অবলুপ্তি
আবার সেই উদ্ভিদপ্রাণীর মিশ্রিত বিরল গন্ধ! প্রফেসরের গা গরম হয়ে ওঠে। হাতের মুঠি শক্ত। শ্বাস ঘন হয়। শরীরে যেন দীর্ঘ পিপাসিত শয়তান ভর করেছে। বারান্দার পাশেই গন্ধগাছটার দিকে রক্তচোখে তাকান। ওই গাছটার গা ঘেঁষে সাপ ব্যাঙ কোনোকিছু পেরোলেই ওটার পাতা থেকে বিকট গন্ধ ছড়ায়। আর এখন যেটা চোরের মত চুপিচুপি গাছের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে, সেটার গা থেকে অদ্ভুত ভেজা মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে, ওটাকে দেখার জন্যে সারা পৃথিবী পাগল হয়ে আছে। যে জন্যই তার চাকরি আর নামডাক। আজ এর নিষ্পত্তি করতেই হবে। জীবন থাকুক বা চাকরি।
বড়ন্তি ফরেস্টের বিস্তীর্ণ লেকের এককোণায় বহু পুরোনো পরিত্যাক্ত রিসর্ট। দিনরাত অন্ধকারে ঢাকা আর কানফাটা ঝিঁঝিঁ শব্দ। গেস্ট হাউস ও বাংলোবাড়ি থেকে টুরিস্টদের সাবধান করা হয় ধারেকাছে না যেতে, বাজি লাগানোও হয়। যে ওই রিসর্টে গিয়ে একঘণ্টা কাটিয়ে আসবে তার সারাজীবনের জন্যে বাংলোতে থাকা খাওয়া ফ্রি। কিন্তু কারোর সাহস হয়না।
কিন্তু বর্ষার শুরুতে সন্ধে হবহব সময়ে রেঞ্জারের পোশাকে নিঃশব্দে একজন ওখানে আসেন। প্রফেসর পীযূষকান্তি। সেখানে ঢোকামাত্র নিশাচরেরা সরসর দূরে সরে যায়। বারান্দার পাশে ওই ভেষজঝাড়ির পাতায় হাত বোলান। গাছ আনন্দে গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। গাছের চারদিকে এক বিশেষ ধরনের অতিসূক্ষ্ম জাল বিছিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। এলাকার কেউ জানেনা উনি একজন আন্তর্জাতিক মানের হারপেটোলোজিস্ট, উভচর বিশেষজ্ঞ। দুনিয়ার তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী একটি বিরল সোনাব্যাঙের খোঁজে তাঁর উপর ভার দিয়েছে। সারা পৃথিবী তন্নতন্ন করে প্রায় চিরুণী তল্লাশি করে দেখা গেল একটি কি দুটি ওই বিশেষ প্রজাতির সোনাব্যাঙ পুরুলিয়ার বড়ন্তি অরণ্যে রয়েছে। কোস্টারিকার জঙ্গলে একদুটো ছিল, এখন আর নেই। এখানে পাঁচবছর ধরে গ্রীষ্মবর্ষা দুঃখবেদনা আক্রোশ সয়ে প্রফেসর আজ তার সামনা সামনি হতে চলেছে।
প্রফেসর ছোটো অতিবেগুনী স্ক্যানার টেলিস্কোপ চোখে লাগলেন। বেশ বড়সড় একফুট সাইজের শত্রু। মাদা। উজ্জ্বল বাসন্তী পিছল গা ফ্যাকাশে, সরুকালো ডোরাকাটা। গাছের নিচে বসে একদম স্থির। বড়বড় আধবোজা চোখ সতর্ক। দৃষ্টি স্থির। প্রফেসরের চোখে চোখ। হাঁফাচ্ছে। বয়েস দশ বারো হবে বুঝি।
‘তুই তো যমের দুয়ারে। হারামি? তবুও তোর রিভেঞ্জ চাই? আচ্ছা। আমিও তো তাইই চাই। এই জন্যেই তো দীর্ঘ পাঁচবছর হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতি সাতশো বছরে একটি করে প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। তুইই তো অন্তিম। আমার হাত দিয়েই হোক অবলুপ্তি’।
হঠাত্ অন্যরকম বুনো মিশ্র গন্ধ নাকে এলো। প্রফেসর দেখলেন ব্যাঙটার হাঁ মুখ থেকে লাল চাবুকের মত জিভ প্রায় দুফুট দূরের একটা ছোটো হলুদ চিতিসাপের উপর আছড়ে পড়ল। জিভের ফাঁস নিমেষে সাপটার পেটটাকে পিষে ফাটিয়ে ফেলতেই বেরিয়ে এলো সাদা সাদা ডিম। ব্যাঙটার বিস্ফারিত চোখের গোড়া ফুলে উঠে উজ্জল নীল ডুমো ডুমো থলে বেরিয়ে এলো। ও হরি! এই তবে নীল বিষ? ওটা কেবল গর্ভবতী মাদীকে নষ্ট করতে চায়? তাইবুঝি আমার পোয়াতি বউটাকে ও বিষদিয়ে মেরেছিল?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন