রবিবার, ১ মে, ২০২২

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "রবীন্দ্রকাব্যে নারী"

 

রবীন্দ্রকাব্যে নারী

এরপর দশবছর কেটে গেল। কবির নাট্যচিন্তা নতুন পথে অগ্রসর হতে থাকল কবির অন্তরে। ১৯১০ সালেরাজালেখা হল ততদিনে কবির মন অনেকটাই প্রতীকধর্মী নাটকের দিকে ঝুঁকেছে। ১৯২৬ সালে তিনি লিখলেন তাঁর পূর্ণরূপে প্রতীকধর্মী নাটকরক্তকরবী’, কিন্তুরাজা’-কে তারই পূর্বসূরী বলতে হয় নিশ্চয়ই। নাটকের পাত্রপাত্রীকে প্রতীক হিসাবে না নিলে কবিকে এখানে যেন আবার ফিরে যেতে দেখি তাঁর অনেক পুরোনো আরোপিত নারীভাবনায়। গান্ধারীকে উপস্থাপনা করার দশবছর পরে কোন নারীকে নাটকে উপস্থাপিত করেন কবি রানী সুদর্শনার মধ্যে? সে এক বুদ্ধিহীনা, পথভ্রষ্টা নারী অনেক দুঃখ, অনেক আত্ম-অবমাননার মধ্য দিয়ে নাটকের শেষে সে উত্তীর্ণ হয় সার্থকতায়। এখানে নারী বড়ই সামান্যা, রূপতৃষ্ণায় সে পথ ভোলে, বাইরের সাজপোষাক, চাকচিক্য তার কাছে বড় হয়ে ওঠে। এক ভৃত্যের বাইরের রূপে মুগ্ধ হয়ে সে পরমসুন্দরকে অন্তরে গ্রহণ করতে পারে না। আর অন্য দিকে আছে তার দাসী সুরঙ্গমা, তার মধ্যে কেবল দাসীসুলভ আত্মনিবেদন, সেখানে প্রেমের মহিমা অনুপস্থিত। নাটকের নায়ক, রাজা, দেখা দেন না কখনো, কিন্তু শোনা যায় যে তিনি ভয়ঙ্কর, তথাকথিত মনোহর রূপ তাঁর নেই এই কথাটুকু অন্তরে গ্রহণ করে তাঁকে প্রিয় বলে জানতে সুদর্শনাকে অনেক অপেক্ষা করতে হয়, অনেক দুঃখ সইতে হয় তিনি যেন পরমপুরুষ, প্রায় বিধাতার মতো মহিমান্বিত।

 

প্রতীক হিসেবে না নিলে নাটকে রবীন্দ্রনাথ নারীর মূঢ়তা বাইরের চাকচিক্যের প্রতি আকর্ষণের 

চিত্রই এঁকেছেন। কিন্তু রাজা, যিনি নায়ক, তিনি এই নাটকে কোথাও দেখা দেন না, অনেক কথায় শুনি তিনি কেমন তাই নিয়ে অজস্র জল্পনা। তাঁর ধ্বজায় না কীপদ্মফুলের মাঝখানে বজ্র আঁকা তিনি না কী ভয়ঙ্কর। মোটামুটি মনে হয় যে কবির মনে তাঁর প্রাণপ্রিয় ঈশ্বরকে নিয়ে যে কল্পনা তাই দিয়েই রাজার মূর্তিটি তিনি এঁকেছেন। এদিকে রানী ভুলেছেন যাঁর মোহন মূর্তিতে তাঁর নামটি খেয়াল করতে হয়। সেই মানুষটি, যাঁর বাইরের মনোমোহন রূপে সবাই ভোলে কিন্তু যে আসলে কাঞ্চীরাজের ছত্রধারী, তার নামসুবর্ণ নামটি অর্থের সঙ্গে একাত্ম, এবং আমাদের মনে পড়ে যে কাঞ্চীরাজ বলছেন যে সুবর্ণ যদি তাঁর মাথায় ছাতা ধরে তবে তার টানে সুদর্শনা কাঞ্চীরাজের গলায়ই মালা দেবেন। তবে কী নারীর অর্থলিপ্সা, রূপলিপ্সা দুটোকেই কবি প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরছেন? এই দুটোই কী তবে নারীকে পরম প্রেমের পথ থেকে বিচ্যুত করে? অনেক দুঃখে সে মোহ কেটে গেলে তবেই কী তার উত্তরণ?

 

কিন্তু এখানে হয়ত ভুল হচ্ছে। সুদর্শনাই বা তবে কেন একান্তই এক নারী? সে তো যে কোনো পথভ্রষ্ট মানুষের প্রতীক, যে ঈশ্বরের সত্যরূপ না চিনে ভ্রমপথে নিজেকে হারিয়েছে? এখানে কী তবে রাজা সেই পরমপুরুষ আর বাকি সকলেইপ্রকৃতি,’ যারা তাঁকে পেলে তবেই সম্পূর্ণ হবে? সেই কারণেই হয়তো বা সুদর্শনাকে নারী হিসাবেই চিত্রণ করা হয়েছে।

 

আর একটু এগিয়ে গেলেরক্তকরবী’-তে দেখি নন্দিনী একান্তভাবেই প্রাণের প্রতীক যে প্রাণশক্তি খণির গভীরে অর্থসন্ধানী মানুষগুলোকে বেঁচে থাকবার অর্থ শেখায়, স্বর্ণশৃঙ্খলে বাঁধা অন্ধকারে থাকা খণির মালিককে বাইরে টেনে আনে। এরই সঙ্গে মনে রাখতে হয় যে গভীরতম বিন্দুতে প্রাণ আর প্রেম অভিন্ন, আর তাই নন্দিনী প্রাণের প্রতীক, আবার তার মধ্যেই আমরা এক প্রেমশূন্য জগতে প্রেমের পূর্ণ প্রকাশ দেখতে পাই। কবির নারী সম্বন্ধে ধারণার পূর্ণ এক প্রতীকি প্রকাশ হিসেবেই আমরা নন্দিনীকে হয়তো বা দেখতে পারি।

রবীন্দ্রনাথের নাটকের নারীচরিত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত চরিত্র তাঁর শেষবয়সে আঁকা চিত্রাঙ্গদা।

নৃত্যনাট্যের শেষে ‘আমি চিত্রাঙ্গদারাজেন্দ্রনন্দিনী’ বলে কিছু কথা চিত্রাঙ্গদা বলেন,

        আমি চিত্রাঙ্গদাআমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।

                        নহি দেবীনহি সামান্যা নারী।

                   পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে

                                  সে নহি নহি,

                   হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে

                                  সে নহি নহি।

                   যদি পার্শ্বে রাখ মোরে

                                  সংকটে সম্পদে,

                   সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে

                                  সহায় হতে,

                             পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।

 

পুরুষের কলমে লেখা এই পংক্তিগুলি তো নারীবাদের শেষ কথা। নারী যে পুরুষের কেবল নর্মসঙ্গিনী না হয়ে পুরুষের কর্মসঙ্গিনী হতে পারেন একথা কবি জীবনসায়াহ্নে শেষপর্যন্ত মেনে নিলেন বহির্বিশ্বের দায়িত্ব নিয়ে পুরুষের কাজ করেও চিত্রাঙ্গদা শ্রেষ্ঠ নারী হয়ে উঠেছেনপুরুষের পাশে যে থাকতে চায়যে সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার দাবি করে দেবী হিসাবে কবি আগে এঁকেছেন ‘তপতী সুমিত্রাকে আজ তিনিই চিত্রাঙ্গদার মুখ দিয়ে নারীর উপরে দেবীত্ব আরোপের বিরুদ্ধে কথা বললেন। নারীর ‘ক্ষুদ্র ক্ষীণ পদক্ষেপে’ যে অশুভের ছায়া কবি দেখেছিলেন কোন মন্ত্রবলে যেন তা চিত্রাঙ্গদার কল্পনায় 

বিলুপ্ত হয়ে যায়নারীর মধ্যে বৃহত্তর কল্যাণের ছবি অবশেষে কবি প্রত্যক্ষ করেন এখানে আরো লক্ষ্যণীয় যে শুরুতে অর্জুনের সঙ্গী হিসাবে বা কোনো রাজার কন্যা হিসাবে পুরুষের পাশে 

আমরা চিত্রাঙ্গদাকে দেখি না তাঁর সম্বন্ধে প্রজাদের কাছে শুনি একাকিনী নারীর মধ্যে বীর্য  স্নেহের অসামান্য সংমিশ্রনের কথা,

স্নেহবলে তিনি মাতা

        বাহুবলে তিনি রাজা

 

তবে নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের স্বীকৃতির কথাটুকু বলে শেষ করলে চিত্রাঙ্গদার চরিত্রচিত্রণের পূর্ণ মূল্যায়ন বোধহয় হয় না। চিত্রাঙ্গদার চরিত্রচিত্রণে কবি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছেন। স্নেহে-প্রেমে-বলবীর্যে তিনি সম্পূর্ণাঅসামান্যা। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। প্রাচীন ভারত নারীর যৌনতাকে চিরদিন স্বীকার করেছে। পুরাণ রচনার সময় থেকেই নারী কেবলমাত্র ব্যবহৃত ধন। চিত্রাঙ্গদার কামনার পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েছে মহাভারতের কাহিনিআর সেই কাহিনি রবীন্দ্রনাথের কলমে প্রাণ পেয়েছে নারীত্বের অমলিন মহিমা প্রকাশে। চিত্রাঙ্গদা কেবল গান্ধারীর মতো মহীয়সী নয়। সে রক্তেমাংসে গড়া সেই মেয়ে যে নিজের কামনার কথা স্বীকার করতে লজ্জিত নয়যে তার কামনা পূরণের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি। সে বরণের ডালি নিয়ে নিজেই অর্জুনকে সম্বোধন করে। প্রত্যাখ্যানের পর অন্য উপায়ে অর্জুনকে মোহিত করতে পিছপা হয় না। সে কী চায় তা সে জানেআর তা যে কোনো প্রকারে লাভ করতে চায়। কিন্তু সুদর্শনার মতো তার কিন্তু রূপমোহ নয়। সেটা অর্জুনের মধ্যেই বরঞ্চ দেখি। কুরূপা চিত্রাঙ্গদাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ব্রহ্মচর্যের বুলি আউড়েআর সুরূপাকে দেখেই উচ্ছ্বাসে  কি স্বপ্ন না কী মায়া ইত্যাদি আওড়াতে থাকেন। অর্জুনকে চোখে দেখে চিত্রাঙ্গদার চিত্তবৈকল্য হয় নাকেবল তাঁর পরিচয় পেয়ে তিনি অধীর হন তাঁকে পাবার 

জন্য।

বীর বলে অর্জুনকে তিনি চেনেনআর শ্রেষ্ঠ বীরের গলায় তিনি বরমাল্য দেবেন। অর্জুন বীর নারীকে চিনতে পারেন নাতিনি ছলনাময়ীর মোহে ব্রহ্মচর্য ব্রতভঙ্গ করেন। স্নেহেপ্রেমেবীর্যেবিচারবুদ্ধিতেকামনার প্রচন্ডতার বলে বলীয়ান সম্পূর্ণ মানবী মহীয়সী চিত্রাঙ্গদার কাছে তিনি কতই না হীন হয়ে যান!

 

একটা কথা মনে পড়েই। ‘রাজা  রানী’ আর ‘তপতী’ দুই নাটকেই সুমিত্রা যেন কামনার ঊর্ধ্বে। সুমিত্রাকে সম্পূর্ণ করে পা না বলেই রাজা বিক্রম যেন প্রেমে পূর্ণতা অনুভব করতে পারেন না। সর্বদা অতৃপ্ত তিনিসুমিত্রার চরিত্রের অসামান্যতা তাঁর কাছে প্রহেলিকা। তার মহৎ চিন্তা তাঁকে প্রভাবিত করতে পারে না। রানিকে সামান্য নারীর মতো সম্পূর্ণ করে না পেয়ে অতৃপ্ত কামনার বিকারে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান তিনি খানে রবীন্দ্রনাথ যে নারীকে আঁকলেনতিনি যেন পূর্ণ রক্তমাংসে গড়া কেবল পুরুষের কামনার ধন নন। তিনি পুরুষের সামান্য শরীরি কামনাকে অনেক দূর ফেলে আপন স্থির লক্ষ্যের সন্ধান করেন। মননধর্মবোধ  চারিত্রিক বলে সুমিত্রা রাজা বিক্রমকে অনেক পিছনে ফেলে আমাদের মনের পূর্ণ শ্রদ্ধা দাবি 

করেন ঠিকইকিন্তু সুমিত্রা নিজে কামনার ঊর্ধ্বে যেনতাঁর মধ্যে নারীত্বের পূর্ণতা আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি না। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা যত মহৎবীরাঙ্গনা এবং কর্তব্যপরায়ণাই হোন না কেনতাঁর মধ্যে এই অভাব আমরা দেখি না। তিনি অর্জুনকে দেখে কামনায় অধীরা হন। অর্জুনের প্রত্যাখ্যানে অপমানিতা হয়েও তিনি প্রেমাষ্পদকে লাভ করবার জন্য আকুল হয়ে দেবতার দ্বারস্থ হন। মদনের আশীর্বাদে তাঁকে অনেক কিছুই সাময়িকভাবে ত্যাগ করতে হয়। রাজ্যপাটপ্রজাপালনযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়াসবই একবছরের জন্য ছাড়তে রাজি হন তিনি প্রেমের সার্থকতা 

চেয়ে। এখানেই তিনি  সুমিত্রার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক গুণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। একটি বছরের জন্য ছদ্মবেশেঅন্য পরিচয়ে ছলনা দিয়ে অর্জুনকে জয় করবার মধ্যে মানবিকতার বল এবং মানবিক দুর্বলতা, দুটোই পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। এখানে নারীর মধ্যে মনুষ্যত্বের যে পূর্ণতা আমরা দেখলাম তা রবীন্দ্রনাথের নাটকে অন্য কোনো নারীর মধ্যে এতদিন দেখা যায় নি।

 

কিন্তু এবার আমরা অন্য এক প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারি না আগেই বিস্ময় প্রকাশ করেছি যে ১৯১২ সালে যখন ভোটাধিকারের সংগ্রাম তুঙ্গে উঠেছিল, যখন রাষ্ট্রপরিচালনায় নিজেদের মতামত দেবার দাবিতে ইংলন্ডের মেয়েরা পথে নেমেছিলেন  কারাবরণ করছিলেন, সেই সময় 

ইংলন্ডে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ কেন এই ব্যাপারে চিরদিন নীরব ছিলেন তিনি কী তবে বিশ্বাস করতেন যে হৃদয়বৃত্তিতে যাঁরা শ্রেষ্ঠ সেই নারীরা রাষ্ট্রপরিচালনা ব্যাপারে মতামত দেবার যোগ্য নন কারণ তাঁদের বুদ্ধির জোর এতটা নেই? এবার চিত্রাঙ্গদাকে কিন্তু দেখলাম পুরুষসঙ্গী ছাড়াই একা রাষ্ট্রপরিচালনা কেবল নয়, রাষ্ট্রকে রক্ষা করতেও ভাবতে অবাক লাগে যে ১৯১২- অনেকবছর পরে, ১৯৩৬ সালে যখন তিনি চিত্রাঙ্গদা লিখছেন তখন কী তবে কবির মনে এতটাই পরিবর্তন 

ঘটেছিল?






সমাপ্ত




1 টি মন্তব্য: