সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "রবীন্দ্রকাব্যে নারী"


 রবীন্দ্রকাব্যে নারী

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নারী কোন রূপে প্রকাশ পেয়েছেন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ধন্দে পড়তে হয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের চিন্তা সরলরেখায় এগোয় না; তাঁর মন কবির মন, তাতে নানা সময়ে নানা ভাবের কুসুমভার আপনা আপনি ফুটে ওঠে। নারী সম্বন্ধেও বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্ন ভাবের সমাবেশ। সেই নানা কবিতার নানা ভাব থেকেই কিছু জটিল চিন্তা কবির নারীভাবনাকে চিহ্নিত করে। নানা ধরণের কবিতা থেকে সেই নারীভাবনাকে সামান্য একটু ধরার চেষ্টা হয়ত করা যায়, কিন্তু সবটুকু ধরা যায় বলে আমার মনে হয় না। তবু তাঁর বিভিন্নমুখী চিন্তাকে কিছুটা বুঝতে চেয়েই এই লেখার অবতারণা।

বলাকার ২৩ নং কবিতাটি  পড়লে দেখা যাবে যে পুরুষতন্ত্রে সুপ্রাচীন যুগ থেকে নারীজাতিকে যে  দুটি বিশেষ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সেই বিভাগ দুটিকে এখানে মেনে নিয়েছেন, নিয়ে কোনও বিবাদ-বিসংবাদ করবার প্রয়োজন বোধ করেন নি কিন্তু তাঁর শব্দের জাদুতে এবং তাঁর অনন্য দৃষ্টিভঙ্গীতে কবি সেই পুরোনো বিভাজনকেই অসামান্য কাবসৌকর্যে প্রকাশ করেছেন,  এবং সম্পূর্ণ এক নতুন মাত্রা দিয়েছেন। কবিতাটি সবাই পড়েছেন, সকলেই মুগ্ধ হয়েছেন, কিন্তু সবাই যে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখেছেন তা নাও হতে পারে,  তাই কবিতাটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে দুচারটি কথা বলতে চাইছি।  এখানে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গীতে  চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা  কতটা প্রতিফলিত হয়েছিল সেটুকু যেমন দেখা যায় তেমনি তাঁর একান্ত নিজস্ব দেখবার চোখ দিয়ে দেখে পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে তিনি কতটা বেরিয়ে আসেন সেটাও  স্পষ্ট চোখে পড়ে।

কোন্ক্ষণে
সৃজনের সমুদ্রমন্থনে
উঠেছিল দুই নারী
অতলের শয্যাতল ছাড়ি।
একজনা উর্বশী, সুন্দরী,
বিশ্বের কামনারাজ্যে রানী,
স্বর্গের অপ্সরী।
অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,
বিশ্বের জননী তাঁরে জানি,
স্বর্গের ঈশ্বরী।


পুরুষের কল্পনায় নানা দেশে, নানা কালে নারীজাতির এই দুটি ভাগ  নারীকে ঠিক সম্পূর্ণ মানুষ বলে তো মানা  হয়নি, তাই বোধহয় তাদের প্রত্যেককে দোষেগুণে গড়া ঈশ্বরসৃষ্ট মানবের মতো একান্ত নিজস্ব চরিত্রবিশিষ্ট একেকটি ভিন্ন ভিন্ন  মানবী বলে দেখাই হয়নি কোনোদিন  মানবসমাজে একদিন সৃজনের মুখ্য পাত্র হিসাবে নারীর স্থান ছিল পুরুষের ঊর্ধ্বে। কোনও প্রাগৈতিহাসিক যুগে সমাজে চল ছিল মাতৃতন্ত্রের। এখনও অনেক আদিবাসী সমাজে  ব্যবস্থা বর্তমান। কিন্তু নানা আর্থ-সামাজিক এবং অনেকটা  জৈবিক কারণে গোটা পৃথিবীর সমাজ যখন থেকে পুরুষতন্ত্রের পীঠস্থান তখন থেকেই পুরুষ মোটামুটি ঠিক করে নিয়েছে যে নারী ব্যবহৃত ধনপুরুষের প্রয়োজনে ব্যবহার হবার জন্য তার সৃষ্টি। পুরুষের সৃষ্ট ধর্মগ্রন্থগুলি নানাভাবে এই কথা প্রচার করে আসছে বহুদিন ধরে। ঘরে তার যে রূপ সেটি পুরুষের পক্ষে অত্যন্ত সুবিধার। সে পুরুষের ঘরকন্না দেখভাল করেনিয়মিত তার শয্যাসঙ্গিনী হয়তার সন্তানের জন্ম দেয়। সে তার অধীনতার আজ্ঞাবহ। তার জন্য সতীত্বের আদর্শ সবদেশে সব কালে। সীতা সাবিত্রীকে নাহয় ছেড়েই দিলামইউলিসিস ক্যালিপ্সো সঙ্গে বছর কাটায়আর পেনেলপে অজস্র প্রেমিককে উপেক্ষা করে অপেক্ষা করে বারোবছর। অভূতপূর্ব চাতুরি প্রয়োগ করে সে তার পাণিপ্রার্থীদের দূরে সরিয়ে রাখে এই নারীকে পুরুষ সহজেই বলে ‘কল্যাণী’, বলে ‘বিশ্বের জননী এদের উপর সতীত্ব আর মাতৃত্বের লেবেল লেগে যায়,  কারো মুখ আর আলাদা করে চেনা যায় না।

কিন্তু অন্য এক নারী আছে যাকে পুরুষের দরকার হয় আপন প্রবৃত্তির জন্য,  কিন্তু যাকে নিয়ে পুরুষের সমস্যার অন্ত নেই। তার জন্যকবির ভাষায়, ‘অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা নিজের প্রবৃত্তির উপরনিজের কামনার উপর পুরুষের বশ নেই। ক্যালিপ্সোকে তো প্রয়োজন হয় ইউলিসিসের। তাই যেসব নারী পুরুষের মনে কামনা জাগায় তাদের জন্য পুরুষের কল্পনায় সৃষ্টি হয় অন্য এক ভাগ। তারা মা নয়,  কল্যাণী স্ত্রী নয়কন্যা নয়। কিন্তু তারাও বিভাজনের এক বিশেষ অংশ,  তাদের সবার মুখও লেপেপুঁছে এক হয়ে যায় পুরুষের কল্পনায়। তারাও ঠিক ‘মানবী’ হয়ে উঠতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় তারা ঋণাত্মক অস্তিত্ব  এইসব নারী স্পষ্টতঃই পুরুষের ভাবনায় ‘নরকের দ্বার  সংসারের বাইরে অবস্থান করে যে সব নারী কেবলই পুরুষের মনোরঞ্জনের কাজ করে   সেই বারনারীরাই এই বিভাজনে পড়ে্ন। অপ্সরা কল্পনার সৃষ্টিও হয়েছে এখান থেকেই  বারনারীরা সমাজের চোখে নিন্দনীয়তাদের জন্য একফোঁটা শ্রদ্ধা বরাদ্দ করেনি সমাজ পৃথিবীর  সব সমাজে এরা ‘পতিতা’ বা ‘ফলেন ওম্যান এরা নারীর সেই অন্য মুখ যাকে পুরুষ ঠিকমতো বশে আনতে পারেনাআর তাই তাকে ঠিকমতো চেনেনা তাছাড়া এদের আকর্ষণ পুরুষ এড়াতে পারে নাতাই তাদের সে একদিকে কামনা করে অন্যদিকে ঘৃণা করে।  অপ্সরাকুল চিরদিন মুনিঋষির ব্রতভঙ্গ করে এসেছেনতাঁরা কেবলই পুরুষের কামনার সঙ্গী  কোনোদিনই তাঁরা নিজস্ব বিশেষ চরিত্র নিয়ে দোষেগুণে গড়া মানবী হিসাবে প্রকাশিত হননি।  ভারতীয় কল্পনায় অপ্সরারা বেহেশতের হুরী-পরীদের সমতুলপুরুষের কামনা চরিতার্থ করা ছাড়া তাঁদের কোনও কাজ নেই  তাঁদের মধ্যে মানবিক কোনও নীতি বা বোধ কাজ করে না ঊর্বশী তাই পুরূরবাকে কামনা করেন মেনকা তাঁর সন্তান শকুন্তলাকে ত্যাগ করেন  এই বিভাজন সুপ্রাচীন  রবীন্দ্রনাথ নতুন কিছু বলেন নি। লক্ষ্মী  ঊর্বশীর বিভাজনে ঊর্বশীর মূর্তি কতটা নেতিমূলক তা একটা ব্যাপার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দুজনেই সমুদ্রমন্থনে জল থেকে উঠেছেন। লক্ষ্মী যেমন ঐশ্বর্যময়ীপরম রূপলাবণ্যময়ীঊর্বশী তেমনই শ্রেষ্ঠা সুন্দরীকলাবিদ্যায় পারদর্শিনী। কিন্তু লক্ষ্মী দেবীজ্ঞানে পূজিতা হনতিনি সমুদ্রকন্যা বলে তাঁর নাম অম্বুজা। সকল গৃহে গৃহলক্ষ্মীদের মধ্যে তাঁর প্রকাশ। অথচ ঊর্বশী সুন্দরীশ্রেষ্ঠানৃত্যগীতবাদ্যে অনন্য কুশলতাসম্পন্না হয়েও এক অপ্সরা হয়েই রয়ে যান হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে অম্বুজা বলেও তাঁর পরিচয় হয় না। এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলতেই হয়। কলাবিদ্যায় পারদর্শিনী সুন্দরীরা সকল সমাজে ছিলেন। ঘরে ঘরে লক্ষ্মীস্বরূপা সর্বংসহা কূলবধূদের মতো পুরসুন্দরী ঊর্বশীরাও চিরদিন ছিলেন। কিন্তু তাঁরা নেতিমূলক অস্তি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলেন তার সবচেয়ে বড় কারণ এই যে তাঁরা পুরুষের অধীন ছিলেন না কোনোদিন। ঘরের বৌ দাসী ছিলেন, কিন্তু নগরনটী অথবা বাইজিরা পুরুষের অধীনতা স্বীকার না করে স্বাধীন জীবন যাপন করতেন। এঁদের উপরে পুরুষের আধিপত্য খাটত না, অথচ এঁদের বাদ দিয়েও পুরুষের চলত না। এঁদের আকর্ষণের কাছে পুরুষ চিরদিন অসহায়, তাই এঁদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের শেষ নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে এঁদের অস্তিত্বই নেতিমূলক। 

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কবি তিনি তো  নীতিবাগীশ নন সুন্দরীশ্রেষ্ঠা কলানিপুণা  পুরুষের চিত্তজয়ে পারদর্শিনী ঊর্বশীর কল্পনা স্বভাবতঃই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।  তাই তিনি ঊর্বশীকে নারীর লীলাময়ী রূপের পরম চরম প্রকাশ হিসাবে,  এক  অনন্য সৌন্দর্যপ্রতিমা হিসাবে দেখেন। এই কবিতায় সে যেন মূর্তিমিতী কামনা  কেবল নয়, সে যৌবন বসন্তের প্রতিমূর্তি,

 একজন তপোভঙ্গ করি

     উচ্চহাস্য-অগ্নিরসে ফাল্গুনের সুরাপাত্র ভরি

              নিয়ে যায় প্রাণমন হরি,

     দু-হাতে ছড়ায় তারে বসন্তের পুষ্পিত প্রলাপে,

              রাগরক্ত কিংশুকে গোলাপে,

                      নিদ্রাহীন যৌবনের গানে।

 

এই ছবির মধ্যে কোথাও নীতিশাস্ত্রের অনুপ্রবেশ নেই। কবি ঊর্বশীর কল্পনার মধ্যে সৌন্দর্যের যে অনন্য মাত্রার সন্ধান পেয়েছেন তাতে তার ঋণাত্মক চেহারাটা গেছে হারিয়ে। ঊর্বশী এখানে সামান্য এক অপ্সরা মাত্র থাকেন না, তিনি এক প্রতীকের মাত্রা পেয়ে যান, উত্তীর্ণ হন সেই বিন্দুতে যেখানে নারীর রূপে কবি দেখতে পান যেন এক বিমূর্ত সৌন্দর্যের পরম প্রকাশ সুপ্রাচীন নীতিনির্ভর এক বিভাজনকে আজকের কবি এক অন্য মাত্রা দেন, লক্ষ্মী আর ঊর্বশীর দ্বৈততার মধ্যে প্রকাশ করেন একদিকে কল্যাণী আর অন্য দিকে লীলাময়ী রূপের মধ্যে নারীর সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা। এখানে নারীর বাস্তব চেহারার যদি সন্ধান পাওয়া না যায় তবে সেটা ঠিক সমস্যা হয়ে ওঠে না কারণ রবীন্দ্রনাথ একজন রোম্যান্টিক কবি। কাব্যরচনার সময় তাঁর কল্পনা সবসময় বাস্তবধর্মী হবে এমন কথা কেউ বলবেন না।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনার  আলোচনায় নিয়তই নানা প্রশ্ন আমাদের চঞ্চল করে ১৯১৬ সালে বলাকার তেইশ নম্বর কবিতায় তিনি নারীজাতির যে সুপ্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক বিভাজনের অসামান্য কাব্যরূপে আমাদের মুগ্ধ করলেন, ১৯৩৩ সালে, অনেক বেশি পরিণত বয়সে সেই বিভাজনের উপরেই প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর উপন্যাস দুই বোন উপন্যাসের আলোচনা এখানে উপযুক্ত নয়, কিন্তু এই অংশের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি দুই বোন-এর প্রথম কিছু পংক্তি পাঠকের স্মরণে না আনি,

মেয়েরা দুই জাতের, কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি।

এক জাত প্রধানত মা, আর-এক জাত প্রিয়া।

 

ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা যায় যদি, মা হলেন বর্ষাঋতু। জলদান করেন, ফলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, ঊর্ধ্বলোক থেকে আপনাকে দেন বিগলিত করে, দূর করেন শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব।

 

আর প্রিয়া বসন্তঋতু। গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়ামন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছয় চিত্তের সেই মণিকোঠায়, যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে নীরবে, ঝংকারের অপেক্ষায়, যে-ঝংকারে বেজে বেজে ওঠে সর্ব দেহে মনে অর্নিবচনীয়ের বাণী।

 

এখানে কবি একই দ্বিত্বের কথা লেছেন, গদ্যভাষায় হলেও অসামান্য সুরঝঙ্কারে উপমায় নারীর এই দ্বৈতরূপের সুষমা আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন কিন্তু এখানে একটা বিশেষ তফাৎ আছে এতগুলো বছরে কবি অনেক পরিণত হয়েছেন, রচনা করেছেন গল্পগুচ্ছে বাস্তবধর্মী জস্র কাহিনি, যেখানে নারী বাস্তব চেহারা প্রকাশ পায় নানা রূপে তাই আজ কবি সেই সুস্পষ্ট বিভাজনকে পুরোপুরি হয়তো বা মন থেকে গ্রহণ করতে না পেরে প্রথমেই বলে নিচ্ছেন, যে এমনটা ঠিক তাঁর কথা নয়, কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি কবির মনের এই দোলাচল তাঁকে অসামান্য করে, কারণ এখানেই তিনি প্রমাণ করেন যে পন্ডিতের বিশ্লেষণকে জীবনের নিরিখে যাচাই না করে তাকে পুরোপুরি ধ্রুব সত্য বলে, আপন বিশ্বাস বলে স্বীকার করতে তিনি নারাজ

 

রবীন্দ্রনাথের লিরিক কবিতায় এক রোম্যান্টিক কবির ভাবনার প্রকাশ। সেখানে তাঁর দৃষ্টিতে নারী পূর্ণ সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। তাঁর কবিতায়, গানে এক প্রেমিক পুরুষের স্বতঃ উৎসারিত যে নারীর বন্দনা তা নিশ্চয় চিরদিনের সকল কবির কল্পনার নির্যাসটুকু নিয়েই গড়ে উঠেছে। কবি রবীন্দ্রনাথের কল্পনাকে অধিকার করেছিল এক অনন্য মানসীমূর্তি। এই মূর্তির সঙ্গে পরিচয় হলে বোঝা যায় সে কোথা থেকে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। বেদ, ঊপনিষদের সঙ্গে অজস্র সংস্কৃত কাব্য তিনি পড়েছিলেন, সেগুলি নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, কখনও বা কিছু অনুবাদ করেছেন। ছাড়া বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে তাঁর গভীর যোগ ছিল একথা তাঁর কৈশোরে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীই প্রমাণ করে। এইসব কাব্যের প্রভাবে তাঁর কল্পনায় ভারতীয় নারীর যে ছবি জেগে উঠেছিল তা বেদোক্ত ব্রহ্মবাদিনীর নয়, বরং সংস্কৃত কাব্য আর পদাবলী থেকে আহরিত নারীর এক লাস্যমূর্তি। এই নারী বারবার ফিরে ফিরে আসেন তাঁর কবিতায়। নববর্ষা সমাগমে তিনি তাদের অভাব অনুভব করেন,

কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,

জনপদবধূ তড়িৎচকিতনয়না,

     মালতীমালিনী কোথা প্রিয়পরিচারিকা,

         কোথা তোরা অভিসারিকা!

ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা,

ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণরশনা

আনো বীণা মনোহারিকা

এরা সেই কালিদাসের কালের নারী। এদের আমরা গভীরভাবে চিনেছি রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে। দের তিনি যখন বলেন

কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,

ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী॥

কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,

অঞ্জন আঁকো নয়নে।

তালে তালে দুটি কঙ্কন কনকনিয়া

ভবনশিখীরে নাচাও গণিয়া গণিয়া

স্মিতবিকশিত বয়নে--

তখন যেন কবির রোম্যান্টিক কল্পনায় কোন বিস্মৃত যুগ ফিরে আসে, আমরা বিভোর হই জাগ্রতস্বপ্নে। কৈশোরে তিনি তাদের ডেকেছিলেনভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে,

অঙ্গে চারু নীল বাস,

হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ,

হরিণনেত্রে বিমল হাস,

কুঞ্জবনমে আও লো॥

কবি বলেন নীল রঙে তাঁর গভীর আনন্দ, আর শ্রীরাধা নীলবসনা তাই বোধহয় এই কল্পনার নারীরা নীলবসনা।নীপবনে ছায়াবীথিতলেকবি তাদের ডাক দেন, এক অসামান্য রোম্যান্টিক কল্পনাবিলাসে আমরা মগ্ন হই তাঁর কবিতার আবহে। 
ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন