বুধবার, ১ জুন, ২০২২
ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"
‘দাঁতে দাঁত চেপে-চেপে কবে
অস্তিত্বের উৎস থেকে ফেটে পড়বে তীক্ষ্ণ একটা আদিম চিৎকার
--- কবে মুক্তি পাবে? কবে?
যন্ত্রণা, আমাকে তুমি সাতপাকে অসহ্য বেঁধেছ। (যন্ত্রণা)
ভিক্টর হুগো বলেছিলেন : ‘যন্ত্রণা আমি তোমাকে ভালোবাসি, দুঃখ তুমি হও আমার রাজমুকুট’। আর সেই যন্ত্রণার ঘুঙুর বুকে বেঁধেই কবিতার যাত্রা শুরু। আদিকবি বাল্মীকি শোক সঞ্জাত শ্লোকটিও তো কম যন্ত্রণাবিদ্ধ উচ্চারণ নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বেদনাকে বোধনা উত্তীর্ণ করার মন্ত্র শেখালেও জীবনানন্দকে বড় যন্ত্রণায় উচ্চারণ করতে হয়েছিলো ‘বেদনার আমার সন্তান’। আর এঁদেরই উত্তরজাতক চল্লিশের কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় বীজমন্ত্রের মতো এই যন্ত্রণার
অনুভব আবর্তিত হয়। তাঁর বিখ্যাত কবিতাটির নামও আমাদের একলহমায় মনে পড়ে যায়, যেন অস্ফুটে বলে উঠি ‘ক্ষুদিরামের মা
আমার কানাইলালের মা / জননী যন্ত্রণা আমার জননী যন্ত্রণা’। আর সেইসঙ্গে এও মেনে নিতে হয় মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় বাঙালি মানসে কেবল ‘জননী যন্ত্রণা’রই কবি। ১৯২০ থেকে ২০০৩ – তিরাশি বছরের জীবনে অসংখ্যা কবিতা, গদ্য ও অনুবাদের স্রষ্টা হয়েও এই একটি কবিতা তাঁকে স্মরণীয় করেছে। এ-কবিতা রচনার পিছনে উত্তর-স্বাধীনতা পর্বের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা যেমন আছে, তেমনই দেশমাতৃকাকে উদ্দেশ্য করে রচিত এ-কবিতায় পাই মাতৃপ্রতিমার বন্দনা গান। মার্ক্সীয় চেতনায় দীক্ষিত তিনি হয়েছেন ততদিনে, আর তাই ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের পরোক্ষ প্রভাবও এখানে এড়িয়ে যাওয়া যায় না কিছুতেই। পাভেলের অসহায় মা ক্রমশ পাভেলের মাধ্যমেই বহু বিপ্লবীর মা তথা বিপ্লবের ধাত্রী হয়ে উঠেছিল। সন্তানকে জন্ম দিয়ে বড় করা, তার সুখী দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন দেখা মা যখন ছেলেক বিপ্লবের পথে এগোতে
দেখে, ভয় পায়। তবু সেই সন্তান সত্যের পথে হেঁটে যখন পুলিশের হাতে বন্দি হয়, মাতৃহৃদয়ের যন্ত্রণা প্রতিবাদ হয়ে ফেটে পড়ে
‘রক্তের সমুদ্দুর বইয়ে দিলেও তোমরা সত্যকে ঢেকে রাখতে পারবে না’। এ-কবিতাতেও ‘ক্ষুদিরামের মা কানাইলালের মা’-এর ভিতরে দেশমাতৃকার যে-ছবি আঁকেন মঙ্গলাচরণ, সেখানে বিপ্লবী ছেলেকে হারিয়েও হাজার কর্মী ছেলের মা হয়ে ওঠার প্রতীকটি উজ্জ্বল
হয়ে ওঠে।
২.
গত শতাব্দীর চল্লিশের কবি তিনি, একথা বললেই যেন অনিবার্যভাবে সাম্যবাদী কবিতার ধারায় তাঁর স্থানাংক নির্ণয়ের অনিবার্য প্রয়াস চোখে পড়ে। অথচ ‘স্নায়ু’(১৯৪১) কিংবা ‘মনপবন’(১৯৪২)-এ তো সেভাবে আসেনি তাঁর বামপন্থী দায়বদ্ধতা। প্রথম কাব্যের প্রথম কবিতার পঙ্ক্তিটিই এমন ‘সদ্গতি হোক্ পলাতক আত্মার : / নীল অরণ্যে সোনার হরিণ-চাওয়া’। লেখেন ‘কবি আমরাই, শিল্পী আমরা : রামগিরিতে / যক্ষের মতো হৃদয়-বিলানো আদিম ছড়া’ কিংবা ‘তোমার জানালা দিয়ে হয়তো বা চোখে পড়ে সবুজ মৃত্যুর / আশ্চর্য মমিকে আজো’। এসব মগ্ন উচ্চারণের সঙ্গে হয়তো বা উত্তরকালের মঙ্গলাচরণকে অনেকেই মেলাতে পারেন না। তবু যে-কবি প্রথম কাব্যে লিখেছিলেন ‘বিপ্লবীরা ফিরে গেছে আজ / এসো না শান্তির নীড় বেঁধে রাখি এইবার কপোত-কপোতী’ তিনিই তো পরিণত বয়সে এসে লিখতে পারেন ‘সারাটা সংসার একটি মুখ, সে-ই আমার ভালোবাসা’। মার্ক্সীয় চেতনার জাগরণ সত্ত্বেও এই রোম্যান্টিক মন তিনি হারিয়ে ফেলেননি বলেই রাশিয়া-ফেরত ‘সূর্যের সাম্রাজ্যে ভিন্দেশী’ কাব্যে মস্কোর আকাশে ‘বিষণ্ণ উষ্ণ আর্দ্র চাঁদ’ দেখতে পান। যদিও ততদিনে তিনি ব্যক্তিগত প্রেম থেকে বিশ্বগত ভালোবাসায় সন্দীপ্ত হয়েছেন, তাই ‘তোমাকে খুঁজব, তাই’
কবিতায় বলেন ‘ মানুষ এখনও তুমি আছ নিজমনে অমলিন / ফিরে পেতে সার্বভৌম মন? - / তোমাকে খুঁজব, তাই বাঁচতে আজও সাধ!’ আর অগ্রন্থিত ‘সেই অস্তিত্বের’ কবিতায় চৈতন্যের কপাট হাট করে
দিয়ে ‘হঠাৎ একটা মন’ তাঁর অন্বিষ্ট ও আশ্রয় হয়ে উঠতে দেখেন সমালোচক তরুণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর অভিমত ‘এই মন-দেশ-সমাজ-মানুষ ছুঁয়ে আপন নারীর কাছে নতজানু হয়। রমণীর মনে মন মিশাতে চায়। আবার সেই নারীমুখই জননী যন্ত্রণা হয়ে ওঠে।’ (প্রেমিক কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়)
৩.
পুরাণ শব্দের মধ্যে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের দূরত্ব মনে মনে পূরণ করে নেওয়ার আভাস দেখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। মঙ্গলাচরণের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (ভারবি, ১৯৮৩) থেকে ‘কবিতা সংগ্রহ’ (দে’জ, ২০০৬) কিংবা সাম্প্রতিক ‘কয়েকটি কবিতা’ (স্পার্ক, ২০১৭) –এর পাতা উলটে গেলে প্রথম কাব্যে থেকে জীবনের প্রায় শেষ অবধি তাঁর পুরাণপ্রীতি চোখে পড়ে। তাঁর ‘একলব্য’ কাব্যনাটক বিখ্যাত হয়ে আছে পুরাণকাহিনির অবয়বে প্রান্তিকের প্রতিবাদকে তুলে ধরেছে বলেই।‘স্বর্ণমৃগ মারীচ’ গুরু দ্রোণকে একটি আঙুল দক্ষিণা দিতে গিয়ে একলব্য এখানেও দ্বিধান্বিত হয়নি, ওদের পৃথিবীতে উঁচুলোকেদের দাবি এসে সবই নেয়, তবু বিবেকের মতো সম্মিলিত বনবাসীদের কণ্ঠস্বর জানায় : ‘এ-রাত্রি মূর্ছার তবু এ-মোহমুক্তির রাত্রি / যন্ত্রণার যন্ত্রণাজয়ের রাত্রি / এ-রাত্রির মাঝখানে শুয়ে আছে একলব্য : রক্তস্নানে সম্পূর্ণ মানুষ’। এ-নাটকে কবিতার ভাগ বেশি হয়ে নাট্যগুণকে খর্ব করেছে বলেই অধিকাংশ সমালোচক মনে করেছেন, তবু পুরাণের কাহিনিকে নাটকের অন্তর্গত করে বিশ্বাসের মৃত্যুর যে-ছবি কবি আঁকেন, তা চিরকালীন। আবার প্রথম কাব্যে ‘সব্যসাচী’ এবং ‘শকুনি’ কবিতাদুটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সব্যসাচী অর্জুনের কণ্ঠে শুনি এই খেদ ও স্বীকারোক্তি ‘হে বাসুকি, বৃথা ফনায় আগুন জ্বালো! / ভুলব না আমি কৃষ্ণচুড়ার নীড় / পৃথিবীর মায়া আজো চোখে আগে ভালো’। তবে ‘শকুনি’ কবিতাটি জীবনের পাশাখেলাকে তাৎপর্যমণ্ডিত করেছেন : ‘তোমার পাশার ছকে আমাদের ঘোরাফেরা মিট্লো না আজো;/ শকুনি। কঠিন বন্ধু।’ রামায়ণ থেকে মহাভারতের দীর্ঘ যাত্রাপথে তিনি সঙ্গীহীন পাখির মতো ‘লাঞ্ছিত শকুনি’কে পেয়েছেন। কবির কাছে সকলের কাছে নিন্দিত শকুনিমামাই ‘পৌরাণিক পৃথিবীর একমাত্র স্বত্ব-অধিকারী।’ যেন একালের পাণ্ডব হয়ে কবি বলতে চান, রূঢ় বিশশতকের প্রাণহীন ধূসর গানের ছায়ায় একালের প্রেয়সী থেকে আমরা সকলেই আচ্ছন্ন। তাই আমাদের আপাত ধর্মনিষ্ঠা বা সৌভাগ্যের আড়ালে কুটিলতা, জটিলতা রয়ে যায়। একা শকুনিই লাঞ্ছিত হয়, অথচ তার সেই পাশাখেলার চক্র আমাদের মুক্তি দেয় না। আবার রাজনীতি সচেতন মন নিয়ে যখন তিনি লেখেন ‘তেলেঙ্গনা ও অন্যান্য কবিতা’, যেখানে শিশুরাষ্ট্র তেলেঙ্গানায় তিনি সূর্যের ঠিকানা খোঁজেন আর বলেন ‘আমার কাস্তের হাতে তোমার হাতুড়ি তুলে দাও, তেলেঙ্গানা’; সেখানে আসে নীলচাষি তোরাপের ক্রোধ এবং মনসামঙ্গলের সাঁতালি পর্বতের গুপ্ত ছিদ্রপথে লৌহদৃঢ় বন্ধুতার শত্রুদের হানা দেওয়ার প্রসঙ্গ। আবার ওই কাব্যের ‘কোনো শহীদ কমরেডের উদ্দেশে’ কবিতায় দেখতে পাই রামায়ণের উপমা ‘এ-দেশ তোমার সীতা অশোকবনের? মধ্যে কান্নার অশেষ / সমুদ্রকল্লোল, মধ্যে আত্মোৎসর্গের সেতুবন্ধের প্রাণপণ / রক্তাক্ত তোমার চেষ্টা?’ ‘জন্মদুঃখিনী মা’ কবিতায় স্বদেশকে উদ্দেশ্য করে সখেদে বলেন : আমিই কী বুঝি বুকে কী আগুন বন্দিনী সীতার! / বিবস্ত্রা দ্রৌপদী কেন ছিন্নমস্তা আমিই কী জানি!’। সেই মায়ের পায়ে রক্তের আলতা পরাতে চান কবি। সুমিতা চক্রবর্তী থেকে জহর সেন মজুমদার মঙ্গলারণের কবিতায় এই মায়ের প্রতীকে স্বদেশের মুখচ্ছবি কীভাবে হয়ে উঠেছে তা দৃষ্টান্ত সহ দেখিয়েছেন। এই মা কখনও ফুটপাথের শুকনো মুখের বিষাদপ্রতিমা, কখনও তিনি ঘুমন্ত শিশুর শিয়রে বসে আকাশপিদিম চোখে নিয়ে জেগে থাকেন ‘জাগে আশা জাগে কেবল মা / এখন মা গাইছে ঘুমপাড়ানি গান।’ তবে এই মাতৃপ্রতিমার সর্বোচ্চ স্ফুরণ ‘জননী যন্ত্রণা’য় সেখানে কালিঢালা নদী, ভাসান ভেলা, ঢেউয়ের ছেলেখেলা আমাদের কর্ণের বিড়ম্বিত জীবন ও কৃষ্ণকথা ঈষৎ মনে করায়। তবে ‘বৈরী মন’ কাব্যের ‘অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে’ কবিতাটির ভিতরে অন্ধকার সিংহদ্বার ঠেলে কবির হস্তিনা-প্রাসাদ দর্শন করে দেখেন, এ তাঁর সমকালের ছবি। মনে হয় ‘কুরুক্ষেত্র তাই রাত্রিদিন / হৃদয় আমার কুরুক্ষেত্র’। অসূয়া-উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আত্মমোহে আক্রান্ত কবিমন অন্ধ অস্তিত্বের সিংহদ্বারে আঘাত করেন। আবার কখনো বা কবি লেখেন ‘গঙ্গা গাঙুরের নীরে ভাসালাম বেহুলার ভেলা’। আর অগ্রন্থিত সংগ্রহের ‘এখনও বুদ্ধ’ কবিতায় ভগবান বুদ্ধকে পুরাণের দশাবতারের তালিকা থেকে বাদ দিতে
চান কবি। রক্তপায়ী হিংস্র ধর্মের প্রতিপক্ষ বুদ্ধ তাঁর কাছে ‘চিরবিদ্রোহী’ আর তাই ‘মানুষের জঙ্গলে মানুষ খোঁজাই
বোধিবৃক্ষের সন্ধান’ – এই যথার্থ মানুষ স্খলনে-পতনের অবরোহন থেকে নিত্য আরোহী হতে পারে, এমনই বিশ্বাস তাঁর।
৪.
অনুবাদক মঙ্গলাচরণের কলমে নেরুদা, লোরকা, মায়াকোভস্কি কিংবা পুশকিন পুনর্জন্ম নিয়েছেন। করেছেন আরও একাধিক অনুবাদ, যার কিয়দংশ ধরা আছে শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ (প্রথম প্রকাশ ১৩৬৯) নামক বিশ্বকবিতার বরেণ্য সংকলনে। লোরকার ‘গোলাপের গজল’-এর অনুসন্ধানী গোলাপ, নেরুদার ‘ধর্ষিতা দেশ’, ‘প্রত্যাবর্তন’-এর স্বদেশভাবনা, পুশকিনের রোম্যান্টিকতা থেকে মায়াক্সভস্কির ‘সম্মিলিত যাত্রা’র মতো কবিতাও। পুশকিনের কবিতাবলীতে মাঝে মাঝে একটু প্রাচীন রীতি ব্যবহার করলেও মায়াকোভ্স্কি বা নেরুদার স্বচ্ছন্দ অনুবাদ আমাদের মুগ্ধ করে :
পুশকিন : হেমন্ত আমার প্রিয়; বসন্তে বিহ্বল মন মোর;
নেরুদা : গোলাপের মন / মজে না গোলাপ রাগে। / আকাশচিত্রে মূর্ছিত, ও-কি খোঁজে / আর কিছু, আরো কিছু!
মায়াকোভ্স্কি : গতি আমাদের ইষ্ট – যেন না ভুলি। / হৃৎপিণ্ডটা বাজে বুঝি দুন্দুভি।
বিশেষত মায়াকোভ্স্কির অনুবাদে তিনি বেশকিছু দেশীয় অনুষঙ্গকে এনেছেন। এই ‘সম্মিলিত যাত্রা’য় যেন প্রাণবন্ত তরুণ সমাজ সমস্ত পুরাতন ধ্যান-ধারণা আর রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ ভেঙে সবেগে সমুদ্যত। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সমকালে লেখা এ-কবিতাকে সমাজবিপ্লবের কবিতা বললে ভুল হয় না। যেভাবে ‘ঝড়ের পাখির গান’-এ গোর্কি রূপকের আশ্রয় নিয়েছিলেন, এখানে তা নেই। বরং স্পষ্ট ভাষায় বিপ্লবীরা নিজেদের ‘দ্বিতীয় প্রলয়’ বলেছে। বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে এই বিপ্লব যেন বলতে চায় ‘আমাদের এই গান হতে কোন্ অস্ত্র-সে খরতর’? গান এখানে সামূহিক প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরের দ্যোতক। তাই ধীর পায়ে চলা পুরনো সময়কে নতুন প্রজন্ম এসে গতি দেয়, প্রথাগত ঈশ্বরের বদলে তারা গতির আরাধনা করে। সবুজ ঘাস তারুণ্যের চিহ্নবাহী হয়ে ওঠে। আর সমস্ত কুসংস্কার আর দৈব নিয়ন্ত্রণকে ছাপিয়ে মায়াকভ্স্কি বলেন : ‘গ্রহদের মুখ চেয়ো না, ভেবো না স্বস্ত্যয়নের কথাও’। বামপন্থী কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে যে-মায়াকভ্স্কিকে আমরা পাই তিনি প্রতিবাদী, বিদ্রোহী ও জনমুখী কবি। কমিউনিজমে ব্যক্তি নয় গোষ্ঠী গুরুত্ব পায়, তাই ‘সম্মিলিত যাত্রা’ অনুবাদ-কবিতায় বারংবার আমরা/আমাদের/মোরা ঘুরে-ফিরে এসেছে। অনুবাদক মঙ্গলাচরণের মৌলিক কবিতাতেও দেখি স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ আর স্বপ্নের পুনর্নবায়নের অঙ্গীকার বহন করেছে ‘সোভিয়েত ভূমি’। অনুবাদকের কাজ নিয়ে মস্কো-প্রবাসকালে মস্কোকে ভাবেন দ্বিতীয় কলকাতা। আরেকটি কবিতায় তিনিই লেখেন : বড্ড বেশি ডাইনে ঘেঁষে চলতেছিলাম নাকি? / এবার বাঁয়ে চলবে কলম বামমার্গে মন / চলতে হবে মায়াকভ্স্কির ছন্দে-তালে-লয়ে / বাঁয়ে এবং বাঁয়ে? (‘সাবধান, মস্কো!’, সূর্যের সাম্রাজ্যে ভিনদেশী : ১৯৮৩)
৫.
প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তনী, পেশায় স্কুল শিক্ষক কবি মঙ্গলাচরণের জন্মশতবর্ষ প্রায়
নীরবেই কেটে গেছে। একদা তাঁর মৃত্যুর পর অমল করের ‘ঝড়ো হাওয়া’ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল একটি ফোল্ডারে; তারপর দে’জ-এর ‘কবিতাসংগ্রহ’ এবং স্পার্ক প্রকাশিত ‘কয়েকটি কবিতা’ ছাড়া আর তেমন চর্চা হয়নি তাঁকে নিয়ে। শতবর্ষে ইউসুফ মোল্লার বর্ণিক পিডিএফ পত্রিকার ২০২০ ডিসেম্বর সংখ্যা ব্যতীত কোনো কাজ তাঁকে নিয়ে কেন হলো না? বহু পত্রপত্রিকাকে অনুরোধ করেও করাতে পারিনি। কবিকন্যা চিত্রশিল্পী শমিতা বসু ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কাজ করেছেন, আমাদের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েও সাম্যবাদী কবিতার ধারা নিয়ে কবি সব্যসাচী দেবের আন্তর্জলিক আলোচনায় প্রসঙ্গত এসেছেন তিনি, আবৃত্তি
করা হয়েছে তাঁরই কবিতা ‘আমার ভালোবাসা’। তবু সমানবয়সী কবিবন্ধু বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৫) তাঁর জন্মশতবর্ষে ২০২০-২১-এ যেভাবে ছোট পত্রিকা থেকে দৈনিকের পাতায় পাতায় উদ্যাপিত হয়েছেন, সেখানে তুলনায় মৃদুকণ্ঠ বলেই কি এতখানি অবহেলিত থেকে গেলেন মঙ্গলাচরণ? বন্ধু বীরেন্দ্রকে নিয়ে একাধিক কবিতা এবং মূল্যবান গদ্যগ্রন্থ
‘কঠিন সবিতাব্রত’ তো তিনিই লিখেছেন। অথচ বীরেন্দ্র-শতবর্ষে সেই সূত্রেও মঙ্গলাচরণ স্মৃত হলেন না, এ বড় বিস্ময়কর! আবার গোর্কি-লেনিন কিংবা হাশ্মি-মানিক-সোমেন-সুকান্ত-সমর প্রমুখ যেমন রাজনৈতিক বিশ্বাস, প্রতিবাদী স্বভাব ও শ্রদ্ধার কারণে তাঁর কবিতার বিষয়ীভূত হয়েছেন;
তেমনি একালের পরিবেশচেতনা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল মেধা পাটেকরকে নিয়ে ‘নদী ও নারী’র মতো
ইকোপোয়েট্রি কিংবা ‘মাথায় লটকানো আজ ভূপালের নিহত আকাশ’। বাংলা ভাষা, কলকাতা আর জননী ও কন্যকারূপী স্বদেশের প্রতি ছিল তাঁর অসীম মমতা। প্রেমে-প্রতিবাদে, শোকে-যন্ত্রণায় মুখর তাঁর কবিতা জীবন ও রাজনীতিকে একবৃন্তে গেঁথে আলো-অন্ধকারের গোলকধাঁধা পেরিয়ে খুঁজতে চেয়েছে ‘সেই অস্তিত্বের চাবি’। প্রতীচ্যের অস্তিত্ববাদও চায় অস্তিত্বের সংকটকে দূর করে মানুষের স্বাধীনতা বা মুক্তি। কবির সেই অস্তিত্বই কবিতার মধ্য দিয়ে ঘটাতে চেয়েছে তাঁর যন্ত্রণার বন্ধনমোচন, আর ‘স্বপ্ন-শবদেহ’ বহনের আত্মগ্লানি থেকে বিশ্বজনীন যন্ত্রণাবোধের ভূমিতে উত্তীর্ণ করেছে বারংবার।।
(পান্ডুলিপি চিত্রটি কবিকন্যা শমিতা বসুর সৌজন্যে প্রাপ্ত)