রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩
সম্পাদকের নিবেদন
রুশ রূপবাদীদের (Formalist) অনুসরণে বলি যে তাঁরা অপরিচিতকরণে (Unfamiliarisation) গুরুত্ব দিয়েছেন। শক্লোভ্স্কি-র ভাষায় : ‘The technique of art is to make things unfamiliar, to make forms obscure, so as to increase the difficulty and the duration of perception.’ সুতরাং এই অপরিচিতকরণের প্রক্রিয়াই শিল্পের প্রক্রিয়া ––– শক্লোভ্স্কি ভেবেছেন।
বিভিন্ন সময় ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিভিন্ন কবির কবিতায় আলোড়িত হয়েছি আমরা। যেমন হুইটম্যান, ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট ইত্যাদি। তেমনি ফরাসি কবি বোদলেয়ার, মালার্মে, ভের্লেন, র্যাঁবো, ভ্যালেরি ইত্যাদি। আবার লাতিন দুনিয়ার কবি লোরকা, জার্মান কবি রিলকে ––– এরকম অজস্র কবির কবিতা। এঁরা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী আধুনিক বিশ্বকবিতার আঙিনা সমৃদ্ধ করেছেন। মানুষের চিত্ত নতুনভাবে নতুন চিন্তায় জেগে উঠেছে এই সময়ের কিছু যুগান্তকারী থিয়োরি প্রকাশে। যেমন, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের ‘স্পেশাল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি’ এবং ‘জেনারেল থিয়োরি অফ
রিলেটিভিটি’, ১৮৬৭ সালে কার্ল মাক্সের ‘ডাস কাপিটাল’, ১৯০০ সালে ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস্’
ইত্যাদি। সৃষ্টির উদ্ভাসে নতুন নতুন জিজ্ঞাসায় বিশ্বশিল্পসাহিত্য তথা কবিতায় পরিবর্তন আসতে থাকে। মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) প্রথাগত ধারণা ভেঙে দিয়ে ফ্রি ভার্সে লেখা শুরু করেন। ফ্রি ভার্সের পথেই ধীরে ধীরে আমরা প্রোজ পোয়েট্রি বা গদ্যকবিতা পাই। ছন্দ মিলের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ওঠে কবিতা। কাব্য আধুনিকতায় গদ্যকবিতা জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।
ফরাসি কবি মালার্মে (১৮৪২-১৮৯৮) প্রতীকবাদী কবিতা লিখতে শুরু করেন। সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ছায়া ছায়া কবিতা লিখতে থাকেন কবি। প্রতীকবাদের পথ ধরেই আসে ‘ভবিষ্যবাদ’ (ফিউচারিজম), ‘খেয়ালবাদ’ (দাদাইজম), ‘গঠনবাদ’ (কন্সট্রাক্টিভিজম), পরাবাস্তববাদ (সুররিয়ালিজম)। ‘সুররিয়ালিজম’ টার্মের আবিষ্কারক ফরাসি প্রতীকবাদী কবি গিয়োম আপোলিন-এর কাব্যগ্রন্থ ‘আলকল’ (১৯১৩ সালে প্রকাশিত)। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম যতিচিহ্নহীন কবিতা আমরা ‘আলকল’ কাব্যগ্রন্থেই পড়তে পাই।
এই যে নানান সময়ে বিভিন্ন কবির লেখা কবিতায় আলোড়িত হয়েছি ––– যে সমস্ত কবির কথা লিখে চলেছি বা যাঁদের কথার হয়ত উল্লেখ থাকল না, সকলের প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। অন্য ভাষার কবিতার কথা বলতে গিয়ে, যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে নোবেলজয়ী জার্মান কবি হেরমান হেস। তিনি দার্শনিক প্রজ্ঞায় গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন সেই অসাধারণ উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’ (১৯২২ সালে)। হেসের কবিতায় মানুষের শান্তির খোঁজে প্রকৃতি-দর্শন, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান ও শুদ্ধতার উন্মীলন প্রত্যক্ষ করি।
বিংশ শতাব্দী ধরে শুধু ইংরেজি কবিতা নয়, আরও অন্য ভাষার কবিতাও আমাদের ভাবিয়েছে, সমকালীন
জীবনবোধে কবিতাকে নতুন থেকে নতুনতর রূপে। স্প্যানিশভাষী কবিদের মধ্যে কিছু ––– পাবলো নেরুদা, অক্টাভিও পাজ, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু উল্লেখযোগ্য রাশিয়ান
কবি ––– আন্না আখমাতোভা, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, বরিস পাস্তারনাক, লিউনিদ মার্টিনোভ, সের্গেই এসেনিন, ইত্যাদি। তুরস্ক-এর কবি নাজিম হিকমত, লেবানন-এর কবি খলিল জিব্রান।
সৃষ্টির এই পথে আধুনিকতা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে। এরপর শুরু হয় উত্তরাধুনিকতার যুগ। এই দার্শনিক মতবাদকে সমৃদ্ধ করতে কিছু দার্শনিক ও তাত্ত্বিক-সাহিত্যিকের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। তাঁরা হলেন মার্টিন হাইডেগার, জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, জ্যাক লাকাঁ, ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার কবিতাও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমরা পর পর পেয়েছি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে। এরপর অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কবি। ১৯৮৭ সালে বাংলাভাষার আধুনিকতার পরবর্তী কবিতাকে ‘উত্তর-আধুনিক’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন অমিতাভ গুপ্ত। অমিতাভ গুপ্ত-র ‘উত্তর-আধুনিক’ সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা এবং সমীর রায়চৌধুরী-র ‘পোস্টমডার্ন’ বা ‘অধুনান্তিক’ ভাবনাচিন্তার কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও মূলত সেগুলি আধুনিকতা-পরবর্তী চিন্তনজগতকেই ব্যাখা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
বর্তমানে বাংলা কবিতার কথা চিন্তা করলে এটুকু বলা যায় যে, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় লেখা কবিতা এবং বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে। কোনো নেগেটিভ চিন্তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, এটা জোর গলায় বলা যায় ––– কবিতার জয় হোক, পৃথিবী তথা বিশ্বব্রহ্মান্ডের দিকে তাকিয়ে কবি তাঁর পরিস্থিতি অনুসারে নতুনভাবে লিখে
চলেছেন এবং লিখে যাবেন।
২১ মার্চ আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস। সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থাকুন সকলে।
রোশনি ইসলাম
সোনালি বেগম
ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"
ভাষান্তরে জীবনানন্দের ‘কমলালেবু’: পুনর্জন্মের সাধ
পুনর্জন্মের সাধ জীবনানন্দের কবিতার অন্যতম লক্ষণ বলেই আমরা জানি। যদিও মানুষ নয়, পাখিদের রূপেই তিনি এই পৃথিবীতে ফিরতে চান। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের সেই বিখ্যাত কবিতা এখন গান হয়ে মুখে মুখে ফেরে : ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে – এই বাংলায় / হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে’। কিন্তু এই ফিরে আসার ছবিটি বিষাদকীর্ণ হয়ে ‘বনলতা সেন’(১৯৪২) কাব্যেও এসেছে একবার, কবিতার নাম
‘কমলালেবু’। যদিও সেখানে জীবন্ত কোনো পশু-পাখির জীবন নয়, তাঁর কাঙ্ক্ষিত রোগীর খাদ্য একটা কমলালেবুর জীবন, যে আত্মোৎসর্গ করে পরার্থে। কবিতাটি একবার পড়া যাক :
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
এই যে শীতের রাতে পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে ফিরতে চাওয়া কমলালেবু হয়ে, মানুষ হয়ে নয়, এর মধ্যে কি কবির অভিমানী মনের ছায়া নেই? তদুপরি শীত, হিম, করুণ শব্দগুলি বিষাদবেদনা মাখা। এক মৃত্যুপথযাত্রীর মানুষের কাছে একটি ঠাণ্ডা অথচ উজ্জ্বল কমলালেবুর শাঁস ছাড়িয়ে খাওয়ার মধ্যে হয়তো একটু বাঁচার আশ্বাস আছে। কবি যেন সেই আশ্রয়টুকু হতে চান পরজন্মে। যদিও এই শীতরাত তাঁর ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে নিঃসঙ্গতা, বঞ্চনা, অসম্মান ও যৌনশৈত্যকে দ্যোতিত করেছে। শীতরাতে উষ্ণতা পেতে চেয়েও পায়নি মাল্যবান। ‘কোনোদিন ফুরুবে না আমাদের শীত,রাত, আমাদের ঘুম?’ – এই উচ্চারণ বীজবাক্যের মতো উপন্যাসের শেষে পুনরাবৃত্ত হয়। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিরোধজনিত ট্র্যাজেডি নিয়েই মাল্যবান বেঁচে থাকে এক নষ্ট দাম্পত্যের ভারবাহী জন্তুর মতো। সেই রকম কোনো এক অকরুণ শীত রাতের কথাই কি কবি বলছেন আমাদের? আমরা কবিতাটিকে নিবিড়ভাবে বুঝে নিতে দুটি অনুবাদের সাহায্য নিতে পারি। কারণ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ‘অনুবাদের রাজনীতি’ (১৯৯২) প্রবন্ধের এই অভিমত আমরা সসম্ভ্রমে মেনে নিই : ‘translation is the most intimate act of reading.’ দুটি ভিন্ন সময়ে করা অনুবাদ এবার পাশাপাশি রেখে দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি স্বয়ং জীবনানন্দ অনুমোদিত তরজমা :
চিদানন্দ দাশগুপ্তের অনুবাদ :
Once I am dead,
Shall I ever come back to earth again?
If so be it that I do,
Let me come back, on a wintry night,
As the frail, cold flesh of a half-eaten orange
Set on a table, by the dying one’s bed. (The Orange, 1954)
তরুণ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ :
When I am dead once
Shall I return to this world?
If I come back
Let me return on a winter night
Like an orange with sad and cold flesh
I come back to a known dying man’s bed. (An orange, 1995)
দুটি অনুবাদ তথা পুনর্লিখন আমাদের কবির কমলালেবু হয়ে ফিরে আসবার আকাঙ্ক্ষাকেই বোঝায়। কিন্তু ‘একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে’ অংশটি দুটি অনুবাদে ভিন্নভাবে ধরা পড়ে। তরুণ লেখেন ‘Like an orange with sad and cold flesh’ও চিদানন্দর অনুবাদে তা হয়েছে ‘As the frail, cold flesh of a half-eaten orange’। চিদানন্দের কাছে করুণ হয়েছে ‘frail’ আর ‘half-eaten’ তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যামূলক সংযোজন। ফলে অর্ধভুক্ত কমলালেবুটির শাঁস ঠাণ্ডা ও সেই লেবুর জীবন ক্ষণস্থায়ী, এই ভাবটা তিনি ধরতে চান। তাছাড়া তরুণ ‘Like’ অর্থাৎ কমলালেবুর ‘মতো’ বলেছেন, চিদানন্দ সেখানে কমলালেবুর রূপেই যে কবি পৃথিবীতে ফিরতে চান, তা স্পষ্ট করে দিতে ‘As’ (রূপে) ব্যবহার করেছেন। আর ‘কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে’ কে তরুণ মূলানুগ অনুবাদ করলেও, চিদানন্দ ‘পরিচিত’ শব্দটিকে বাদ দিয়ে যে-কোনো মূমূর্ষু মানুষকে বুঝেছেন আর বিছানার কিনারে আবার তাঁর ব্যখ্যায় ‘Set on a table’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ চিদানন্দ কবিতাটিকে এইভাবেই পড়েছেন, বুঝেছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন। [তাছাড়া অনুবাদকের ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৫৪-এ করা এই কবিতাসহ চারটি কবিতার অনুবাদ জীবনানন্দ নিজে দেখে দেন ও সেগুলি অনুমোদন করেছিলেন।] অনুবাদের প্রক্রিয়ায় যে ক্রমিক পুনর্নির্মাণের কাজ চলে (উৎস ভাষার টেক্সট> ব্যাখ্যা> বহন/স্থানান্তর>পুনর্গঠন> গ্রাহক ভাষায় অনুবাদ) তা এ-দুটিতেই স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। অর্থবোধের সুবিধার্থে চিদানন্দ কবিতাকে দুটি স্তবকে ভেঙেছেন, যা মূলে নেই। অতএব ‘কমলালেবু’ কবিতাটির ভিতরে পুনর্জন্ম, মুমূর্ষু রোগী, শীতার্ত রাত্রি এবং শীতল কমলালেবুর নশ্বরতা মিশে আছে। ‘করুণ মাংস’ শব্দযুগল কমলালেবুকে মানবায়িত করেছে বলে মনে হয় যেন। যদিও কমলালেবুর শাঁস-কে ইংরেজিতে ‘ফ্লেস’ই বলা হয়। এ-প্রসঙ্গে মনস্ক পাঠকের ২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের শাহাদুজ্জামানের উপন্যাস ‘একজন কমলালেবু’-র কথা মনে পড়ে যেতে পারে। সেখানে এই কবিতাটির অনুষঙ্গ মনে রেখেই জীবনানন্দের এই জীবনী উপন্যাসটির নামকরণ করা হয়েছে। উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ের প্রথম অংশে আমরা পড়ি :
‘জীবনানন্দের শরীরের অবনতি ঘটছে শুনে সঞ্জয় অবশেষে দেখতে এলেন হাসপাতালে। জীবনানন্দ চোখ মেলে দেখলেন সঞ্জয়কে। সঞ্জয়ের হাতটা টেনে গালের উপর রাখলেন তিনি। জড়ানো গলায় বললেন, ‘একটা কমলালেবু খেতে পারব?’ জীবনানন্দ একবার ‘কমলালেবু’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন... (উপন্যাসে পুরো কবিতাটি উদ্ধার করা হয়েছে, যা এই প্রবন্ধে অপ্রয়োজনীয় বোধে বাদ দেওয়া হলো)
মৃত্যুপথযাত্রীর চোখে উজ্জ্বল টইটম্বুর কমলা জীবনের বহমানতারই আহ্বান। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জীবনানন্দ যখন একটা কমলালেবু খেতে চাচ্ছেন, তখন তিনি নিজেও মুমূর্ষু। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুর পরের তাঁর কাঙ্ক্ষিত কমলারূপী নিজেকেই খুঁজেছিলেন যেন তিনি’।
ঔপন্যাসিক কবির জীবনকে এ-কবিতার সঙ্গে একাত্ম করে দেখিয়েছেন। যদি সেভাবে নাও দেখি, এই ছোট্ট কবিতাটির ভিতরে কবির পুনর্জন্মকে আত্মদানের মধ্যেই বিলীন হতে দেখি আমরা। যদিও পাশ্চাত্যে প্রতীক হিসেবে কমলালেবু উর্বরতা, সৌন্দর্য আর চিরন্তনতার বার্তা বহন করে। স্বর্গলোকে অ্যাডামের আপেলের বিকল্প হিসেবে অরেঞ্জ-কে কেউ কেউ দেখেছেন। আবার ‘দ্য গডফাদার’ (১৯৭২) চলচ্চিত্রে কমলালেবুকে মৃত্যুর বার্তাবহ হিসেবেও দেখানো হয়েছে। ১৯৮৫-তে প্রকাশিত আমেরিকান কবি গ্যারি সোটোর জনপ্রিয় ‘অরেঞ্জেস’ নামক কৈশোরক প্রেমের কবিতায় দেখা যায় কমলালেবু সেখানে প্রেমিকার চকোলেটের পাশে আগুনে বিভা নিয়ে স্বমহিমায় কবির স্মৃতিতে উজ্জ্বল :
I peeled my orange
That was so bright against
The gray of December
That, from some distance
Someone might have thought
I was making a fire in my
hands.
আবার কবি ওয়েন্ডি কোপ ‘দ্য অরেঞ্জ’(১৯৯৩) কবিতায় একটা বড়মাপের কমলালেবু দিয়ে ভাগাভাগি করে লাঞ্চ সেরে জীবনে আনন্দের উপাদান খুঁজে পান (‘And that orange, it made me so happy’)। এহেন উজ্জ্বল স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু ফলরূপে পুনর্জন্ম এই ইকোলজিমুখর সমকালে জীবনানন্দের প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ স্বভাবকেও চিত্রিত করে। তাই ‘কমলালেবু’ কবিতাটিকে দুটি অনুবাদ ও একটি উপন্যাসের আয়নায় নিবিড় পাঠ-পুনর্পাঠের পর ভাবতেই পারি – ছয় লাইনের আপাতসরল গদ্যকবিতাটি কেবল পুনর্জন্ম আর নিঃশেষ আত্মদানকেই চিহ্নায়িত করে না; সুস্থ জীবনাকাঙ্ক্ষারও চিহ্নও এর গায়ে লেগে আছে। যে-সুস্থ, স্বস্থ আর আর উজ্জ্বল জীবন বাস্তবে পাননি কবি, পরিচিত মুমূর্ষুর কাছে কমলালেবু হয়ে যেন সেই জীবনের দিকে তাকে পৌঁছে দিতে চান। কারণ কবি তো নিজেই বিশ্বাস করতেন : ‘জীবনের শুভ অর্থ ভালো করে জীবনধারণ’ (অনুসূর্যের গান)।।
ঋণস্বীকার :
১) জীবনানন্দ দাশ। বনলতা সেন। ত্রিংশৎ সংস্করণ, মাঘ ১৪১৫। সিগনেট প্রেস। কলকাতা
২) দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত (প্রথম সংস্করণ, ২০১৫) : জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা : ৭৩
৩) Chidananda Dasgupta, Jibanananda Das (Makers of Indian Literature), 1972, Sahitya Akademi, New Delhi
৪) জীবনানন্দ-চর্চা। জীবনানন্দ চর্চা-কেন্দ্রে মুখপত্র (সম্পাদক : তরুণ মুখোপাধ্যায়)। ১ম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা। মাঘ-ফাল্গুন ১৪০১। চন্দননগর
৫) জীবনানন্দ : শ্রাবস্তীর কারুকার্য। তরুণ মুখোপাধ্যায়। ২০০৪। করুণা প্রকাশনী, কলকাতা
৬) একজন কমলালেবু। শাহাদুজ্জামান। ২০১৭। প্রথমা প্রকাশন। ঢাকা, বাংলাদেশ (পিডিএফ)
৭) Lawrence Venuti Edited, 2000, The Translation Studies Reader, Routledge, London and New York
এছাড়াও একাধিক ওয়েবসাইটের সাহায্য নিয়েছি।