে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ডিভোর্স, এবং ডিমেনশিয়া রোগে ব্রামের মৃত্যু হয়। পরে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয় পুত্র জনের মৃত্যু হলে হ্যাগার শোকে পাথর (‘স্টোন এঞ্জেল’) হয়ে যান। সেবা ও পরিচর্যা পেতে পেতে হ্যাগারের বয়স যখন নব্বই, সেবা ও পরিচর্যা দিতে দিতে ক্লান্ত ষাটোর্ধ মারভিন ও ডরিস তাঁকে নার্সিং হোমে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
সারা জীবন অন্যের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে আসা হ্যাগার শেষ বয়সে নার্সিং হোমের কর্তৃত্ব মানতে নারাজ। তাই, নার্সিং হোমের দাসত্বকে এড়ানোর জন্যে গোপনে তিনি একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরদিন, মারভিন ও ডরিস তাঁকে খুঁজে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করেন। হাসপাতালে আসার পর হ্যাগারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হতে থাকে। সেবিকা, চিকিৎসক ও বিভিন্ন রোগির সাথে তাঁর গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক। সখ্যতা গড়ে ওঠে তাঁদের দুঃখ-বেদনার সাথে। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর উপলব্ধির মেটামরফোসিস বা ক্রমরূপান্তর। তিনি অনুধাবন করতে শুরু করেন, মারভিনই তাঁর সু-পুত্র, যাঁর ওপর তিনি এতোদিন অবিচার করেছেন। বাবার সামাজিক মর্যাদাকে হেয় করার নামে মূল্যবোধহীন মূর্খ খামারিকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করে তিনি নিজের মূল্যবোধকেই বিসর্জন দিয়েছেন। পুত্রবধূ ডরিসের সেবাদানের পেছনে কোনো স্বার্থ ছিলো না। নার্সিং হোমে শাশুরিকে ভর্তি করিয়ে তাঁর বাড়ি দখল করার কোনো হীন ষড়যন্ত্রের সাথে বৌমা ডরিসের সম্পর্ক ছিলো না। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে তিনি তাঁদের কাছ থেকে ক্ষমা চাইলেন। উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায়, পুত্রবধুর হাত থেকে পানীয় জলের গ্লাসটি গ্রহন করে তিনি অনুভব করলেন, ‘স্টোন এঞ্জেল’-এর শরীরে আবার রক্তপ্রবাহ বইতে শুরু করেছে। অহংবোধ নয়, ভালোবাসার পরিপূরকতাই পাথরের মজ্জায় যোগান দিতে পারে প্রাণের প্রবাহ, জাগিয়ে তুলতে পারে আলোর ঝলকানি মূর্তিমান পাথরের নেত্রকোণায়।
মার্গারেট লরেন্স কাহিনি শুরু করেছেন ইংরেজ কবি শেলীর ‘ওজিম্যান্ডিয়াস’ কবিতার ফারাও দিয়ে, শেষ করেছেন গ্রীক কবি ওভিডের (খৃষ্টপূর্ব ৪৩ – ১৮ খৃষ্টাব্দ) ‘মেটামরফোসিস’ দিয়ে। ওভিডের মেটামরফোসিস গ্রন্থের দশম পর্বে একটি বিস্ময়কর কাহিনির কথা আমরা জেনেছি। পিগম্যালিয়ন ছিলেন একজন সাইপ্রিয়ট ভাস্কর, যিনি হাতির দাঁত খোদাই করে নির্মাণ করেছিলেন একটি নারী-ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি এতোই প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় হয়েছিলো, পিগম্যালিয়ন নিজেই নিজের শিল্পকর্মের প্রেমে পড়ে যান। প্রেমপর্বের একপর্যায়ে শিল্পী তাঁর ভাস্কর্যের জন্যে নানান ধরণের উপহার সামগ্রীও কিনতে শুরু করেন। প্রেমযজ্ঞের বিশেষ পর্বে এসে তিনি তাঁর খোদাই করা প্রেমিকার জন্যে দারুণ একটি বিছানাও নির্মাণ করেন। সময়ের পরিক্রমায় পিগম্যালিয়ন একদিন ভালোবাসার দেবী অ্যাফ্রোডাইটির বেদিতে নৈবেদ্য অর্পণ করে তাঁর মনের বাসনা মনে মনে প্রকাশ করেন। দেবীর কাছে তিনি নীরবে এমন এক নারীকে কামনা করলেন, যিনি তাঁর গজদন্তের ভাস্কর্যের জীবন্ত প্রতিরূপ হবেন। গ্রীক দেবী অ্যাফ্রোডাইটি শিল্পীর বাসনা পূরণ করলেন। দেবীর মন্দির থেকে বাড়ি ফিরে ভাস্কর তাঁর নির্মিত মূর্তিটিকে চুম্বন করলেন। প্রথম চুমুতে তিনি মূর্তির ঠোঁটে উষ্ণতা অনুভব করেন। পরের চুমুতে ভালোবাসার ভাস্কর্যটি তাঁর কাঠামোর কাঠিন্য হারিয়ে ফেললে ভাস্কর তাঁর মধ্যে নারী দেহের কোমলতা উপলব্ধি করেন। পিগম্যালিয়ন হাসি দেখলেন সদ্যোজাত (রূপান্তরিত!) নারীর ঠোঁটে। অতঃপর শুরু হলো দেহজ বর্ণমালার ধারাবাহিক সন্ধিপর্ব। চূড়ান্তপর্বে তাঁদের ঘরে এলো একটি কন্যা সন্তান। তাঁরা কন্যাসন্তানের নাম রাখলেন পাফোস। আধুনিক সাইপ্রাসের পাফোস সিটির নামকরণের পেছনের ইতিহাস গ্রীক পুরাণের এই পিগম্যালিয়ন-কন্যা পাফোসকে ঘিরেই।
মার্গারেট লরেন্সের সারাজীবনের বন্ধু ক্যানাডীয় সাহিত্যিক অ্যাডেল ওয়াইজম্যান (১৯২৮—১৯৯২) ক্যানাডার সর্বকালিন অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘দ্য স্টোন এঞ্জেল’-এর মুখবন্ধে লিখেছেন, “মানাওয়াকার হ্যাগার তাঁর মা রেজিনার সমাধিতে স্থাপিত পাথুরে পরীপ্রতিমার স্থবিরতার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর অহংবোধের কারণে। জীবনের শয্যাপর্বে এসে তিনি পরিশুদ্ধ হয়েছেন অনুশোচনাযজ্ঞ সম্পন্ন করে, কাছের মানুষদের ভালোবেসে নিজেকে অবমুক্ত করেছেন মর্মর মূর্তির মঞ্জিল থেকে। কাহিনিকার তাঁর নিজের সৃষ্ট এই হ্যাগার চরিত্রটিকে ভালোবেসে তিনি নিজেকে একজন সফল ‘পিগম্যালিয়ন’ বানিয়েছেন। নীপাওয়ার সমাধিপাড়ায় মার্গারেট লরেন্স অমরত্ব অর্জন করেছেন মানাওয়াকার রূপকল্প দিয়ে।“
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন