‘রবীন্দ্রনাথ মৌলি পাহাড়, জলপ্রপাত আমি’
আমায় নিয়ন্ত্রণ করতে না চেয়েও তিনি তাঁর ইথার হাতে আমাকে ছুঁয়ে আছেন, নাকি ধরে আছেন। আমাকে তিনি দিগ্বলয়ব্যাপী স্বাধীনতার আস্বাদ জুগিয়ে দিয়েছেন বলেই তো তাঁকে আমি এমন আঁকড়ে ধরে
আছি, আর থাকব।
(দু’তিনটি রবীন্দ্রমুহূর্ত / শারদীয় দৈনিক স্টেটসম্যান ১৪১৭)
সেই কবে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছিলেন ‘কাব্যের মুক্তি পরিগ্রহণে’ (কাব্যের মুক্তি : শ্রাবণ, ১৩৩৮)। তাঁর এই ভাবনার মূলে ছিল এলিয়টের প্রণোদনা। ‘ঐতিহ্য ও ব্যক্তি-প্রতিভা’ (১৯১৯) প্রবন্ধে এলিয়ট প্রেরণার চেয়েও বড় করে দেখেছিলেন মেধা ও পরিশ্রমকে। আজকের কবিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ সেই রত্নখনির মতো, যাঁকে বারবার ভেঙে-গড়ে নেওয়া যায়। বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকে আত্মীকরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের আধুনিকতা-উত্তরাধুনিকতার অভিযাত্রা। সাহিত্যতাত্ত্বিক হান্স রবার্ট জাউস তাঁর ‘এস্থেটিক রিশেপসন্’ তথা পরিগ্রহণের নন্দনতত্ত্বে বলতে চান : লেখক, লেখা ও পাঠকের সম্পর্কের পরিণামে জয়ী হয় লেখা ও পাঠকের অবিরাম পড়া এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার ইতিহাস। লেখকের মৃত্যুর মূল্যে পাঠকের জন্ম : এই উত্তর-অবয়ববাদী তত্ত্ববিশ্বে দাঁড়িয়ে পরিগ্রহণ তাই অনিবার্য হয়ে ওঠে। আন্তর্বয়ানযোগ্যতাই (Intertextuality) একালের সেই পঠনমুদ্রা। সদ্যপ্রয়াত কবি-প্রাবন্ধিক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের (১৯৩৩-২০২০) রবীন্দ্রায়ণের গরজে তেমনই একটি নিজস্ব পাঠ প্রস্তুত করতে চেয়েছি এখানে।
‘আমরা তো রবীন্দ্রনাথের নিরুত্তরসূরি’
যাঁর শৈশব কেটেছে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে। অবনীন্দ্রনাথ,নন্দলাল বসু,ক্ষিতিমোহন সেন,পুলিনবিহারী সেন,কৃষ্ণ কৃপালনী, মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু প্রমুখের স্নেহময় সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত রাবীন্দ্রিক বলয়ে বেড়ে উঠেছেন ধীরে ধীরে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আচ্ছন্ন করেছেন, আলোড়িত করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন রবীন্দ্রেতর হয়ে ওঠার। পরিণত যৌবনে পঞ্চাশের এই মনস্বী কবির মননে রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছেন এইভাবে :
আত্মহত্যা করতে গিয়েও বারবার ফিরে আসা
নিজের বাড়িতে, নিজের বাড়ির ছাতে
চামেলি-মেঘেরা চৌকাঠ গড়ে মৃদুল সবল হাতে,
পুরুষ কবিকে সংহত দেখে ভয় পেয়ে যায় যম,
দেয়ালে নিজের বিশেষ রক্ত : আ মরি বাংলা ভাষা।
রবীন্দ্রনাথ মৌলি পাহাড়, জলপ্রপাত আমি;
দুঃখ তো আর বলি না ইনিয়ে-বিনিয়ে,
কবিতায় বাঁচে প্রজ্ঞাশাসিত অসুস্থ পাগলামি,
রোদ্দুরে যাই রোদ্দুরে যাই মিলিয়ে। (দৃশ্য-কাব্য / যৌবনবাউল : ১৯৫৯)
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই পুনর্নব হয়ে ওঠার প্রেরণা। সাতাত্তর বছরের এই যৌবনবাউল মৃত্যুর নিপুণ শিল্প দেখে ভয় পান না। এই পরমাণুশাসিত ডিজিটাল বিশ্বে তাঁর কবিতায় নতুন সুর জেগে ওঠে। রবীন্দ্রেতর হয়েও রবীন্দ্রনাথেই ধ্রুবপদ বাঁধা রাখেন তিনি। দুঃসময়ের দ্যুতি রবীন্দ্রনাথ-কে অভ্যাসে পরিণত হতে দেখে স্বস্তি পান না। কোনোরকম নান্দনিক কুসংস্কারে রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালন নয় কিংবা দলীয় স্বার্থে রবীন্দ্রপ্রতিমার অপব্যবহারও নয় তিনি চান আমাদের ‘রবীন্দ্রায়ণের আন্তরসরণি’-র হদিশ দিতে।
তাঁর পূর্বসূরী বিষ্ণু দে যে রবীন্দ্রব্যবসাকে ধিক্কার জানিয়েছিলেন, উত্তরজাতক হয়ে তিনি সে কথাই নতুন করে
স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের। প্রত্যক্ষভাবে রবীন্দ্রনিবেদিত কবিতা লিখে মুগ্ধতা প্রদর্শন তিনি করেন না, বরং রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার দর্পণে অহরহ ছায়া ফেলে যান। প্রাবন্ধিক অলোকরঞ্জনের চোখেও রবীন্দ্রনাথের নিত্য নতুন মূর্তি উদ্ভাসিত হয় বারবার। তিনি জার্মান ভাষায় তর্জমাও করেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই পূর্বসূরী যিনি তাকে ধুলোমাখা ঈথারের জামা দিয়ে মিলিয়ে গেছেন মেঘে। যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উৎসর্গপত্রে বারবার পুনর্জীবিত হয়ে ওঠেন। বিশেষত তাঁর গদ্যসমগ্রের প্রথম খণ্ডের উৎসর্গপত্রে কোনো নাম নেই, লেখা আছে : ‘আমারে দিই তোমার হাতে নূতন করে নূতন প্রাতে’। যে-রবীন্দ্রনাথ বারংবার নিজেকে ভেঙে গড়েছেন, কিন্তু শাশ্বত আবেদনে উজ্জ্বল; অলোকরঞ্জনও সেই পথের পথিক হতে চান। কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত তাঁর রবীন্দ্রপুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থের সমালোচনা করতে গিয়ে লেখেন :
শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রপরিবেশে লালিত ও রবীন্দ্র উপনিষদ-সংপৃক্ত মানসিকতায় প্রভাবিত অলোকরঞ্জন কিন্তু কোনও অর্থেই রবীন্দ্রানুসারী কবি নন। অত্যন্ত সচেতনভাবে তিনি শুরু থেকেই আলাদা হবার চেষ্টা করেছেন। পেরেওছেন। রবীন্দ্রনাথকে একইসঙ্গে দিয়ে গিয়েছেন অঞ্জলি নিজের স্বাতন্ত্র্য বিন্দুমাত্র জলাঞ্জলি না দিয়েই। তিনি লেখেন :
ব্যথায় শুকনো খোয়াইয়ের বুক চিরে
আলোর সোহাগে রাঙা নদী জাগে।
আমি তাকে ডেকে বলি : ‘কার পায়ে তুমি ছড়াবে জলাঞ্জলি’?
কিছুই বলে না, রাঙানদী যায় সূর্যের মন্দিরে,
অবাক তাকায় মেঘের পাহাড়তলি! (গোধূলির শান্তিনিকেতন / যৌবনবাউল)
[ঈথারের জামায় লেগে আছে এই জগতের ধুলোবালি / সংবাদ প্রতিদিন ২৩মে ২০০৪]
তাঁর তিনটি কবিতায় প্রত্যক্ষ ভাবে আর একাধিক কবিতায় নানাভাবে রবীন্দ্র-ভাবনাচূর্ণ মিলেমিশে আছে। ‘দৃশ্য-কাব্য’-এর কথা সকলের জানা। ‘যৌবনবাউল’ (১৯৫৯) এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত’ সঙ্কলনে এই কবিতাটি আমরা পেয়েছি। এর বাইরেও তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় দুটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে এসেছেন : ‘মাস্তুলতোলা বোট নিয়ে গোরাই সেতুর নিচে রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘কসাইয়ের হাতে’।
ছিন্নপত্রাবলীর ৬৭ সংখ্যাক চিঠিতে আমরা পড়ি, রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ভ্রমণকালে গড়ুই নদীর ব্রিজের নিচে নৌকার মাস্তুল ভেঙে বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন,
‘কিন্তু কারও কোনো আশা ছিল না। মাস্তুল যত কাত হচ্ছিল বোটও তত কাত হয়ে পড়ছিল – যদি সময়মত নৌকা না আসত আর বেশিক্ষণ টিঁকত না। সকলে ডাঙায় ভিড় করে এসে বললে, আল্লা বাঁচিয়ে দিয়েছেন, নইলে বাঁচবার কোনো কথা ছিল না। সমস্ত জড় পদার্থের কাণ্ড কিনা! আমরা হাজার কাতর হই,চেঁচাই, লোহাতে যখন কাঠ ঠেকল এবং নিচের থেকে জল যখন ঠেলতে লাগল তখন যা হবার তা হবেই – জলও এক মুহূর্ত থামল না, মাস্তুলও এক চুল মাথা নিচু করলে না, লোহার ব্রিজও যেমন তেমনি দাঁড়িয়ে রইল’।
অলোকরঞ্জনের কবিতায় সেই ঘটনার পুনর্নির্মাণ ঘটে কিন্তু দ্বিতীয় স্তবকে পৌঁছেই প্রেমের অভিনব দ্যোতনায় আমাদের নিয়ে যায় সেই কবিতা :
মাস্তুল সেতুর গায়ে ঠেকে গেল, এদিকে প্রবল
বৃষ্টি স্রোত ক্রমাগত নৌকো ঠেলছে দ্রুতবেগে,
মাস্তুল মড়্মড়্ করে ভাঙবার উপক্রম, জল...
লোহার সেতুটা যদি এ-সময় লোহার অটল
ধর্ম ত্যাগ করে, যদি এক ফুট উপরে ওঠে, মাত্র এক ফুট,
অথবা মাস্তুল যদি কাঠের অটুট
ধর্ম ছেড়ে এক ফুট মাথা নিচু করে কিংবা নদী যদি নদীত্বের থেকে
সামান্য স্খলিত হয়ে নৌকোখানা ছেড়ে দেয়, খুব ভালো হয়।
তা হবার জো নেই, লোহা সে তো লোহা,
কাঠ সে-ও কাঠ, জল সে-ও জল, সবাই মন্ময়
নিজ গুণে, বিশেষত্বে, ব্যক্তিবিশেষের কাছে বেঁকে
লোহা কাঠ জল কিংবা তুমি আর আমি দু-জনার কাছে দোঁহা
নোয়াব না খোয়াব না। আর তাই লোহা কাঠ জল
জানা চাই, ইন্দ্রিয়বিদারী আখণ্ডল
পৃথিবীকে জানা চাই, তাই শিল্প। যে-আমি নিজের
গহ্বরে লুকাই মুখ, যে-তুমি চিবুক রাখ পুবদিকে, বুলবুলিদের
আঘাত কর না, শুধু কাছে এলে স্পর্শ কর, ফুল আর ফল
পাতার বিন্যাস আর পাতার বিনাশে অবিরল
নিজের বিনুনি নিয়ে অণোরণীয়ান ব্যস্ততায়
আমাকে জাগাও, তাই প্রেম; কিন্তু কাল সয়ে যায়
দু-দিকে বয়স চলে অসম্পন্ন খেজুরের সার,
দু-দিকে বয়স চলে : আমাদের পথ মাঝখানে,
অন্যান্য অধরে কিংবা বিশিষ্ট বাহুর হীনযানে
রুক্ষ আমাদের পথ, যা প্রেম তাই তো শিল্প, আর
জীবন সেখানে। শীর্ণ এ জীবনে মাত্র কয়বার
স্পর্শ কোরো কাছে এলে কুমারী সিঁথির অভিমানে। (‘রক্তাক্ত ঝরোখা’ কাব্য : ১৯৬৯)
এক অসম্পূর্ণ প্রেমের কথা বলেন কবি আমাদের। যেভাবে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন : ‘তবু ঘুচিল না অসম্পূর্ন চেনার বেদনা’। আত্মাভিমান স্থির রেখে যে সংহত প্রেমের কথা ভাবেন তিনি তা সমান্তরাল রেখার মতো ‘দু-দিকে বয়স চলে অসম্পন্ন খেজুরের সার’। প্রেম ও শিল্প একাকার করে দেখার এই মন্ত্র পেয়েছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথের নৌকার হঠাৎ থমকে যাওয়া এবং জল-কাঠ-লোহার অনমনীয়তার সঙ্গে মানবজীবনের সামীপ্য খুঁজে নেন : ‘আমাদের পথ মাঝখানে,/ অন্যান্য অধরে কিংবা বিশিষ্ট বাহুর হীনযানে/ রুক্ষ আমাদের পথ, যা প্রেম তাই তো শিল্প, আর/ জীবন সেখানে।’ ‘কুমারী সিঁথির অভিমান’ আর ‘শীর্ণ জীবন’ – শব্দবন্ধে ধরা থাকে এক প্রেমিকের গোপন বিষণ্ণতাবোধের প্রতিমা। আঘাত কিংবা অধিকারের তীব্রতা নয়, স্পর্শের মৃদু উত্তাপে মাঝে মাঝে জেগে ওঠাটুকুই শিল্পিত ও সুন্দর : তাই প্রেম। ঠিক এমনই অনুভবে পঞ্চাশের আরেক কবি শঙ্খ ঘোষ লেখেন :
আর কিছু নয় শুধু এইটুকু সীমা ছুঁয়ে থাকা
ওপরে মেঘের আঙরাখা
শূন্যকে করেছে বরণীয় –
কখনো কখনো যদি মনে পড়ে কাছে ডেকে নিও। (ডাক / সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি : ২০০৮)
পরিণত বয়সে আমরা পড়ি তাঁর ‘আমাদের কবি’(২০১৬) কবিতাটি। সেখানেও ঘন বর্ষায় গোরাই নদীতে বোটবিহারী রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের ছড়া ও পল্লীগীতি সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। অলোকরঞ্জন সন্তর্পণে বলেন ‘ওদের ছাড়া আর কারুর পক্ষেই কবিকক্ষে এখন ঢোকা বারণ’। আবার ‘অস্তসূর্য এঁকে দিল টেম্পেরা’(১৯৯৭) কাব্যের ‘কসাইয়ের হাতে’ কবিতায় প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন আর ব্যঙ্গের স্বর :
কসাইয়ের হাতে দেখেছি গীতবিতান
রেক্সিনে বাঁধা, চামেলিফুলের ফ্রেমে,
লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল কান,
তবুও তা বলে হিমনীল অপ্রেমে
নোঙর করিনি। এবং দেখেছিলাম
এক শয়তান হাওয়া-বদলের ছলে
রিখিয়ায় গিয়ে স্বয়ং বিষ্ণু দে-কে
কাব্যাদর্শ বিষয়ক কথা বলে।
একটি মেয়েকে আকাশের নিচে রেখে
‘এ সভ্যতার এখন মধ্যযাম,
সাবধানে থেকো’ বলতেই কেঁদে-ঘেমে
লোকজন ডেকে করল তুলকালাম।
এসব দেখেছি। অথচ কসাই যেই
গীতবিতানের আড়াই হাজার গান
শোনাতে থাকল চব্ব্যচোষ্যলেহী –
ভুল বাজালেন আলি আকবর খান।
এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের ছবি। হিংসা ও শান্তি পাশাপাশি। জীবনানন্দীয় অদ্ভুত আঁধারের কথা আমাদের মনে আসে : যারা অন্ধ আজ সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে তারা। তবে কি কসাইয়ের হৃদয় বদলে যায় রবীন্দ্রগানের জাদুস্পর্শে? তেমন কোনো আশাবাদী ইঙ্গিত দেন না কবি। বরং এই পালট-পুরাণের মধ্যে ছদ্মবেশ মিশে থাকে। ফুল আর রেক্সিনে বাঁধা গীতিবিতান কসাইয়ের হাতে শোভা পেতে দেখে কবির নান্দনিক বোধ আহত হন। যেন সুরের রাজ্যে অসুরের প্রবেশ। গীতবিতানের গান তার কাছে ব্যবসার অবলম্বন। এই রবীন্দ্রব্যবসাকে ‘চব্যচোষ্যলেহী’ শব্দে চমৎকার ভাবে চিহ্নিত করেছেন। তাই বিখ্যাত সেতারিয়া আলি আকবরের তালভঙ্গ সেই অসুন্দেরর অযাতিত অনুপ্রবেশের অশুভ দ্যোতনামুখর। এছাড়াও রয়েছে একাধিক কবিতায় রবীন্দ্রপঙ্ক্তির নবনির্মাণ। যেমন, তাঁর রবীন্দ্র-পুরস্কার প্রাপ্ত ‘ধুলোমাখা ঈথারের জামা’য় দেখি রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়’ গানের প্রতিভাস। ঐ গানে রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শকে এই ডিজিট্যাল দুনিয়ায় খুঁজে না পেয়ে আহত কবি লেখেন :
প্রাঙ্গণে আজ প্রেক্ষিতের বদল দেখি : শিরীষ গাছটা হঠাৎ
ফোয়ারা হয়ে ওঠার মুখে থমকে দাঁড়ায়। এবং ফোয়ারাটা
শিরীষ হয়ে প্রাজ্ঞ ছায়া বিলোতে গিয়ে কাহিল হল কিছু। (প্রাঙ্গণে যাব না, ধুলোমাখা ঈথারের জামা : ১৯৯৯)
এই গানে এক অনন্ত প্রতীক্ষার ছবি এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আজকে এই সাইবারশাসিত বিনোদনের দুনিয়ায় ‘নিজের নিজের ভূমিকা নিয়ে দিনাতিপাত / কারুর এখন পছন্দ নয়’। কবি তাই শিরীষের কাছে আশ্রয় পান না। গাছকে সরিয়ে তার বদলে ফোয়ারা বসিয়ে নাগরিক কৃত্রিম সৌন্দর্য নির্মাণ করা যায়। অথচ সেই সহজাত সুন্দর ছায়াবী আবেশ কখনও রচিত হতে পারে না। প্রাঙ্গণ তার নিজস্ব সৌন্দর্য হারায়, কবিও বলেন : প্রাঙ্গণে যাব না। আবার সাম্প্রতিক কালে যুদ্ধবিরোধী এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেও বিদ্রুপের সুর লাগিয়েছেন কবি :
প্রথমে ভেবেছি শুভ্র হাঁসের পাঁতি
রাতের অন্ধকারে,
পরে বুঝলাম ন্যাটোর জল্লাদেরা
অবিরল করে বোমাবর্ষণ হংসবিমান থেকে :
লক্ষ লক্ষ রক্তবীজের বলাকা বলাকা বলাকা ... (লিবিয়ায় , সে কি খুঁজে পেলো ঈশ্বরকণা? : ২০১২)
‘বলাকা’-কে যে-কারণে ‘গতিরাগের কাব্য’ বলা হয়, বের্গসঁ কথিত প্রাণ প্রৈতি (èlan vital) এই কাব্যের নাম কবিতায় বিশেষভাবে পাই, সেই গতির নেতিবাচক রূপ ‘লিবিয়ায়’ কবিতায় চিত্রিত। বিজ্ঞানের মারণ আবিষ্কার এবং মানুষের ক্ষমতার লোভ বলাকার মহতী প্রাণ প্রৈতি-কে ‘লক্ষ লক্ষ রক্তবীজের বলাকা’য় রূপান্তরিত করে। যুদ্ধ ও হত্যা নামক এইসব মারণ খেলার শেষ নেই যেন। তাঁর রবীন্দ্রায়ণের আরও কয়েকটি উদাহরণ অন্ত্যপর্বের কবিতাবলী থেকে ইতস্তত চয়ন করা যেতে পারে :
১) ওরা যখন
অন্ধকার রাত্রিকে
বরণ করে নিল, তুমি তাদের
বললে : ‘এই জোৎস্নায়
সবাই গেছে বনে, তোমরা কেন
মরণ বেছে নিলে হায়!’ (কবিপক্ষ, প্রণীত অগ্নি কাকে বলে তুমি জানো? : ২০১১)
২) না বলে কয়ে ঈশ্বর একদিন
আমার ভিটায় হঠাৎ হাজির হলে
আমি দেখলাম সন্ধ্যামালতীলতা
দুলে দুলে ওঠে পিয়াল গাছের কোলে
যেরকম ঘটে রবীন্দ্রসংগীতে। (সহসা ঈশ্বর, এখন নভোনীল আমার তহবিল : ২০১৪)
৩) দুয়ার এবং দেহলির সেই সন্ধিক্ষণটিতে
বহুদিনকার বন্ধুকে যেই জড়িয়ে ধরেছিলাম
উদাসী হাওয়ার মুকুল ঝরল রবীন্দ্রসংগীতে (শামসুর রাহমান, চিবুক ছুঁয়ে আশীর্বাদের মতো : ২০১৫)
৪) বরং বিবিদি আচারের শিশি হাতে
মহা-আনন্দে শেখাতেন অবিরল
‘বাদল বাউল বাজায় রে একতারা’ (বিবিদি ও বীরবল, দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি : ২০১৬)
৫) সে বুঝি কোন অপরিচয়,
নামান্তরে মৃত্যুভয় –
ক্ষিপ্ত এক জনতা কেন মাঘোৎসবের শীতে
গ্রন্থাগার পুড়িয়ে মাতে রবীন্দ্রসংগীতে (আগুন নিয়ে খেলা, ঐ)
৬) আর কিছু নয়, শুধু উদাসীন চৈত্রের হাওয়ায়
প্লাস্টিকের ঝুলি এক মায়াবী প্রপঞ্চে ঘুরে যায়
না, কোনো গাছ তো বেঁচে নেই যে ঝরা পাতাগুলি
উদাসী হাওয়ায় নাচবে, তাই এই প্লাস্টিকের ঝুলি (ডিনারের আরও একটু বাকি, তোমরা কি চাও শিউলি না টিউলিপ? : ২০১৭)
৭) শুনতে চেয়েছে আমার কণ্ঠে
‘বরিষ ধরার মাঝে শান্তির
বারি’ – কোনো সুর আসে না তো হায়
আমার গলায়। (বর্ষামঙ্গল, শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি : ২০১৮)
৮) ভেবে দেখো ক্রান্তদর্শী তাঁর
হাত থেকে ‘সভ্যতার সংকট’ পেয়েছে উপহার
আপামর মানবতা একটু আগেই; তোমরা যদি
ক্লোজ-আপে আলোকচিত্রে তাঁকে দেখো, ঠিক দেখতে পাবে
তিনিও নশ্বর, তবু তাঁকে ধরে রাখার গরজে
আশ্রমের নরনারী, আর ওই কেরালা থেকে আসা
একটি নার্স একযোগে কীরকম দুরুদুরু কাঁপে,
আর তাই ভূমণ্ডলে এখনও রয়েছে বাংলা ভাষা! (শালবীথিকায় পরীক্ষার্থী একা ২, ঐ)
৯) আমরা তো রবীন্দ্রনাথের
নিরুত্তরসূরি। তিনি যা বলেন তাকে ধরে রাখা
আমাদের সাধ্যে নেই, আজ যেই গীতাঞ্জলি পড়ি
এক-একবার তাঁর সঙ্গে নীরবে নিভৃতে তর্ক করি
এই তীব্র কালান্তরে – গালফ্ যুদ্ধের পরিশেষে –
এতটা ঈশ্বর বুঝি প্রাসঙ্গিক? (রাজেশ্বরী : একটি শোকগাথা, ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে : ২০১৯)
১০) সেই যে নাসা হেড কোয়াটার্স থেকে
ব্র্যাড পিট-এর রোমাঞ্চসঞ্চারী
চলচ্চিত্র নক্ষত্রজয়ের
বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছিল
ঠিক তখুনি ঘটতে চলেছিল
শহরতলির পাহাড়ি অঞ্চলে
আমাদের এক গহন পর্যটন
রবীন্দ্রনাথ অনুবাদের ছলে! (কাছে দূরে, বাস্তুহারার পাহাড়তলি : ২০২০)
অলোকরঞ্জনের পরিগ্রহণে এইসব কবিতা যুগের নতুন ভাষ্য রচনা করেছে। আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘নিরুত্তরসূরি’ ভাবা এক অভিনব অবলোকন। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজস্ব পাঠের দর্পণে এইভাবে বারংবার পুনর্নির্মাণ করে গিয়েছেন সাতাশি বছরের যৌবনবাঊল।
‘দূঃসময়ের দ্যুতি’
রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল সমালোচনা আর প্রমথ চৌধুরীর বিদগ্ধ প্রবন্ধাবলীর পাশে তিনের দশকের বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য-সমালোচনা যুক্তিবোধ আর স্পষ্টতায় উজ্জ্বল। সেই ধারার উত্তরজাতক পঞ্চাশের কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রবন্ধাবলী হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতিময়, যদিও দীক্ষিত পাঠকের মুখাপেক্ষী। তাঁর প্রবন্ধে মিশে আছে কবির অনুভব এবং বিশ্বসাহিত্যপাঠের মূল্যবান অভিজ্ঞতা। সাম্প্রতিক ‘রবীন্দ্র-আলোকবর্ষে’(২০১২/২০১৯) সংকলনটিতে দুটি পর্যায়। ‘তোমারই গান গেয়ে’ পর্যায়ে রয়েছে পূর্বপ্রকাশিত ও বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রবিষয়ক এগারোটি প্রবন্ধের সন্নিবেশ। আর দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’। ন’টি সাম্প্রতিক প্রবন্ধে অলোকরঞ্জন ইউরোপে রবীন্দ্র-জন্মের সার্ধশতবর্ষের উদ্যাপন এবং তাঁর অনুভব ও সক্রিয় ভূমিকার পরিচয় দিতে চেয়েছেন। প্রথম পর্বের লেখাগুলির সঙ্গে অলোকরঞ্জনের অনুরাগী পাঠকদের পরিচয় ছিলই। তবে দুই মলাটে রবীন্দ্র-বিষয়ক সেই বীজগর্ভ লেখাগুলি আবার পড়তে গিয়ে বিস্ময় ও সম্ভ্রম জাগে। কবিতায় গানে, নাটকে, উপন্যাসে আর সুন্দরের অভ্যর্থনায় এই কবি-অধ্যাপকের পাণ্ডিত্য, তুলনামূলক আলোচনার প্রতিভা আর অন্তর্দৃষ্টি বঙ্গদেশের রবীন্দ্র-সমালোচনার চিরকালীন সম্পদ। নিরুদ্দেশ যাত্রার অনুষঙ্গে সিন্ধুপারে, ‘শেষলেখা’র ব্যখ্যায় ইয়ুঙ-এর মনোদর্শন কিংবা অনুবাদ, চিত্রকল্প, রবীন্দ্রচিত্রকলা, আধুনিক কবিদের রবীন্দ্র-পরিগ্রহণ এবং জার্মান সাহিত্যের অনায়াস প্রতিতুলনা রয়েছে এই পর্বে। একটু ব্যতিক্রমী লেখার মধ্যে রয়েছে : ‘শব্দের মুক্তি, কবিতার উত্তরাধিকার ও রবীন্দ্রসঙ্গীত’ এবং ‘অস্তরবির রশ্মি-আভায়’ প্রবন্ধদুটি। অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্বের কয়েকটি লেখায় স্মৃতিচারণ আর কয়েকটিতে বিভিন্ন আলোচনাচক্রে প্রদত্ত বক্তব্যের ভাবনির্যাস রয়েছে। ‘আলোকবর্ষের দায়’ এবং ‘বাঁশির ধারেই একটু আলো’ রচনাদুটি এই দ্বিতীয় অংশের ভাবনির্যাস বলা চলে। ‘গীতাঞ্জলি’-র কবিরূপে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের চোখে যেন ধর্মগুরু, এই ভ্রান্ত ধারণা-কে বারংবার ভাঙতে চেয়েছেন অলোকরঞ্জন। গীতাঞ্জলি ও বলাকা-উত্তর কবিতা আলোচনা করে তিনি লেখেন,
‘একটি অধিবেশনে যেই আবৃত্তি করে বসি : ‘কালো অশ্ব অন্তরে যে সারারাত্রি ফেলিছে নিঃশ্বাস / সে আমার অন্ধ অভিলাষ (কালো ঘোড়া), একটি অভিনব রবীন্দ্রমুহূর্ত উদ্ঘাটিত হয়ে ওঠে। কবিতাটির জার্মান ভাষান্তর দ্রুত সম্পন্ন হয়। এই কবিতা রচনার পিছনে যে সিগমুণ্ড ফ্রয়েড এবং ফ্রানৎস্ কাফকার প্রভাব সক্রিয় হয়ে আছে, মনোবিজ্ঞান এবং কথাসাহিত্যের শিবিরের সুদীক্ষিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তা নিয়ে দিনের পর দিন অনুপুঙ্খ বিনিময়ও ঘটে’।
(আলোকবর্ষের দায়)
এই সময়েরই প্রতিস্পর্ধী, দুর্দমনীয় এক আধুনিক কবিরূপে তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখতে চান। অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ‘ম্যান’(১৯৩৪) বক্তৃতামালার নিরিখে নবজাতকের ‘রাতের গাড়ি’ কবিতা নতুন করে পড়েন তিনি। ডারুইনের উদাহরণ দিয়ে তৈরি হওয়া এই কবিতার জগতে পেয়ে যান আলো-অন্ধকারের সমার্থদ্যোতনা। কখনো বা উদ্ভট রসের রবীন্দ্র-ছড়ায় খুঁজে পান আবহতত্ত্ববিদ এডোয়ার্ড লরেন্স কথিত ‘দুর্মর প্রজাপতিপনা’ (Butterfly-effect)। বাঁশির ধারে রণিত হয় একটুখানি আলো, যা আসলে কবির স্বনির্মাণ। পল ভালেরির ‘সত্তার সংকট’-ই যে রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’-এর অন্যতম প্রেরণা, তা জেনে আমরা চমকিত হই। এছাড়া ডিকিনসন, ব্রেশট্, শান্তিনিকেতনের স্মৃতি, গ্রিক নাট্যচিন্তা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে জার্মানি-প্রবাসী অলোকরঞ্জন রবীন্দ্রনাথকে এই অদ্ভুত আঁধারেও আলোকদূত করে তোলেন। ইকোলজিসচেতন এই সময়ে রবীন্দ্রনাথকেই একুশ শতকের অনন্য স্মরণ ও ভবিষ্যভরসা ভাবতে ভালো লাগে তাঁর। অন্যত্র ‘সবুজ সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা’ প্রবন্ধে তিনি আগেই জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথই আমাদের দেশের ইকলজি-চর্চার অগ্রণী প্রতিনিধি, যাঁর গানের উদ্ধৃতি টেনে অলোকরঞ্জন দেখাতে চান,
‘রবীন্দ্রনাথের আবেদন ‘এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে ইহার মাধুরী বাড়াও হে’ অনিবার্যতই এই অনুষঙ্গ আমাদের একাধারে আচ্ছন্ন এবং উদ্দীপিত করে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথই বোধহয় সাহিত্যের ইকলজি এবং ইকলজির সাহিত্যের সর্বাগ্রণী প্রতিনিধি। কিন্তু আমাদের প্রসঙ্গ প্রেক্ষিতে যে কথাটা জোর দিয়ে বলা অবৈধ নয়, সেটা হল, রবীন্দ্রনাথই বোধহয়, ভারতীয় ও ইউরোপীয় সবুজ জাগৃতির প্রেক্ষাপটে ও একমাত্র মানুষ যিনি প্রকৃতির সঙ্গে শান্তিস্থাপনের ব্যাপারটা বুঝেছিলেন এবং আমাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন’। (শেষ কথা কে বলবে? : ২০০৭)
তাঁর রবীন্দ্র-সমালোচনার প্রতিটি পাঠই আমাদের নতুন করে রবীন্দ্রনাথ-কে পড়তে শেখায়। আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন ছাড়িয়ে এই আধুনিকতম বিশ্বকবির অপরিহার্যতা আমরা টের পাই। একাধিক ছড়ানো নিবন্ধেও অলোকরঞ্জন-এর রবীন্দ্রায়ণ অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র (লিখন তোমার, দুঃসময়ের দ্যুতি, সবার রঙে রঙ মেশাতে ইত্যাদি)। তেমনই একটি নিবন্ধে অলোকরঞ্জন লিখেছেন :
আমার মনে হয় আমাদের কাছে রবীন্দ্রগান অনায়াস ও স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে বলেই হয়তো তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ বোঝাপড়া হতে পারে না আমাদের। তারই অভাবে অর্থাৎ সেই সঙ্গীতের সঙ্গে আমাদের গহন সত্তার প্রত্যাশিত টানাপোড়েনের দরুণ, আমরা রবীন্দ্রগানকে তো অবশ্যই হারাই এবং আমাদের আত্মপরিচয়ও খুইয়ে বসি। ফলত তাঁর গান আমাদের দিনগত পাপক্ষয়ের গ্লানিগ্রস্ত প্রহরে প্রহরে শুশ্রূষা বা থেরাপির কাজ করে বটে, কিন্তু নব নব উন্মোচনের দিগ্বলয় তো মেলে ধরে না। এর চেয়ে আক্ষেপের বিষয় আর কী-ই বা হতে পারে! যাঁরা আজ মঞ্চে মালঞ্চে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন, তাঁদের ভিতরেও সাধারণত এক অনপনেয় অবসাদ এসে গিয়েছে। এঁরা শুদ্ধিপ্রবণ কিন্তু নিদারুণ সুকৃত্রিম।
[সবার রঙে রঙ মেশাতে / লিটল ম্যাগাজিন সংবাদ / ৯ মে ২০১০]
বিশ্বাস আর আস্থাহীনতার এই বিপন্ন সময়ে অলোকরঞ্জন স্পষ্টই জানান : ‘কোনো দলই আমাদের রবীন্দ্রায়ণের আন্তর সরণির হদিশ দিতে পারে না। দলও সমাজ-পরিচ্ছন্ন ব্যক্তির মতোই বিবিক্ত একটি অবচ্ছিন্ন ক্ষমতালিপ্সু সংগঠন’। বরং পার্টির ভল্যান্টিয়ার অপেক্ষা নামহীন জনসমাজের প্রতি তিনি আস্থা রাখতে চান, যাঁরা তাঁর চোখে ‘তালপাতার মুকুট পরা ভুবনডাঙার রাখাল’। প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ছাড়িয়ে এই যৌবনবাউল ফিরে যান শৈশবের শান্তিনিকেতনের গহন অনুভবে : ‘সোনাঝুরির এথ্নিক গোধূলিবেলায় আচম্বিতে পেয়ে যাই একটি বাউলকে যে রবীন্দ্রগান ভেঙে ভেঙে দিনান্তের দিগ্বলয়ে সুর কীর্ণ করে দিচ্ছে আর অকালবসন্ত হয়ে উঠছে অলজ্জ ও সংরক্ত। এই তাহলে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন!’ প্রাবন্ধিক ও কবি এভাবেই হাত মিলিয়েছেন, যার কেন্দ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কখনো রবীন্দ্রনাথের লিখনশৈলীর বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবেন। গ্রাফোলজি, ক্যালিগ্রাফি এবং চিত্রধর্মিতার বিচার করতে গিয়ে মন্তব্য করেন :
‘আচম্বিতে আবিষ্কার করি ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ গানটির মাঝখান থেকে লতিয়ে উঠেছে একটি বল্লরী, এবং অতঃপর অধোভুবনে তলিয়ে গিয়ে হয়ে উঠেছে শিকড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। সন্দেহ নেই, গানটি স্বদেশাত্মক। কিন্তু বৈষয়িকতার ঘোর কেটে গেলে কি মনে হয় না, প্রকৃতি অথবা আদিনিসর্গই সেই শক্তি, যা আমাদের প্রিয়তম কবির সৃষ্টিতে পরাপ্রকৃতিতে পরিণত হয়েছে।
দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাই ‘ঐ মহামানব আসে’ মহাসংগীতে। যতই দেবদত্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী হোন, আশি বছরে উপনীত কবিও একযোগে আসন্ন মৃত্যুর দেবদূত ও শিকার। সভ্যতার সংকটে তিনি যখন আমাদের মনে নব নব অরুণোদয়ের প্রতিশ্রুতি জোগাচ্ছেন, সেই মুহূর্তে তাঁর হাতের লেখা কেমন অসহায়,ভঙ্গুর। আমরা সেই ভাঙনের জয়গান গাই। [লিখন তোমার, যে আছে অন্তরালে : ২০১০]
‘শিল্পিত স্বভাব’ ও ‘স্থির বিষয়ের দিকে’ গ্রন্থে রবীন্দ্র-উপন্যাসের চরিত্র, রবীন্দ্র কবিতা ইত্য্যাদি নিয়ে তাঁর লেখাগুলিতেও বেশ কিছু নতুন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তবে রবীন্দ্রবিষয়ক তিনদিনব্যাপী বক্তৃতামালা অলোকরঞ্জনের অন্তহীন রবীন্দ্রায়ণের উজ্জ্বল সঞ্চয় । সেই ‘সুন্দরের অভ্যর্থনা’ (১৯৯৭) গ্রন্থে কবি ধরে দিতে চেয়েছেন : ‘রবীন্দ্রসমগ্রে সুন্দরের ত্রিমুখী প্রবর্তনা’। আরোগ্য কাব্যের ১১ সংখ্যক কবিতা থেকে তিনি চয়ন করেছেন তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম। মৃত্যুর মাস পাঁচেক লেখা এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ঐকান্তিক তিনটি মননমুদ্রা খুঁজে দেখাতে চেয়েছেন অলোকরঞ্জন : সৎ ও সুন্দরের প্রথায়ত সমীকরণ, আধুনিক ইস্থেটিক্সের অন্তরাত্মা তথা মগ্নচৈতন্যের খোঁজ এবং রিসেপশন্ ইস্থেটিক বা পরিগ্রহণের নন্দনতত্ত্ব। রক্তকরবীর মধ্যে যৌনতার পাশাপাশি উত্তর-আধুনিকতার সূত্র তিনি দেখেন। হাইডেগার, হ্বাল্টার বেঞ্জামিন, গাদামার, অ্যাডর্নো প্রমুখ প্রতীচ্যের তাত্ত্বিক এবং অগ্রজ বাঙালি কবি প্রেমেন্দ্র
মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু এঁদের সূত্র টেনে অলোকরঞ্জন আধুনিক মানসে রবীন্দ্র-অভ্যর্থনার নিজস্ব ভাষ্য নির্মাণ করে নেন। বইটি শেষ হয় বিনয় মজুমদারের লেখা ‘রবীন্দ্রবিনয়সংগীত’ দিয়ে : ‘ যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে’। রবীন্দ্রবিগ্রহের বন্দনা না করে রবীন্দ্রবিশ্বের বাসিন্দা হয়ে অলোকরঞ্জন রবীন্দ্রনাথের মোহমুক্ত পাঠের প্রাসঙ্গিকতার কথা বলেন :
‘তিনি নিজেই নিজেকে যেভাবে পার হয়ে গিয়েছেন আত্মঅতিক্রমণের সেই ঐতিহাসিকতা আমাদের চৈতন্যে
বজায় রাখলে তাঁর আধুনিকতা আমাদের কাছে আরো প্রতিপন্ন হতে পারবে। ’ (সুন্দরের অভ্যর্থনা, ১৯৯৭)
পরিগ্রহণের পরিণাম
জার্মানি এবং ভারতবর্ষে সময় ভাগ করে থাকেন কবি অলোকরঞ্জন, যাঁর আজীবন লক্ষ্য ‘গ্যোয়েটে এবং রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়ে বিশ্বোপলব্ধির, বিশ্বসাহিত্যের জায়গাটা সরাসরি শনাক্ত করে নেওয়া’। ‘সং অফারিংস’ অনুসরণে অনুবাদের অনুবাদ নয়, বরং সরাসরি বাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রান্তলগ্নের কবিতাকে তিনি জার্মান তর্জমায় ধরে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে জার্মানি-অষ্ট্রিয়া-সুইৎজারল্যাণ্ড মিলে অন্তত একশোটি অনুষ্ঠানে প্রাচীন ভারতীয় আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়েছেন তিনি। ভারতনাট্যম-শিল্পীর নৃত্যকল্প এবং শেষ পর্যায়ের রবীন্দ্রকাব্য-পাঠের কোলাজ রেখেছিলেন সেখানে। জার্মান অনুবাদে সহযোগিতা পেয়েছেন কবি এলিজাবেথ গ্যুন্টারের। এভাবে ইওরোপের কাছে এবং আমাদের কাছেও এই যে নতুন এক রবীন্দ্রনাথকে তিনি হাজির করেন তিনি। সিগ্মুন্ড্ ফ্রয়েডের পৌত্র সেইসব রবীন্দ্র-অনুবাদ পড়ে কবিকে জানিয়েছেন, এ বই দেখলে তাঁর দাদু রবীন্দ্রনাথ-কে নিয়ে বিশেষ আগ্রহী হতেন। একটি সাক্ষাৎকারে কবি নিজেই জানান :
‘জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের আবেদন বেড়েছে। তা বলে তাঁর নামে রাস্তায় মানুষ ছুটছে এমন নয়। তবে রাবীন্দ্রিকতায় সংবেদায়িত এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে এখনকার জার্মানিতে, একথা বলাই যায়’।
(সন্ধিক্ষণের সাক্ষাৎকার, নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে ছায়ানট : ২০১৬)
প্রথমে জার্মান ভাষায় ও পরে ইংরেজিতে লেখেন ‘মাই টেগোর’ গ্রন্থ। যেখানে চিত্রকর, গীতিকার, সুরকার, কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, কথাকার রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক রূপই তাঁর কাছে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। তাঁর এই লিখিত বক্তৃতার শেষে তাই তিনি উচ্চারণ করেন :
A fecund spirit who can move with delicacy and sureness on the height of sensibility, yet plunges readily into the abyss. Neither saint nor Guru, he partakes nevertheless sufficiently of authority to constitute for me, one who writes in the Bengali language, unalterably an artistic and a human challenge. (My Tagore, 2012 : 24)
আর সেই ভাবনারই প্রতিচ্ছবি এসে পড়ে তাঁর সাম্প্রতিক একটি কবিতায় :
অনেকদিনই যাইনি আমি উত্তরায়ণ,
যোগ দিইনি কবিপক্ষের জলসাঘরে,
সবাই যখন নিশুত রাতে ঘুমিয়ে পড়ে
মোবাইলের টর্চ জ্বেলে গুহার ভিতর
লুকিয়ে দেখি শেষ দশকে কবির আঁকা
অন্ধকারের চিত্রাবলি, আমি তখন
পড়ি না কোনো অতীন্দ্রিয় গীতাঞ্জলি।”
এই বলে সে আমার সমর্থনের আশায়
তাকিয়ে থাকে, আমি তখন নিরপেক্ষ
পঁচিশে বৈশাখের জন্য আশাবাদের
অভিভাষণ তৈরি করছি, আর সে আমায়
ডাক দিয়েছে মিলেনিয়ামে বাসাবদলে
যেখানে কোনো উত্তরণের ভরসা নেই
যেখানে ফোটে জিরেনিয়াম সর্বনাশা...
যতই আমি নিরুত্তর, স্মিত সাহসে
বলছিল সে : “এখন আমি শেষ সপ্তক,
সেঁজুতি আর পরমুহূর্তে আকাশপ্রদীপ –
সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি এখন
বাইশে শ্রাবণ, কালান্তরের এই বিকেলে
ব্যস্ত আছি কবির লেখা বৃষ্টিদিনের
তিনটি গানের স্বরলিপির পাঠোদ্ধারে
আমার নিজের মোবাইলের রশ্মি জ্বেলে! (সে, শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি : ২০১৮)
রবীন্দ্রবিগ্রহের বন্দনা না করে রবীন্দ্রবিশ্বের বাসিন্দা হয়ে অলোকরঞ্জন রবীন্দ্রনাথের মোহমুক্ত পাঠের প্রাসঙ্গিকতার কথা বলেন, জানান অন্ধকারের চিত্রাবলীর চিত্রী, ‘রক্তকরবী’র নাট্যকার কিংবা ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি’ ‘কালো ঘোড়া’র কবিকে তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পার করে পুনর্পাঠ জরুরি। এমিলি ডিকিনসন এবং রবীন্দ্রনাথের তুলনা টেনে দেখিয়ে দেন ঐ দুই কবির কলমে দু’রকম রোদ্দুরের ছবি শেষে সমধর্মী হয়ে যায় : ‘সে যখন থাকে ধরিত্রী আমাদের চোখে বেঁচে থাকে, আর তারপর নেমে আসে মৃত্যুর বিভীষিকা’ (দু’রকম রোদ্দুর, রবীন্দ্র আলোকবর্ষে : ২০১২ : ১৬৭)। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের আলো-অন্ধকার ছুঁয়ে তিনি অভ্যর্থনা জানাতে চান। রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক প্রচলিত সিদ্ধরসকে দূরে সরিয়ে দেন। ভাবেন, নিছক পার্বণীকরণের সংস্কারে তাঁকে ‘গণেশ’ হিসেবে ব্যবহার নয় রবীন্দ্রনাথকে পুনরাবিষ্কারের মধ্যেই আমরা এই অশনাক্ত দুর্যোগের দিন পার হতে পারি। আমৃত্যু রবীন্দ্রচর্যাই ছিল তাঁর জীবনচর্যা। তাই অলোকরঞ্জনের রবীন্দ্রনাথ ‘দুঃসময়ের দ্যুতি’ হয়ে আমাদের সবার রঙে রঙ মেশানোর মন্ত্র দেন, বলেন : যেন ভুলে না যাই বেদনা পাই শয়নে স্বপনে। এভাবেই মিডিয়া মদির যুগে রবীন্দ্রনাথকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করে এবং প্রথানুগ পরিগ্রহণের অভ্যাস সরিয়ে রেখে তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চান অলোকরঞ্জন। রবীন্দ্রনাথের চেনাজানা আশাবাদী চেহারার পাশে অন্তিম লগ্নের নিরাশাকরোজ্জ্বল কিংবা ‘বাঁশির ধারেই একটু আলো’য় রঞ্জিত রবীন্দ্রনাথের যে-নতুন রূপ অলোকরঞ্জনের পরিগ্রহণে ও বিশ্লেষণে আমাদের সামনে নান্দনিক মূল্যে ভাস্বর হয়ে ওঠে, তা’ যেন রবীন্দ্রসৃষ্টির চির-আধুনিকতাকেই আরেকবার মূর্ত করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ নামের ‘মৌলি পাহাড়’ থেকে রোদ্দুর এসে পড়েছিলো তাঁর জীবনের জলপ্রপাতে। আজ তিনি নশ্বরদেহে না থাকলেও তাঁর রবীন্দ্রায়ণের আন্তরসরণিতে আমাদেরও সহপথিক করে দিয়ে গেছেন। আর তিনিই তো লিখে গেছেন : ‘তবু আমার / যাওয়া-না-যাওয়া / সমান-সমান : / দুই খণ্ডের / গীতবিতান’।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন