সংস্কৃত কাব্য আর বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব কবির কল্পনায় খুব বেশি করেই পড়েছে একথা মানতেই হয়। কিন্তু এক জায়গায় কবি সম্পূর্ণভাবে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন যা আজকের নারী হয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। সংস্কৃত কাব্যে যেমন, তেমনই বৈষ্ণব কবিতায় আদিরসের প্রাধান্য কেউ অস্বীকার করবেন না। নারী সেখানে অনেকটাই ভোগের সামগ্রী। কালিদাস থেকে জয়দেব পর্যন্ত সবার মধ্যেই দেখি নারীর রূপবর্ণনা সম্পূর্ণভাবে শরীরি। কালিদাসের রমণীরূপ বর্ণনায় স্পষ্টতঃই নারীর যৌনতা প্রাধান্য পেয়েছে। সে ‘শ্রোণীভারাদলসগমনা, স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং’। তাঁর একটি বিখ্যাত বর্ণনার কথা মনে করি,
তন্বী, শ্যামা, শিখরিদশনা, পক্ববিম্বাধরৌষ্ঠী
মধ্যে ক্ষ্যামা, চকিতহরিণপ্রেক্ষণা, নিম্ননাভিঃ।
এই বর্ণনায় কোথাও নারীর রূপ শরীরি বর্ণনার উপরে উঠতে পারে না। নারীর ঠোঁটের বর্ণনায় কালিদাস যেখানে বলছেন, ‘পক্ববিম্বাধরৌষ্ঠী’, সেখানে উপমাটি একটি পাকা ফল, তাই তার মধ্যে সম্ভোগের আভাসও রয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের নারী রোম্যান্টিকের সৌন্দর্যস্বপ্ন। তাঁর কবিতায় এক অনন্য উত্তরণ দেখি। নারী তাঁর কাছে সম্ভোগের বস্তু নয়, সে যেন এক শিল্পীর পরম সৌন্দর্যস্বপ্ন। তিনি যখন তার ঠোঁটের কথায় বলেন, ‘তব অধর গড়েছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া’, তখন নারীর সৌন্দর্য এক অনির্বচনীয়ের মাত্রা পেয়ে যায়।
আমরা যদি ‘স্বপ্ন’ কবিতাটির কথা ভাবি তবেই তাঁর স্বপ্নলোকের সেই প্রেয়সীকে দেখব যে বহুযুগের পার থেকে এসে তাঁর স্বপ্নজগৎ অধিকার করে, ‘মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে’। কিন্তু স্বপ্নজগতের সঙ্গে বাস্তবের সংঘাতে কবি বিমূঢ়। এই যে বহু প্রাচীন কাব্যজগৎ থেকে পাওয়া নারীর কল্পনার ছবি, তার সঙ্গে আজকের কবি যোগসূত্র স্থাপন করবেন কি করে? এই নারী তো হারিয়ে গেছেন, মানসপ্রিয়ার সঙ্গে আদানপ্রদান আজকের দিনে তো সম্ভব নয়ঃ
সে ভাষা ভুলিয়া গেছি, নাম দোঁহাকার
দুজনে ভাবিনু কতো—মনে নাহি আর
কিন্তু কবিতায় আজকের দিনের প্রণয়িনীর সঙ্গে তাঁর যে কল্পনার ছবি সে ছবিও পুরোনো দিনের কাব্যিকতার রেশ নিয়েই আসে, ফুলের গন্ধ, বাঁশির তান, যুঁই ফুলের মালা, কিছুই বাদ যায় না।
হেনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে--
আমার বাঁশি লুটায় ভূমে,
তোমার কোলে ফুলের পুঁজি।
--------
বাসন্তী-রঙ বসনখানি
নেশার মতো চক্ষে ধরে,
তোমার গাঁথা যূথীর মালা
স্তুতির মতো বক্ষে পড়ে।
নারীকে কল্পনায় এই পরিবেশেই তিনি দেখেছেন তাঁর কবিতার জগতে। এই যে কল্পলোকের মানসী তার কথা তো কবি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে তার রূপ অনেকটাই পুরুষের কামনায় ও শিল্পে সৃষ্টি,
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী--
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিমন গভীর এবং তার ব্যাপ্তি আমাদের অবাক করে। তাঁর হৃদয়ে নানা ‘ভাবের কুসুমভার’ আপনা আপনি ফুটে ওঠে। আধুনিক যুগের বাস্তবের সঙ্গে এই কল্পনাপ্রতিমার সদা বিরোধ। তাই অন্য সময় অন্য এক মেজাজে কবিকে বলতে শুনি নতুন যুগের নারীর কথা। তিনি এই ছবির সঙ্গে খাপ খান না বটে, কিন্তু তবু কবি তার মধ্যে সেই চিরন্তনীকেই দেখছেন,
পরেন বটে জুতা মোজা,
চলেন বটে সোজা সোজা,
বলেন বটে কথাবার্তা
অন্যদেশীর চালে-
তবু দেখো সেই কটাক্ষ
আঁখির কোণে দিচ্ছে সাক্ষ্য,
যেমনটি ঠিক দেখা যেত
কালিদাসের কালে।
মরব না, ভাই, নিপুণিকা-
চতুরিকার শোকে—
তাঁরা সবাই অন্য নামে
আছেন মর্তলোকে
অর্থাৎ নব্য নারীর বেশভূষা, চালচলন নিয়ে হালকা ঠাট্টার মধ্য দিয়ে কবি নীতিবাগীশদের একহাত নিলেন। এই যুগের নতুন সাজে, নতুন চালচলনে যাঁরা এলেন, তাঁদের দেখা গেল কবির বেশ ভালোই লাগে। সবসময়েই নারীকে তিনি মোহিনির রূপেই দেখছেন। তবে একটা কথা কবি বারবারই স্বীকার করছেন যে নারীর মোহিনি রূপ অনেকটাই পুরুষের মোহদৃষ্টি থেকেই সৃষ্টি হয়।
মম মোহের স্বপন অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে।
রোম্যান্টিক লিরিকে একান্তভাবেই কবির কোনো এক বিশেষ মুহূর্তের তাৎক্ষণিক মেজাজের প্রতিফলন হয়ে থাকে। নানা বিভিন্নমুখী ভাবনার স্রোত রোম্যান্টিক গীতিকবিতার মধ্য দিয়ে বয়ে যায়। রবীন্দ্রসাহিত্যে নারীর আলোচনায় তাই রোম্যান্টিক গীতিকবিতাগুলির খুব বেশি তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো কেবল রোম্যান্টিক লিরিকে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, তাঁর কাব্যজগতের বিস্তার অসামান্য।নানাধরণের নানা কবিতায় তাঁর নারীভাবনার যে বৈচিত্র্যময় প্রকাশ তা নিয়ে আলোচনা করা নিশ্চয়ই প্রয়োজন।
পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ অনেক নাট্যধর্মী লিরিক কবিতা লেখেন আমরা সবাই জানি। বাংলাভাষায় এমন কবিতা এই প্রথম। পুরোপুরি আধুনিক যুগ যেন বাংলা কবিতায় এল এই কবিতাগুলির হাত ধরেই। এই কবিতাগুলির অনেকটির মধ্যেই শুনি মেয়েদের কাহিনি। আজকের দিনের মেয়ে এরা। এদের নিয়ে নানা পারিপার্শ্বিকে নানান চিন্তার ফসল এই সব কবিতা। ততদিনে মেয়েরা লেখাপড়া করছেন রীতিমতো, তাঁদের নিজস্ব পরিচয় গড়ে উঠছে ক্রমশঃ। সাবেকি দিনের মেয়েদের থেকে তাদের বেশভূষা, চলনবলন, মানসিকতা, সবই আলাদা। কবি তো এঁদের আগে চিনতেন না, নতুন করে চিনছেন। কিন্তু পুরোনো দিনের দিকে তাকিয়ে থাকা নীতিবাগীশিদের মানসিকতা কোথাও আমরা দেখতে পাই না। কবি যেন এই যুগের মেয়েকে চিনতে চাইছেন, বুঝতে চাইছেন, বুঝতে চাইছেন তাদের সমস্যাগুলো কোথায়। এছাড়াও সমাজে নারীর সমস্যাগুলির দিকে কবি মন দিচ্ছেন।‘প্রহাসিনি’-র ‘আধুনিকা’ কবিতায় কবি রঙ্গ করে বলছেন,
নবীনারা যুগে যুগে এল দিনে দুপুরে
যেথা স্বপনের পাড়া যায় সেথা আগিয়ে
প্রাণটাকে নাড়া দিয়ে গান যায় জাগিয়ে।
পরিণত কবির মন এইসব কবিতায় দেখি অনেক বেশি বাস্তব অভিমুখী। ভাবছি ‘পুনশ্চ’-র সেই ‘সাধারণ মেয়ে’-র কথা। শরৎচন্দ্রের কাছে তার দরবার, তাঁর কলমে তাকে তিনি জিতিয়ে দিন।
সে একান্তভাবেই সাধারণ এক বাঙালি মেয়ে যে কেবল হৃদয়ের সম্পদে ধনী,
এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে।
তারা ফরাসি জর্মান জানে না,
কাঁদতে জানে।
এই মেয়েটির কাছে তার প্রিয় নরেশ অনেক বিদেশিনীদের অসামান্যতার কথা বলে, তাকে হেয় করে। মালতী সেই বিদেশিনীদের হারাতে চায়। সে চায় শরৎচন্দ্রের লেখনীতে গণিতে প্রথম হয়ে সে বিদেশে যাবে, সেখানে বিদ্বৎসমাজ তাকে আবিষ্কার করবে,
জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে---
শুধু বিদূষী বলে নয়, নারী বলে,
ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে।
এখানে আমরা কিন্তু দুটি নারীকে পেলাম। একটি আমাদের অনেক চেনা বাঙালি মেয়ে, অন্যটি বিদেশিনী। বাঙালি মেয়েটি ‘ফরাসী জার্মান জানে না’, সে কেবল ভালোবাসতে জানে, আর তাই সে ‘কাঁদতে জানে’। কিন্তু বিদেশী মেয়েটি একেবারেই অন্যজাতের। সে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ‘সমুদ্রে নাইতে’ যায়, তার কথার যাদু মিথ্যা হলেও পুরুষকে মোহিত করে। আমরা রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনায় কেটি দত্ত বা নীলার মতো যে আধুনিক ঝকঝকে মেয়েদের দেখি এই লিজি তাদেরই একজন। এদের হৃদয়ের গভীরতার বদলে আছে বাইরের চোখধাঁধানো চাকচিক্য ও কথার চাতুরী। এই দুই ধরনের মেয়ের বৈপরীত্য রবীন্দ্রনাথের রচনায় বারবার আসে। ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘সাধারণ মেয়ে’ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এর আগেই ১৯২৮ সালে ‘শেষের কবিতায়’ আমরা লাবণ্য ও কেটির মধ্যে একই ধরনের বৈপরীত্য দেখি। লাবণ্যের মধ্যে আমরা এই সাধারণ মেয়েটির তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষা ও সংযম দেখলেও দুজনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কমই আছে। কেটিকে সহজেই লিজির দেশি সংস্করণ বলে মনে করা যায়।
এবার তবে প্রশ্ন জাগে কবিতার পরিসরে তিনি বাস্তবের নারীর কোন রূপ দেখলেন? তাঁর কবিতার জগতে কি পুরোনো ধারণা থেকে মুক্তি এল? লিজির মধ্যে পশ্চিমের নারীর সেই ঋণাত্মক মূর্তি ফুটে ওঠে যে রূপ রবীন্দ্রনাথের চোখে ভালো লাগেনি। অন্যদিকে মালতীকে ভালো করে দেখলে বোঝা যায় যে কবির নারীভাবনা তাঁর প্রবন্ধে প্রকাশিত বিশ্বাসটুকুই আঁকড়ে রয়েছে। যে মেয়েটির কাছে লেখাপড়া করা সাহিত্যিকের কল্পনা, এবং যে ‘কেবল কাঁদতে জানে’, সেই মেয়েটি তো সেই হৃদয়বৃত্তিপ্রধান নারী যার কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নারী’ প্রবন্ধে বলেছেন। এই মেয়েটি সেই সনাতন প্রেমপ্রবণ নারী যার কাছে পড়াশুনা করা নেহাৎ স্বপ্নমাত্র, এবং তার সঙ্গে জ্ঞানতৃষ্ণার কোনো সম্পর্ক নেই। মেয়েটি বাংলাদেশের অগণিত নারীর প্রতিভূ হয়ে পড়াশুনা করতে চায় কেবলমাত্র পুরুষের চোখে বড় হয়ে উঠবে বলে। নরেশের ব্যবহারে মেয়েটির পড়াশুনার দিকে ঠিক মন তো যায়নি, জ্ঞানজগতের খোঁজ সে চায়নি, সে সেই নরেশকে তাক লাগিয়ে দেবে বলেই কিছু ডিগ্রি চায়, অবশ্যই কল্পনায়। অন্যদিকে মন দেবার কথা, পুরুষের মন জয় করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য তার কল্পনায় আসেনি। এ নিয়ে অবশ্য আমাদের ক্ষোভ থাকবার কথা নয়, কারণ কবি অন্ততঃ এমন অবহেলিত মেয়েদের দুঃখটুকু অনুভব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন