ঈর্ষালু শ্বেত
আগে সবার আড়ালে জামার আস্তিন গুটিয়ে খুব দেখতো গোলাপী হয়ে যাওয়া চামড়া কতটা সাদা হয়েছে। এখন শ্বেত মুখায়ববে কতটা কালো ছিটে সাদা হতে বাকি সেটা দেখার জন্য আগ্রহ খুব। শরীর সাদা বামন হয়ে যাক এই প্রার্থনা রাতদিন। কে যে হারামী আমার নাম রেখেছিল কমল, সামনে পেলে...সে ভাবে, আর শরীর গরম, গোলাপী হয়ে যায়। আসেপাশে যত মানুষ আছে সব্বার চামড়ার খোল সাদা হয়ে যাক ভগবান। প্রার্থনা শুধু প্রার্থনা। মাঝেমাঝেই তার সঙ্গীসাথী, অফিসকলিগ, পার্কে ঘেঁষেবসা বুড়ো বা বাসে মেট্রোতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা খুব বিরক্ত হয়। কেউ কেউ চেঁচিয়ে বলে ওঠে ‘ওইই,ধবল কুঠে,গায়ে গা ঘষছেন কেন’?
অনেক ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে, ‘ডাক্তারবাবু? এই রোগ কি সংক্রামক হয়?’ নিরাশ হয়েছে তাও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বৌ প্রথম প্রথম বেশ সহানুভূতিশীল ছিল,সঙ্গে শুত। এখন যত বেশি সে আলাদা থাকে তত বেশি সে পরশ্রীকাতর হয়েছে। একদিন তো মাঝরাতে সন্দিগ্ধ বৌ পুজোর ঘরে ঢুকতে গিয়েই দেখে, কাগজের মত সাদা কমলের শরীরে চাবুক চালানোর দাগ, রক্ত ফেটে ফেটে পড়ছে। একহাতে চাবুক আর অন্য হাতে একটা কাগজে লেখা নাম। পড়ছে আর চাবুক সপাং সপাং। বৌ সেটা কেড়ে নিয়ে পড়ে দেখল, কমলের প্রিয়বন্ধু, বৌয়ের বাবা ভাই ও ঘনিষ্ট ভালোমানুষদের নাম। ওদের চামড়ায় শ্বেতি ধরুক, তাই এই সাধনা? বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলা অব্দি বৌ ভীষণ আদর পেয়েছে। তারপরই ধীরে ধীরে বাড়তে লাগে খোঁটা। রোজ শোবার সময় আয়নার সামনে বউকে দাঁড় করিয়ে মনস্তাপ, ‘এই কেলে ভূতনীটাকে বিয়ে করে কি যে ভুল করেছি। কোথায় আমি সাহেবের মত, পদ্মের মত গা আর কোথায় গোবরের মত বৌ। ছিঃ। এখন আর কি করা? অন্ধকারে সহবাস ছাড়া আর গতি কি’? এখন পাছে পদ্মফুল দেখতে পায়, তাই মন্দিরে আর যায়না, ফুল কেনাও বন্ধ করে দিয়েছে।
যখন ত্রিশুল ও পদ্মচিহ্নের মত দেখতে একটা ছোটো শ্বেত প্রদাহ শুরু হয়েছিল বাহুমূলে, তখনই এক বন্ধু তাকে বলেছিল, রোজ টিফিনে আচার নিয়ে আসিস,আর খাস না রে। ছড়িয়ে যাবে। তখন ওকে মা বাপ তুলে গাল দিয়েছিল। বলেছিল, কি মনে করেছিস? এটা আমার রোগ? এটা আমার শুভচিহ্ন। এতে তোদের এত নজর কেন? তারপর নজর কাটান দেবার জন্যে পূজাপাঠ যজ্ঞ।
অথচ কমলের শরীরতত্ত্ব জ্ঞান গভীর। কেন যে তার এই উন্মাদনা সেটা লোকের আলোচ্য বিষয়। যত বেশি শ্বেতির তীব্রতা বেড়েছে তত বেশি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছে। সে আগ্রাসী হয়ে নিজেরই লোকেদের অমঙ্গল চায়। এমনকি নিজেরও। বউটাকে এমন জড়িবুটি খাওয়াত যাতে সেও ধবল সঙ্গিনী হয়। মাসদুই আগে হাসপাতালে যখন বউএর ডেলিভারি হচ্ছিল তখন সে একটা অশত্থ গাছের গোড়ায় বসে তন্ত্রসাধনায়। শ্বেতশরীরে সিঁদুর ও চন্দন লেপে হাসপাতালের গেটে প্রসুতি ও কন্যাশিশুকে নিতে এসে দেখেই উন্মাদের মত সে কি কান্না। সাধনা অসফল। শিশুর গায়ের রঙ মায়ের মত। আপাদমস্তক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন