মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সুরজিৎ কুন্ডু-র প্রবন্ধ

গলি থেকে রাজপথকলকাতার কথকতা


আমাদের প্রাণের শহর কল্লোলিনী কলকাতা। আমার এই শহরটায় আলাদাই একটা টান আছে, যা তাকে বাকি আর পাঁচটা শহর গুলোর থেকে করেছে আলাদা । আর সত্যি বলতে কি টানটা যে শুধুমাত্র বড়লোক বিত্তবানদের রয়েছে তা নয় , বিত্ত নির্বিশেষে, জাত বা ভাষা কে উহ্য রেখেই সে তার টানটাকে পুরো ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে দেয় সবার মনে। তাইতো কলকাতা সত্যিকারের মেট্রোপলিটন হয়ে উঠতে পেরেছে, করেছে আত্মস্থ সব রুচি, ভাষা , তহেজিবকে নিজের মধ্যে। বিরিয়ানি হোক কিংবা সাহিত্য সবটাই কলকাতার নিজস্ব স্টাইলে হয়, এই শহরটাতে। রাত নামলে পাল্টায় চেহারা, ভোরে হয়ে ওঠে অন্য এক কলকাতা। শহরটার নাম নিয়েই কত রকমফের, কত ইতিহাস আর মতামত । বাংলার নবাব সিরাজ নাম দিয়েছিল 'আলী নগর ' আবার সাহেবরা  দিয়েছে 'ক্যালকাটা' আর ঠিক তেমনি বদলেছে, ভেঙেছে গড়েছে এই তিলোত্তমার গায়ের সীতাহার এর মত বা কঙ্কন কিংবা কোমর বন্ধ,  নুপুরের মতো জড়িয়ে থাকা রাস্তা ।আজ তেমনি দুটো রাস্তার কথা শোনাবো আপনাদের , একটি বহুল পরিচিত অপরটি মনে হয় অনেক কলকাতাবাসীর কাছেই অপরিচিত। যদিও শেষেরটি লেন বা গলি, যে লেন  বহন করছে এক স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে । যা ঘাটতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, এটি সত্যিই আমার শহরের কথা নাকি কোন অজানা দেশের না জানা কোন নগরীর পাঁচালী। আর প্রশস্ত রাজপথটি পদধূলি ধন্য নানা মনীষীর,  ঘটনার ঘনঘাটার ঘোমটায় মোরা সেকাল হোক কিংবা একাল । আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা। সালটা ১৮৬৬ শহর কলকাতায় হল প্রথম আদমশুমারি বা জনগণনা, যদিও তার অনেক আগেই ১৮৫০ নাগাদ এফ. ডব্লিউ. সিমস্ কলকাতার জনবসতির একটা মানচিত্রায়নের চেষ্টা করেন । কিন্তু তারও অনেক আগেই ১৭৮১ সালে পুর প্রশাসনের জন্য অর্থ সংগ্রহের তাগিদে রাস্তা ধরে ধরে বাড়ি ও বাড়ির বাসিন্দাদের তালিকা তৈরি করে কর ধার্য করে তৎকালীন কোম্পানি। আর এরপর ১৭৮৪ সালে কর্নেল মার্ক উড ও ১৭৯২ সালে আপজন সাহেবের মানচিত্রে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে কলকাতার নানা রাস্তাঘাট । আজ যে রাস্তাদের গল্প শোনাবো তখনও কিন্তু তারা বর্তমান কিন্তু ভিন্ন নামে , তা সে যাই হোক আমরা তো আর ইতিহাস বই খুলে বসিনি আমরা বসেছি গল্প শুনতে। তাই চলুন পায়ে পায়ে কলকাতার ধুলো মেখে বেরিয়ে পড়ি সেই সব রাস্তা দের উদ্দেশ্যে। ----'তুমিও হেঁটে দেখো কলকাতা' 
শহরের প্রাণকেন্দ্র মধ্য কলকাতার বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের জন্য বিখ্যাত চাঁদনীচক্ কেইবা আর না চেনে আর "চিকেন রেজালার" বা "দুধ বেশি চায়ের" জন্য "সাবির রেস্তোরার" কথা মনে পড়তেই রসনা প্রিয় বাঙালির জিভে গরম জল চলে আসে । সেই সাবিরের উল্টো দিকের গলি গিয়ে পড়েছে "টেম্পল স্ট্রীটে" আর সেখানেই রয়েছে আমাদের আজকের গন্তব্য "গুমঘর লেন" ছোট্ট অপরিসর রাস্তার দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো ভগ্নপ্রায় আদ্যিকালের অট্টালিকা গুলি। 'গুমঘর' নামটা শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে আসে গা ছমছম করা ইতিহাস আর রোমাঞ্চ। জমিদার বাড়ির গুম ঘরে বন্দী করে রাখা নানান নৃশংস ইতিহাস । কিন্তু খাস কলকাতার বুকে এ কোন গুমঘর? নাহ্!  এ গুমঘরের সাথে কোন জমিদার বাড়ির কথা জড়িয়ে নেই তবে কেন এমন হলো এই রাস্তার নাম ? দিনের বেলা গমগম করা রাস্তা সন্ধ্যে নামলেই যেন এক নিমেষে নিস্তব্ধতার চাদর মুড়ি দেয় । এমন নামকরণের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের টাইমমেশিনে করে পাড়ি দিতে হবে কয়েকশো বছর পিছনে। তিলোত্তমার অনেক রাস্তা আর গলির নাম আর পরিবেশ বারবার পরিবর্তিত হলেও প্রথম থেকেই এ গলির নাম 'গুমঘর লেনই'  রয়েছে। "বেঙ্গল আগরা ডিরেক্টরী" ১৮৫০ সালেও এই সরু লেনের নাম গুমঘর লেন । জমিদার বাড়ি গুমঘরের সাথে এর কোন যোগ নেই , বরঞ্চ আছে এক হাসপাতালের কথা জড়িয়ে । তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলছে ভারতে আর তারই ভারতীয় কর্মচারীদের জন্য একটা হাসপাতাল তৈরীর প্রস্তাব ওঠে । ১৭৯২ সালে তা  তৈরি হয়ে যায় আজকের চিৎপুরে বা সেকেলে কলুটোলায়, নাম দেওয়া হয় "নেটিভ হাসপাতাল"।  যদিও সেই ঠিকানায় বেশি দিন ছিল না তা, খোলামেলা বাড়িতে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে ১৭৯৬ সালে এটি উঠে আসে ধর্মতলায়। আর যে বাড়িতে  হাসপাতালটি উঠে এসে ছিল তারই ঠিক উত্তর বরাবর ছিল আমাদের আজকের এই গন্তব্য। এই হাসপাতালের গায়ে একটি বাড়িতে ছিল কলকাতার প্রথম  'কোয়ারেন্টাইন রুম' যা কিনা পরবর্তীতে স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ও ব্যবহার করা হয়। ছোঁয়াচে ও সংক্রামক রোগীদের রাখা হতো এইসব ঘরগুলিতে আর ওই 'কোয়ারেন্টাইন হাউস' থেকেই এ রাস্তার নাম হয়ে দাঁড়ায় 'গুমঘর লেন'। সুদীর্ঘ প্রায় ৭৮ বছর ওই একই ঠিকানায় ছিল এই হাসপাতালটি তারপর ১৮৭৪ সাল নাগাদ নাম পাল্টে এর নাম রাখা হয় বিখ্যাত গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়োরর নাম অনুসারে 'মেয়ো নেটিভ হাসপাতাল' । তার সঙ্গে আবার বদল আসে এর ঠিকানাতেও , স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে স্ট্র্যান্ড রোডে । তারপর কোন এক না জানা কারণবশত বন্ধ করে দেয়া হয় তা। কিন্তু হাসপাতাল উঠে গেলেও , ছোঁয়াচে রোগী স্থানান্তরিত হয়ে গেলেও আর কোয়ারেন্টাইন বাড়ির অস্তিত্ব না থাকলেও নামটা রয়ে যায়। আর সেই নামের সাথে মিশে রয়ে যায় তার না জানা ইতিহাস । এখন যদিও অনেক স্থানীয় বাসিন্দারা একে 'বকরি লেন ' ও বলে। কিছু বছর আগেও সেখানে কয়েকটা পরিবার ছাগল প্রতিপালন করতো এখন তাও গেছে । মাত্র ৩০০ মিটার লম্বা ঘিন্জি গলিটায় একুশশতকের কলকাতায় গুম হয়ে গেছে প্রাচীন কলকাতার রোগীদের যন্ত্রণা আর বেঁচে থাকার আর্তি।
এবার যাওয়া যাক একটু উত্তরে ফিবছর দুর্গাপূজায় সবকটা টিভি ক্যামেরার লেন্স থাকে এখানকার এক শতাব্দী প্রাচীন বারোয়ারি পূজোয়। আর আমরা যারা উত্তর কলকাতার ঠাকুর দেখতে ভালোবাসি তারা অনেকেই এই পুজোটা দিয়েই দেখা শুরু করি । নানা কারণে বিখ্যাত এই জায়গাটা , আর পাশের গঙ্গার ঘাটতো এখন ট্রেন্ডিং ভিজিটিং প্লেস , ওখানে গিয়ে ভাঁড়ের চায়ে চুমুক না দিলে "ক্যালকেশিয়ান" হওয়াই নাকি যায় না ! বিখ্যাত কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি , পেশায় মিষ্টির কারিগর--- " ময়রা ভোলানাথের" আস্তানা সেখানেই ছিল । চলুন তবে কৈলাস , থুরি---
"আমি সেই ভোলানাথ নই রে সেই ভোলানাথ নই,
আমি যে ময়রা ভোলা হরুর চেলা বাগবাজারে রই ।"
চলুন তবে বাগবাজার সার্বজনীনের সামনের রাস্তা "বাগবাজার স্ট্রিটে" ,যদিও আগে এই 'বাগবাজার স্ট্রিটের' নাম ছিল "বারুদ কারখানার রাস্তা" বা "গান পাউডার ফ্যাক্টরি রোড"।  আর এই রাস্তা এখন গিয়ে চিৎপুর রোডে গিয়ে মিশেছে আগে তা "পেরিং সাহেবের বাগানের" পূর্বসীমা পর্যন্ত সাধারণ রাস্তা ছিল, বর্তমানে হরলাল মিত্র স্ট্রীট পর্যন্ত , তারপর বাগানের ডান দিকের সূড়িপথ চিৎপুর রোডে মিশেছে। 'মার্ক উড্ ' সাহেবের ম্যাপে "ওল্ড পাউডার মিল রোড " এই নামে উল্লেখিত।

পলাশীর যুদ্ধ তখনও হয়নি বাংলার সিংহাসন তখন মুর্শিদ কুলির পরিবারের হাতে,  ওই রাস্তারই প্রান্তে ছিল বিশাল এক বাগান বাড়ি, আর বাড়ির মালিক ছিল ক্যাপ্টেন চার্লস পেরিং সাহেব তিনি ছিলেন প্রচুর জাহাজের মালিক । ১৭৪৬ সাল অব্দি ম্যাপে ওই উদ্যান ঘেরা বাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়, ব্রিটিশ সৈন্যরা এখানে বেড়াতে আসতো। যদিও একসময় সম্ভবত সাহেবের মৃত্যুর পর বা অন্য কোন কারণেই শ্রীহীন হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে, অবশেষে ১৭৫২ সালের ১১ই ডিসেম্বর ওঠে নিলামে এই বাগান বাড়ি খানা। মাত্র আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে তা কিনে নেয় কুখ্যাত 'হলওয়েল সাহেব'। শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ তে কলকাতা আক্রমণ করলে সেনাপতি মীরজাফর ও হলওয়েল সাহেবের সংঘর্ষ হয় ঠিক এখানেই। পরবর্তীতে আবার এর হাত বদল হয় আর হলওয়েল সাহেব বিক্রি করেন এই বাগানবাড়িকে তখনকার ফোর্ট উইলিয়ামের আর্মি জেনারেল "ক্যার্লিং ফ্রেডরিক স্কটকে"  আর তিনি সেখানে বন্দুকের বারুদের পাউডার বা গান পাউডার তৈরির কারখানা খোলেন । আর তা থেকেই এখনকার 'বাগবাজার স্ট্রীটের' নাম হয় "গান পাউডার ফ্যাক্টরি রোড" ।যদিও 'স্কট সাহেবের' মৃত্যুর পর এর মালিকানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে।  কিন্তু এই 'পেরিং সাহেব' আর তার বাগান বাড়ি একটা বিশেষ জায়গা করে নেয় জনপ্রিয়তার কারণে। 'ক্যালকাটা কমিটি অফ রেভিনিউ' কোন এক পেরিং সাহেবকে দায়িত্ব দিল বরানগর ও তৎসংলগ্ন এলাকা ও হুগলির যে অঞ্চলটি ওলন্দাজরা পেতে চায় তার সীমানা ও মূল্য নির্ধারণ করতে। যদিও এই সেই পেরিং সাহেব কিনা তাতে সন্দেহ আছে, তবে একথা ঠিক ওই জনপ্রিয় উদ্যানটি নষ্ট হয় যখন ব্রিটিশরা সুতানুটি ছেড়ে চলে যায় তখন দেখাশোনার অভাবে । যদিও হরিসাধন মুখোপাধ্যায় 'কলিকাতা সেকাল ও একালের' বইতে বলেছেন পেরিং সাহেব যখন বাগান বাড়িটি তৈরি করছিলেন তখন লর্ড ক্লাইভ লর্ড না হয়ে মাদ্রাজে রাইটারি করতেন আর ওয়ারেন হেস্টিংস সবেমাত্র কাশিমবাজারে কোম্পানির চাকরিতে যোগ  দিয়েছে ।  এর থেকেই বোঝা যায় বাগবাজার কিংবা ওই "গুমঘর লেন" কত পুরনো প্রাচীন জায়গা কলকাতার ইতিহাসে এর থেকেই বোঝা যায় । এরকম কত কথা , কত শোনা না হওয়া গল্প যে লুকিয়ে রয়েছে কলকাতার গলির গোলক ধাঁধার মাঝে কিংবা প্রকাশ্য রাজপথের তলায় গুপ্তধনের মত তার হিসেব মেলা ভার । তারা সত্যিই আমাকে বিস্মৃত করে , হাতছানি দিয়ে ডাকে আমারই মতো পুরনো কলকাতা প্রেমীদের । এবার যখন ওই চাঁদনী চক্ কিংবা পুজোতে বাগবাজারের ঠাকুর দেখতে যাবেন তখন কুমোরটুলির ঠাকুর দেখার জন্য যখন "বাগবাজার স্ট্রীট"  ধরে হাঁটবেন, একটিবার অন্তত এই ইতিহাসের ধূসর পাতার গল্প গুলো মনে করার চেষ্টা করবেন । দেখবেন সত্যিই আপনি শিহরিত হবেন, পাবেন পোড়া বারুদের গন্ধ বা চাঁদনীচকের বাজারে শুনতে পাবেন ওইসব গুম ঘরে বন্দী রোগীদের আর্তনাদ । কলকাতা সত্যিই যেন এক গল্পের ঝুলি। 

২টি মন্তব্য: