মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২

এই সংখ্যার কবিঃ কবি ঊর্মিলা চক্রবর্তী


 


কবি ঊর্মিলা চক্রবর্তী
জন্ম ১৯৪৬ সালের ১১ই আগস্ট।ঊর্মিলা চক্রবর্তী আশির দশকে যখন কবিতা লেখা শুরু করেন তখন তিনি শিলিগুড়ি কলেজে ইংরাজি বিভাগে 
অধ্যাপনা করেন এবং কবি সিলভিয়া প্ল্যাথের উপর গবেষণা করেন।বলা বাহুল্য তিনি যথেষ্ট পরিণত বয়সেই লেখার জগতে আসেন।কলকাতায় প্রথমে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল এবং তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষা লাভ করবার পর তিনি কিছু বছরের ব্যবধানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি,এইচ,ডি ডিগ্রী লাভ করেন।এরপর তিনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি বিভাগে যোগ দেন।তাঁর কবিতার বই দশটিএবং তার সঙ্গে একটি লিমেরিক সংকলন আছে। কিন্তু তিনি কেবল কবিতা লেখেন তা নয়।প্রাবন্ধিকঅনুবাদক এবং সমালোচক হিসাবেও তাঁর পরিচিতি আছে।একটি প্রবন্ধ সংকলনএবং কিছু অনুবাদ  সমালোচনার গ্রন্থ আছে।এছাড়া একটি ইংরেজি উপন্যাস  ইংরেজি সাহিত্য সমালোচনার বই তিনি লিখেছেন।কবি দুটি সম্বর্ধনা   একটি পুরস্কার পেয়েছেন।





তোমার দুচোখ                

 

তোমার দুচোখ

জগতের আশ্চর্য জলাশয়

 

স্থির জল আকাশের প্রিয় প্যালেট,

কত ভাব, কত অনুভব, ভাবনার গভীরতা,

রঙের খেলায় বুঁদ আকাশ এখানে

আহ্লাদে বোলায় অজস্র আভায়

রাঙিয়ে তোলা অদেখা তুলির রাশি,

নীলের পিছনে ঘাপটি মেরে থাকে তীখালাল,

ধূসর কতই সহজে গলে যায় তরল সবুজে

 

আমি অবাক হয়ে দেখি, চেনা জগতের জল

নিমেষে অচেনা।

ভোরের নরম আলোয় আশ্রয়ের আশ্বাস মেলে,

তবুও কঠিন হয় আলো, চুষে খায় কোমলতা,

দুপুরের নির্দয় নিষেধ দুচোখ জ্বালিয়ে দেয়।

 

হাঁ খেলা করে সারাদিন,

সারাদিন মাছরাঙা দিনের খাবার খুঁজে

অপেক্ষায়, কিন্তু চিল, বাজ ডানা মেলে অলক্ষ্য

নীলে, টলটলে জলে প্রতিচ্ছায়া ভাসে।

 

সকালে পদ্ম, সন্ধ্যায় শাপলা, গোপন গভীরে

ঝাঁঝি শেহালার জটিল শিকড়ে বোনা হয়

রহস্যের ঝাঁপি, সেখানে সরল শিশু মাছের খেলা

জমে, তবুও সাপের নিয়ত আনাগোনা।

 

জীবনের সঙ্গে খেলা করে না-জীবন।

 



ফেলনা মেয়ে     

 

বহু সন্ধানের শেষে মন্দিরের গর্ভগৃহে সে ডুকরে উঠেছিল, হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর নিস্পৃহ পাথরে 

মাথা কুটে প্রতিধ্বনি আর্তনাদ করেছিল, না ঈশ্বর, না ঈশ্বর

 

পুজো-আর্চা মনুসংহিতার কঠিন শাসনে অচলায়তনে বেড়ে ওঠা সকালে উঠে স্ত্রোত্রপাঠ

সন্ধ্যায় গীতার এক অধ্যায় পড়ে তবেই পড়তে বসা ধর্মাচরণে ফাঁক নেই।

 

ঈশ্বর নিয়ে মাথা ঘামান না কেউ ধর্মশাসনের নিরেট দেয়াল নিয়ে কারবার সেখানেও 

সন্ধানে ছিল ফাঁকি দেবার লক্ষ ফোকর এমনি করেই কবে বড় হয়ে যাওয়া।

 

অবশেষে ঈশ্বরচিন্তার মুখোমুখি প্রশ্ন ছিল, ঈশ্বর কেমন? কি তাঁর রূপ? বই, বই,  

ঠাকুর, ঠাকুর মন্দির, মসজিদ, গীর্জা

 

মন্দিরচাতালে বসে কোন স্নেহস্পর্শে মন শান্ত হয়? শ্যামাসঙ্গীতে কেন সাড়া জাগে রক্তস্রোতে

কেমন মায়া? কার মায়া? প্রশ্ন অধীর করে মন, উত্তর কোথায়?


কালীমন্দিরে মা মা বলে মাথা কোটে মানুষজন ওরা মা বলে কাকে ডাকে জা্না নেই 

জন্মদায়িনী তো কঠিন, নির্মম নিষেধের মূর্তি এক, স্নেহ-মায়া-দয়াহীন। অবাঞ্ছিত কন্যার মা 

নেই।

 

রবিঠাকুর গানে পিতা বলে ডাকেন ঈশ্বরকে পিতার কি কঠিন, উদাসীন চোখ 

কন্ঠস্বরে বিরূপতা বুকে কাঁটা বেঁধে পিতা বলে ডাকবে কাকে?

 

ঈশ্বরকে সে বৃথা খোঁজে নিষ্করুণ পাথরপ্রতিমার অনীহ মুখে প্রতিচ্ছবি ফেলে সেই দুটি 

মানুষের রূঢ় মুখ যারা তাকে জন্ম দিয়েছিল

 

ফেলনা মেয়ের জন্য ঈশ্বর কি আছেন কোথাও?




কবিতা আমাকে   

 

কবিতার কাছে যেতে কুন্ঠা হয়, যেন শেয়ালকাঁটায় বিঁধে যায় আঁচল,

রাস্তা আটকায় নির্ভরসা কাঁটাতার, কারণ কে কাকে কি দেবে

কার হাতে কার ভবিষ্যৎ ব্যাপারে নিশ্চিত কিছুই নেই

কবিতাকে আমি সাজিয়ে তুলব এমন অবাস্তব

অহঙ্কার ছিল কবে কোন ভুলে যাওয়া

সময়ে, বোধ ছিল বয়ঃসন্ধির

পিছল নদীপারের

এঁটেল মাটি

অফলা

 

কবিতা

অস্থির অস্মিতা

যেন সহজ খেলায় ডাকে

ভাঙে আমার ঘুম-জাগা-স্বপ্ন সব

গুঁড়িয়ে পুড়িয়ে দলে মলে পেয়ে যাবে অন্য এক

বোধের পোড়ামাটি যাতে নিপুণ নির্মাণ নিখুঁত রূপটানে

তার রঙিন পুতুলঘর, অনেক ছবির মনভোলানো ভিডিওগ্রাফ,

পৃথিবীর বুকে ঘুরে ঘুরে পাক খাওয়া হাওয়ায় ছড়িয়ে থাকা কত চেনা

অচেনা সুরের স্বরলিপি, সাতরঙে ওড়া অযুত প্রজাপতি জীবনের চিঠির সংসার




কবিতা আজও     

 

আলোপথের সাইরেনগান মন ভুলিয়েছে কোন ভোরে

আজও পথ চলে কবিতা আলোর মুখের দিকে তুলে রাখে

সূর্যমুখী চোখ

 

ফুরোয় না পথচলা। সময়ের রং গাঢ় হয় শরীরে,

আকাশপট কবে বিষনীল

খবরের কাঁড়ি ওয়েস্টবাস্কেটে, হত্যাসংবাদ রেশন নিয়মিত,  

বোমাবাজের বেলেল্লা উল্লাস, ঝনঝন কানফাটা অস্ত্রসম্ভারের,

মানচিত্র জুড়ে নিরন্ন উদ্বাস্তুদের অনন্ত পরিযাণ।

শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকারে ধর্ষিতা মেয়ের চোখে ঘৃণা জ্বলে ধিকিধিকি,

বুভুক্ষু শিশুর কান্নায় পিছল হয় পৃথিবীর যত রাজপথ।

 

সে কেবল আলোর মূর্ছনা খুঁজে ফেরে অশা্ন্ত উদ্বেগে।

ক্লান্তিতে মাথা যায় নুইয়ে। ভর্ৎসনা বাজে হাওয়ায়,

এমন দিনে তার বেঁচে থাকা যেন অপরাধ, নেই। ক্ষমা,

 

তবু মাটির বুকে আজও আঁকা হয় ক্লান্ত স্বরলিপি তার গতিছন্দে

পৃথিবীর হৃৎপিন্ড ফুঁড়ে আকাশে ফিনকি দিয়ে ওঠে আকূতি,

আহতি ছড়িয়ে যায় হাওয়ায়,  বোধে। মুক্তি নেই তার।

অ্যাপোলোর কাছে সেও বুঝি পেয়েছে অমরত্বের বর।



গ্রহের ফের

 

গায়ে হলুদ দিন, স্বপ্নছবি দিন,

অনেক আশার আবীরমাখা টুলটুলে গাল দিন

হাঁকিয়ে গাড়ি চলছিল সে গড়গড়িয়ে,

তেলতেলে পথ খুশির রঙে রাঙিয়ে নিয়ে

হঠাৎ কেন হারিয়ে গেল আশার মুখে 

স্বপ্নরঙীন আলোর ছবি গভীর দুখে।

হঠাৎ লাগে অন্ধকারে ঠোকর ভারি,

হেডলাইটের কাচ ভেঙেছে, ভাঙল গাড়ি,

গুঁড়ো গুঁড়ো স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে গেল, ভাঙল প্রহ্‌র,

টুকরো কাচে রক্তভেজা বাজার শহর।

 

চোখের পাতায় আঁধার আঠা, দুচোখ খোলা দায়,

কোথায় এলাম, হারিয়ে গেলাম, রক্ত ঝরে পায়

সবাই মুখে মুখোশ আঁটে, দু-হাত দূরে থাকে

কেউ যেন না ঘেঁষে কাছে বলছে কেবল হেঁকে,

বাড়ির গেটে তালা, বাইরে থেকে বিদায় করে

অতিথজনে, নেই এখানে রীতি ঢোকার ঘরে

মুখোশ আঁটা প্রেমিকযুগল, মুখোশ আঁটা পার্কে শিশুমুখে

মুখোশ পরে বুড়োবুড়ি ঘরের দাওয়ায় রোদ্দুরে গা সেঁকে।

লক্ষকোটি একা মানুষ ভিড় করেছে কোন গ্রহের ফের

মুখোশ খুলে প্রেমিক মানুষ শ্বাস নিতে চায় খোলা হাওয়ায় ফের




ফণিমনসা

 

লক্ষ কাঁটায় বিদ্রোহ জেগেছিল শরীর ফুঁড়েবিঁধতে চেয়েছিল ঘিরে থাকা হাওয়ার অনীহা।। 

জেদের তাতল শ্বাসে পুড়ে গেছে পত্রালির মনকঠিনতা ব্যর্থ করেছিল বোল্ডারের বাধা তবু 

জীবন তার মাথায় দক্ষিণ হাত রাখলে আমূল কেঁপে উঠল ফণিমনসা। জীবনের রূঢ়তাকে 

অস্বীকার করে তার কাঁটার সাজতাকে বিঁধবে বলে তার বিদ্রোহের ঔদ্ধত্য মাথা নোয়াতে 

শেখেনি সেঋজু অস্বীকা্রে কঠিন দাঁড়িয়ে দুহাতের চেটো ছড়িয়ে ব্যঙ্গ করে নম্রতার নতি তার 

ডাল দাঁড়ায় বুক চিতিয়েনরম ছায়ার প্রেমলিখনে বৃথা আঁকিবুকি কাটেনা কৃপণ মাটির বুকে।

 

নিজেকে চেনায় তবু ভুল ছিল। সে তো খোঁজই রাখেনি, তার কাঁটার আড়ালে ছিল বাসনার 

তাতা রস জীবন আলতো হেসে স্পর্শ করল তাকেআর তার বুক ফেটে ছুটে এল আবেগ, 

ঘন কামনায় ফুটে উঠল ফুল হয়ে, আঁজলা ভরে আকাশকে উপহার দিল প্রেমরক্তিমা



স্বপ্ন              

 

এত ঘুম পায় কেন

ঘুম, যেন জলের অনেক নীচে নরম বালুতে

ঝিনুকের অলঙ্কারে সাজানো শয্যায় শরীর এলিয়ে

আলোর প্রবেশরহিত ঝিমধরা একাকী যাপন

সময়বিহীন দীর্ঘ পর্যটন

 

যে কখনো শৈশব পায়নি ছিল শিশু একদিন সেও,

ভেতরে দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে

ঘুমে আঠা ধরা চোখের পাতার ঝাঁপ ফেলে

আমার শৈশব বেখেয়াল ভেজে রোদভেজা বৃষ্টির সন্ধ্যায়

আলোছায়া শরীরে জড়িয়ে স্বপ্নঝাঁক 

দুলকিচালে পার হয় চেতনাবারান্দা

 

স্বপ্নেরা কাতার দেওয়া স্ক্রীনশট, সরে সরে যায় ,

মুছে দেয় একে অন্য, ঘুমে ক্লান্ত এই জীবনসায়াহ্নে

এই শত যোজনের জলের গভীরে

চোখের পাতায় নাচে, দেয় তুড়িলাফ,

হারানো স্বপ্নের কঙ্কালমিছিল











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন