আমার কৈশোরের কথা। বেশীরভাগ সময় নিঃসঙ্গ আমি, নিজে নিজেই সমবয়সী বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকতাম। ওরা যখন খেলত ঝগড়া করতো মারপিট করত তখন আমি নিঝুম সবুজ প্রকৃতিতে প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, বর্ষার লাল ভেলভেট পোকা, কেন্নো খুব কাছ থেকে তন্ময় হয়ে দেখতাম। ভয় ডর ছিল না। বর্ষায় যখন পুকুর টইটুম্বুর, তখন পাড়ের পাশে অশত্থ গাছের মগডালে চেপে জলে ঝাঁপ দিতাম। সন্ধ্যেবেলায় তিন মুড়িয়া দাদুর কাছে (দুই হাঁটু ও মাঝে মুন্ডু) বসে থাকতাম। উনি হুঁকো টানতেন আর কাশতে কাশতে রাতকথা শোনাতেন। শুনতে শুনতে লালকমল নীলকমলে হারিয়ে যেতাম। শরের তৈরি কলম ও নীল বড়ি গোলা কালি দিয়ে হাতের লেখা মকশো করতাম। আমাদের পুরনো মাটির দোতলা বাড়ির কোঠাঘরের জানালার পাশে বসে থাকতাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সময় অসম্ভব নির্জনতা ভেদ করে এক কালকেউটে ভাঙ্গা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে বের হতো। ছোট কুলোর মতো ফনাও তুলতো তারপর সর সর করে চরতে চলে যেত। রোজ বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হবার সময় ও গর্তে ফিরে আসত। এ নিত্য নৈমিত্তিক রুটিন। তারপর কবে যে ও কোথায় চলে গেল আমার মনে নেই। বাড়ির পিছনে পেয়ারাগাছের উপরে উঠে ওর সাথে কথা বলতাম, একটা ডাঁসা পেয়ারা আমাকে ঠিক পাইয়ে দিত।
প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপুজোর আল্পনা আঁকার ভার ছিল আমার। উঠোন থেকে শুরু করতাম লতাপাতা কলকা পদচিহ্ন মায়ের কুলুঙ্গি অব্দি। অনুভবে আসতো পিছনে ঘট কাঁখে পায়ে পায়ে আসছেন তিনি। ফিরে তাকাতাম,কেউ নেই। যেন এক লুকোচুরি খেলা। আমার খুব মজা হতো।
আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম বড় স্কুলে ভর্তি হলাম সেখানে আমার অতি প্রিয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু হল প্রদীপ মুখার্জী। তার বাড়ি আমাদের লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের ভিতরে। নাম হরিহরপুর। ওদের খুব বড় বাড়ি। করোগেটেড টিনে ছাওয়া চালা। অনেকগুলো ঘর। বাড়ি থেকে একাই সাইকেল নিয়ে চলে যেতাম সেখানে। দু পাশাড়ি ঘন জঙ্গল। কাঁচা রাস্তা। আমি একা। ছুটির দিন ওখানে কাটিয়ে বাড়ি ফিরতাম। তখন আমি ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। আমাকে কেউ বাধা দেয়নি। প্রদীপের বড়দা আমাদের সঙ্গে নিয়ে বন্দুক দিয়ে বুনো হাঁস শিকার করতে বেরতেন। দূরে সুবর্ণরেখা নদীর বিস্তীর্ণ বাঁধ। কংসাবতী প্রজেক্ট। দূরে নীল পাহাড়ের ব্যারেজের দিকে মুখ করে এ পাড় থেকে আমরা খুব জোর চেঁচিয়ে নিজেদের নাম ডাকতাম। প্রতিধ্বনি ফিরে আসত। ওদের ঘর থেকে একটু দূরে একটা পাহাড়ের টুকরো। আমরা পাথরের দেওয়ালে পাঁচজন নিজেদের নাম দুদিন ধরে খোদাই করেছি। দূর থেকে দেখা যেত নাম। পাশেই বহতা নদী। প্রচুর বনখেজুর মহুলফুল কেন্দুফল। আমরা খেতাম। একদিন দুপুরে একপাল জঙ্গলি হাতি নদীতে স্নান করতে এসেছিল। আমরা খুব কাছে ছিলাম। চুপচাপ। বসন্তের কথাবলা পাখির গান শুনতাম। আমের মঞ্জরীর সুবাস।
রাতে লন্ঠন ও ডিবরির আলো, রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তাক্ষরী, একটু কথাবার্তা শুষে নিতো বনজ আঁধার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন