রুশ রূপবাদীদের (Formalist) অনুসরণে বলি যে তাঁরা অপরিচিতকরণে (Unfamiliarisation) গুরুত্ব দিয়েছেন। শক্লোভ্স্কি-র ভাষায় : ‘The technique of art is to make things unfamiliar, to make forms obscure, so as to increase the difficulty and the duration of perception.’ সুতরাং এই অপরিচিতকরণের প্রক্রিয়াই শিল্পের প্রক্রিয়া ––– শক্লোভ্স্কি ভেবেছেন।
বিভিন্ন সময় ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিভিন্ন কবির কবিতায় আলোড়িত হয়েছি আমরা। যেমন হুইটম্যান, ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট ইত্যাদি। তেমনি ফরাসি কবি বোদলেয়ার, মালার্মে, ভের্লেন, র্যাঁবো, ভ্যালেরি ইত্যাদি। আবার লাতিন দুনিয়ার কবি লোরকা, জার্মান কবি রিলকে ––– এরকম অজস্র কবির কবিতা। এঁরা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী আধুনিক বিশ্বকবিতার আঙিনা সমৃদ্ধ করেছেন। মানুষের চিত্ত নতুনভাবে নতুন চিন্তায় জেগে উঠেছে এই সময়ের কিছু যুগান্তকারী থিয়োরি প্রকাশে। যেমন, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের ‘স্পেশাল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি’ এবং ‘জেনারেল থিয়োরি অফ
রিলেটিভিটি’, ১৮৬৭ সালে কার্ল মাক্সের ‘ডাস কাপিটাল’, ১৯০০ সালে ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস্’
ইত্যাদি। সৃষ্টির উদ্ভাসে নতুন নতুন জিজ্ঞাসায় বিশ্বশিল্পসাহিত্য তথা কবিতায় পরিবর্তন আসতে থাকে। মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) প্রথাগত ধারণা ভেঙে দিয়ে ফ্রি ভার্সে লেখা শুরু করেন। ফ্রি ভার্সের পথেই ধীরে ধীরে আমরা প্রোজ পোয়েট্রি বা গদ্যকবিতা পাই। ছন্দ মিলের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ওঠে কবিতা। কাব্য আধুনিকতায় গদ্যকবিতা জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।
ফরাসি কবি মালার্মে (১৮৪২-১৮৯৮) প্রতীকবাদী কবিতা লিখতে শুরু করেন। সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ছায়া ছায়া কবিতা লিখতে থাকেন কবি। প্রতীকবাদের পথ ধরেই আসে ‘ভবিষ্যবাদ’ (ফিউচারিজম), ‘খেয়ালবাদ’ (দাদাইজম), ‘গঠনবাদ’ (কন্সট্রাক্টিভিজম), পরাবাস্তববাদ (সুররিয়ালিজম)। ‘সুররিয়ালিজম’ টার্মের আবিষ্কারক ফরাসি প্রতীকবাদী কবি গিয়োম আপোলিন-এর কাব্যগ্রন্থ ‘আলকল’ (১৯১৩ সালে প্রকাশিত)। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম যতিচিহ্নহীন কবিতা আমরা ‘আলকল’ কাব্যগ্রন্থেই পড়তে পাই।
এই যে নানান সময়ে বিভিন্ন কবির লেখা কবিতায় আলোড়িত হয়েছি ––– যে সমস্ত কবির কথা লিখে চলেছি বা যাঁদের কথার হয়ত উল্লেখ থাকল না, সকলের প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। অন্য ভাষার কবিতার কথা বলতে গিয়ে, যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে নোবেলজয়ী জার্মান কবি হেরমান হেস। তিনি দার্শনিক প্রজ্ঞায় গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন সেই অসাধারণ উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’ (১৯২২ সালে)। হেসের কবিতায় মানুষের শান্তির খোঁজে প্রকৃতি-দর্শন, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান ও শুদ্ধতার উন্মীলন প্রত্যক্ষ করি।
বিংশ শতাব্দী ধরে শুধু ইংরেজি কবিতা নয়, আরও অন্য ভাষার কবিতাও আমাদের ভাবিয়েছে, সমকালীন
জীবনবোধে কবিতাকে নতুন থেকে নতুনতর রূপে। স্প্যানিশভাষী কবিদের মধ্যে কিছু ––– পাবলো নেরুদা, অক্টাভিও পাজ, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু উল্লেখযোগ্য রাশিয়ান
কবি ––– আন্না আখমাতোভা, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, বরিস পাস্তারনাক, লিউনিদ মার্টিনোভ, সের্গেই এসেনিন, ইত্যাদি। তুরস্ক-এর কবি নাজিম হিকমত, লেবানন-এর কবি খলিল জিব্রান।
সৃষ্টির এই পথে আধুনিকতা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে। এরপর শুরু হয় উত্তরাধুনিকতার যুগ। এই দার্শনিক মতবাদকে সমৃদ্ধ করতে কিছু দার্শনিক ও তাত্ত্বিক-সাহিত্যিকের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। তাঁরা হলেন মার্টিন হাইডেগার, জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, জ্যাক লাকাঁ, ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার কবিতাও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমরা পর পর পেয়েছি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে। এরপর অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কবি। ১৯৮৭ সালে বাংলাভাষার আধুনিকতার পরবর্তী কবিতাকে ‘উত্তর-আধুনিক’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন অমিতাভ গুপ্ত। অমিতাভ গুপ্ত-র ‘উত্তর-আধুনিক’ সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা এবং সমীর রায়চৌধুরী-র ‘পোস্টমডার্ন’ বা ‘অধুনান্তিক’ ভাবনাচিন্তার কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও মূলত সেগুলি আধুনিকতা-পরবর্তী চিন্তনজগতকেই ব্যাখা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
বর্তমানে বাংলা কবিতার কথা চিন্তা করলে এটুকু বলা যায় যে, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় লেখা কবিতা এবং বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে। কোনো নেগেটিভ চিন্তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, এটা জোর গলায় বলা যায় ––– কবিতার জয় হোক, পৃথিবী তথা বিশ্বব্রহ্মান্ডের দিকে তাকিয়ে কবি তাঁর পরিস্থিতি অনুসারে নতুনভাবে লিখে
চলেছেন এবং লিখে যাবেন।
২১ মার্চ আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস। সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থাকুন সকলে।
রোশনি ইসলাম
সোনালি বেগম
অল্প কথায় অনেক কিছু বলায়য়খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন