শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১
ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"
‘ঈশ্বর নেই’ হাওয়া দেয় টিটকারি!
অন্ধকার দিনগুলিতে
তখনও কি গান থাকবে কোনো?
অবশ্যই থাকবে তখন গান
অন্ধকার দিনের। (বের্টোল্ট ব্রেশ্ট্ / অনুবাদ : শঙ্খ ঘোষ)
প্রাক্কথন
করোনা নামক অচেনা অসুখের সামনে এখনও অসহায় মানুষ। ফেসবুক-হোয়াটস্যাপে এরকম ব্যঙ্গাত্মক মেসেজ বা সচিত্র পোস্ট প্রায়ই দেখা যাচ্ছে – ধর্ম এখন অপেক্ষা করছে বিজ্ঞান কি আবিষ্কার করছে তার জন্য কিংবা মন্দির-মসজিদ-চার্চের দরজা বন্ধ, দেবতারা মানুষের থেকে মুখ ফিরিয়েছে অথচ হাসপাতালগুলি খোলা, সেখানে জীবন্ত ঈশ্বর হয়ে চিকিৎসক ও তাঁর সহায়ক-সহায়িকারা মানুষের সেবা করে চলেছেন। এবং তাই এই দুঃসময়ে আরেকবার প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে ঈশ্বর আসলে নেই, একমাত্র মানুষই সত্য। হ্যাঁ, সবার উপরে মানুষ সত্য – এই চণ্ডীদাসের বিখ্যাত উক্তি আমরা সকলেই মানি। তবু ধর্ম নিয়ে অনেক গোলমাল থাকলেও ‘স্রষ্টা আছে বা নাই’ – এই নিয়ে সংশয় কিন্তু কখনো ঘোচেনি। কেনই বা প্রতি একশো বছরে মহামারী মানবসভ্যতাকে আক্রমণ করে, তার ইতিহাস নিয়ে চর্চা হলেও, কারণ অজানা! প্রাচ্যের চার্বাক জড়বাদ কিংবা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ থেকে একালের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানও এই বিশ্বসৃষ্টির কার্য-কারণের তল পায় না কখনোই। আসলে যে যার নিজের মতো একটা ব্যাখ্যা তৈরি করে শান্তি পেতে চায়। আধুনিক বিশ্বে ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করেন কবি নের্ভাল থেকে দার্শনিক নীৎশে। তবু আমাদের মেনে নিতে হয়, মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বাস, নিবেদন আর নৈতিকতার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ঈশ্বরের ধারণা। তাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মণি ভৌমিক তাঁর একান্ত অভিজ্ঞতায় উচ্চারণ করেন এই অমোঘ সত্য :
It is the power of the one source, the order that underlies and enfolds all orders, that unifies all fields and forms, as well as consciousness and it will not, by now, surprise you to hear my assertion that we call this source by its code name : God. (Code name God / 2005 : 216)
গ্রন্থটির অনুবাদক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এ-প্রসঙ্গে টেনে এনেছেন রবীন্দ্র-কল্পনায় একক আদি উৎসের অখণ্ড পরিপূর্ণ উপলব্ধির প্রতীক একতারার সুর, একটি কুসুমের গন্ধ-কে (২০১০ : ২১৭)। মহাবিশ্বলোকের ইশারাজাত কবিতার মগ্ন শব্দমালায় বিধৃত সমস্ত ঈশ্বরায়িত ধারণার উৎস আসলে এক অনন্ত সত্তার চিন্ময় প্রকাশ। যে-সত্তা হয়তো মহাবিশ্বলোক কিংবা মহামানবতার সীমায়িত ব্যঞ্জনাময় প্রকাশ। আর তাই এমন অস্থির সময়েও হয়তো আমরা কবিতার কাছে আশ্রয় খুঁজি, এক আস্তিক্যের বলয়ে নিজেদের বলয়িত করতে ইচ্ছে হয় কখনো কখনো। সময়ের রক্তাক্ত অভিজ্ঞান হয়েও কবিতা তো আসলে আমাদের আর্ত হৃদয়ের শুশ্রূষা, উত্তরণের মন্ত্র : ‘ক্রমায়ত আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি’।
১।
আধুনিক বিশ্বের মূল সুর ‘সেক্যুলারিজ়ম’ তথা ধর্মনিরপেক্ষতা। বিশ শতকের রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতার ধারায় ‘ঈশ্বর’-এর ভাবমূর্তিও সেই অর্থে সেক্যুলার। মহাবিশ্বলোকের ইশারাজাত কবিতার মগ্ন শব্দমালায় বিধৃত সমস্ত ঈশ্বরায়িত ধারণার উৎস আসলে কী এক অনন্ত সত্তার চিন্ময় প্রকাশ? রবীন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রেতর বাঙালি কবিদের ঈশ্বর-ভাবনা আসলে সু-চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চায়। ঈশ্বর-কে স্বীকার, অস্বীকার কিংবা আধুনিক ভক্তিময়তার ভিতরে একধরণের আশ্রয় খোঁজার প্রয়াস রয়েছে। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ আর একাধিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও বিপ্লবের আগুনে দগ্ধ পৃথিবীতে এই ঈশ্বর কবিদের কাছে অনেকাংশেই ‘পার্সোনাল গড’। রবীন্দ্রোত্তর পর্বের আধুনিক কবিতায় ঈশ্বর-ভাবনা আসলে ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ইমেজ তথা ভাবমূর্তির কথাই বলে আমাদের কাছে। ‘বন্ধুরা বিদ্রুপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে’ শীর্ষক উজ্জ্বল পঙ্ক্তির স্রষ্টা পঞ্চাশের কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত উপসাগরীয় যুদ্ধের পর দেখেন ঈশ্বর আজ অকৃতার্থতার প্রতিমূর্তি। সময়ের দাহে একটু একটু অনীশ্বর হয়েও তবু ‘ভাবমূর্তি’ কবিতায় ঈশ্বরের ইমেজ রেখে দিতে চান তিনি। আর তখনই রিচার্ড ডকিন্সের এই উপলব্ধি একান্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয় যেন : ‘we can give up believe in God while not losing touch with a treasured heritage’ (দ্য গড ডেলিউসন, ২০০৬)।
২।
‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে’ – এই রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার স্বতন্ত্রধারায় আজও প্রবাহিত। তাই আমরা দেখি, যিনি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্বামী’ কিংবা ‘মহামানব’ বা ‘মানুষের ঈশ্বর’, ‘ত্রিভুবনেশ্বর’, তিনিই অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় ‘ঈশ্বর মহাশয়’ আর জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথের ‘নিহত উজ্জ্বল ঈশ্বর’ বা ‘নিহত বিধাতা’ হয়ে যান। চল্লিশের রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী দেখেন : ‘আজ বেশিরভাগ মানুষের কাছে ঈশ্বর এক কাল্পনিক সত্তা মাত্র। সে তুচ্ছ পার্থিব সংবাদ নিয়ে চঞ্চল’। আধুনিক মানসে ঈশ্বর-ভাবনার চঞ্চল মাত্রাটিকে ধরতে চেয়ে তিনি প্রশ্নাতুর হন :
ভগবান বদলে যাচ্ছে। আমিও কি বদলাচ্ছি না ?
নাকি ভগবান যথাস্থানে ব’সে, আমিই পতনশীল শুধু ?
সমাজ পাতালগামী, নদীর আবর্তে প’ড়ে কবি
সত্যশ্রীর পতাকাটা প্রাণপণে তুলে ধরতে চেষ্টা করছে। (এক গোষ্ঠীর পাঁচজন কবি / ব্রহ্ম ও পুঁতির মউরি )
পঞ্চাশের অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও সুধেন্দু মল্লিকের অন্তরঙ্গ আস্তিক্যচেতনায় ঈশ্বরের নাগরিক মেধাবী ইমেজ আর হৃদয়জীবিতা বিপরীতভাবে ফুটে ওঠে। মার্ক্সবাদী বিষ্ণু দে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তরুণ সান্যালের কবিতা-দর্শন আবার স্বতন্ত্র। নব্বইয়ের মন্দাক্রান্তা সেন আঁকেন ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর গোপন প্রেমের সংলাপের ছবি। নারীচেতনায় দীক্ষিত হয়ে কবিতা সিংহ জানিয়ে দেন : ‘কাব্যের ঈশ্বর নেই আছেন ঈশ্বরী’ – তাঁর কবিতা-মানবী ইভ ঈশ্বরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সমকালীন বিশ্বকবিতাতেও আধ্যাত্মিকতার সংজ্ঞা পুনর্নির্মিত হয়েছে। নাগরিক-আস্তিক এলিয়ট, রোম্যান্টিক-মিস্টিক ইয়েট্স্, রিয়েলিস্ট লারকিন বা হিউজ-এর কবিতায় ঈশ্বরের মুখ কোথাও প্রবল অস্তি কোথাও বা নেতির দ্বারা উন্মোচিত। একালের নোবেলজয়ী সীমাস হিনি প্রকৃতিকেন্দ্রিক কাব্যাদর্শ দিয়ে, টোমাস ট্রান্সট্রোমার গভীর চিত্রকল্পের ভিতরে নিঃশব্দ আধ্যাত্মিক বলয় যেমন নির্মাণ করেন, তেমনি ফরাসি ভাষী ইহুদী কবি এডমন্ড ইয়াবেস্ বিশ্বাস করেন, একালের ঈশ্বর শূন্যময়তার আলংকারিক প্রতিমূর্তি। বাংলায় রমেন্দ্রকুমারের সার্থক উত্তরসূরী আটের দশকের কবি সুধীর দত্তের চোখে কবি ‘ঈশ্বরকোটি পুরুষ’, তিনিও সবিস্ময় প্রশ্ন রাখেন ‘ঈশ্বর-ই কি শূন্যতা!’, কবিতার নাম রাখেন ‘মানুষের পাপ, ঈশ্বরেরও’। আবার সমকালীন নোবেলজয়ী কবি গ্যুন্টার গ্রাস বলেন : ‘নীৎশের কথা মানলে ঈশ্বর মৃত, / তা সত্ত্বেও বহুমুখী অস্ত্র হিসেবে /এখনও লাগসই / বিকিকিনির পশরা, / যেহেতু কোনো কপিরাইটের দ্বারা সংরক্ষিত নন।’ (রবিবাসরীয় মিতভাষণ / অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অনূদিত)।
৩।
তিনের দশক থেকে সমকালীন বাংলা কবিতায় ঈশ্বর-চেতনা আস্তিক্য-নাস্তিক্য-অজ্ঞেয়বাদ এইসব বিবিধ মাত্রায় ধরা পড়েছে। ধর্মের মতো কবিতার কোনো শেষ ঈশ্বরঘন আশ্রয় নেই, একথা জানিয়ে জীবনানন্দ অন্তিম পর্বের কবিতায় লিখেছিলেন : ‘মানুষের পৃথিবীতে সে অনেক শতাব্দী আগে / ঈশ্বর স্খলিত হয়ে গেছে – তবু মানুষের স্বভাবের গভীরতা আছে / প্রেম চায়, ন্যায় চায়, জ্ঞান চায় –’ (এখন এ পৃথিবীতে, আলোপৃথিবী)। এসবই আসলে নীৎশে-সার্ত্র-কাম্যুর নাস্তিক অস্তিত্ববাদী দর্শনের কথা। রোম্যান্টিক-ট্রটস্কিবাদী সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রেমের কবিতায় আনেন ঈশ্বরের উপমা ‘একটি গভীর নাম দাও ঈশ্বরের মতন গভীর’, মার্কিস্ট বুদ্ধিজীবী বিষ্ণু দের একটি কাব্যের নাম ‘ঈশাবাস্য দিবানিশা’। অন্যদিকে পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন ‘ঈশ্বর, এই শরীর মনে দ্বন্দ্বে / একি নিষ্ঠুর নীরব গ্রহণ করেছ? / যেখানে ভাবনা তোমাকে সৃষ্টি করেছে / দৃষ্টি সেখানে দাঁড়াল প্রতিদ্বন্দ্বী?’ (বিরোধ)। ঈশ্বর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের করমর্দন করেন, তিনি লেখেন ‘আমি যে ঈশ্বর বানাই’। তরুণ সান্যালের কাব্যের নাম ‘নাস্তিকের দেবীবন্দনা’ – তাঁর অনুভবে মন্দির-মসজিদ-গির্জার শিখরগুলি ‘উড়ে যায় কোনো মহাভাবনার পরমের দিকে’। মার্ক্সবাদী হয়েও তাঁদের কবিতায় ঈশ্বরচেতনা কিন্তু উপেক্ষিত নয়। একালের বামপন্থী শ্রমিক কবি কেষ্ট চট্টোপাধ্যায় ঈশ্বর মঙ্গলময় – ধ্বংস ও পালন সর্বত্রই এমন কবিতা লেখেন সম্প্রতি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদিও ‘ঈশ্বর, তোমার মতন নিরীশ্বর আর কেউ নেই’ ভাবেন। আসল কথা হলো, ঈশ্বরের ভাবমূর্তিকে আমরা আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত করে নিয়েছি। সেখানে প্রথানুগ ভক্তি বা তত্ত্ব মুখ্য নয়, সেখানে আছে আধুনিক মানুষের চৈতন্যের উন্মীলন। ‘এ সেক্যুলার এজ’(২০০৭) নামের সাম্প্রতিক গ্রন্থে চার্লস টেলর এমনই এক ধর্মনিরপেক্ষ আধ্যাত্মিকতার কথা বলেন, ‘And one needs both today in order to explore again the profound interpenetration of eros and the spiritual life. The terribly fraught area in Western Christendom, where the sexual meets the spiritual, urgently awaits the discovery of new paths to God’. (Page : 767) একালের কবিতায় ঈশ্বর অনেকাংশে একটা রূপক এবং লোক ঐতিহ্যের চিহ্নায়ক। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে তাই শেষপর্বের কাব্যে লিখতে হয় ‘ঈশ্বর মানুষ হলেন, মানুষ এবার ঈশ্বর হবে’। একালের কবিতার ঈশ্বর যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী, শঙ্খ ঘোষের সেই পঙ্ক্তির মতো অনিবার্য ‘তোমার আঙুলে আমি ঈশ্বর দেখেছি কাল রাতে’। ‘ঈশ্বর নেই’ বলে হাওয়ার টিটকারি উপেক্ষা করে অলোকরঞ্জন এক ‘নশ্বর ঈশ্বর’-এর কথা বলেন, ঈথার যেন তাঁর কাছে ঈশ্বরের সঙ্কেত, ই-মেল তাঁর কম্পিউটারে,ফ্যাক্সে ‘ঈশ্বরের চিঠি’ নিয়ে আসে। ঈশ্বর-বিশ্বাসী কবি সুধেন্দু মল্লিক এঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন : ‘অন্তরে যে পোড়ে / শান্ত শর্তহীন সেই কি ঈশ্বর? / নাকি যে পোড়ায়!’ আর শিশিরকুমার দাশ একটি অণুকবিতায় প্রশ্ন তোলেন : ‘ঈশ্বরে কি মসজিদে, গোধূলিতে নয়?’। বিভূতিভূষণের দিনলিপি বা ‘দেবযান’ পাঠ আমাদের যে মহাজাগতিক চেতনার সঙ্গে অন্বিত করে, এও তো তেমনই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাকার হওয়ার অনুভব – বিশ্বভরা প্রাণের ভিতরে জেগে ওঠা অপার বিস্ময়, একেই হয়তো আলোক সরকার বলেন : ‘সমস্ত বিশ্বের কেন্দ্রে জাগ্রত একটি চৈতন্য’।
৪।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেছিলেন, ঈশ্বর থাকেন ভদ্রপল্লীতে, সাধারণ মানুষ তাঁর করুণা বঞ্চিত। আর কবি গালিব লিখেছিলেন : ‘এদিকে আমি - শতসহস্র আর্তনাদ / ওদিকে তুমি এক পরমআশ্চর্য না শোনা’ – এমন কথা সাধারণ মানুষেরও। আধুনিক পাঠকেরও লক্ষ্য, কবিদের আবেগার্ত ভক্তিময়তার অনুসন্ধান কিংবা ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব প্রমাণ করা নয়, বরং ঈশ্বর, প্রভু, দেবী, দেবতা, ভগবান এইসব সম্বোধনে কবিরা কিভাবে যুদ্ধ ও সন্ত্রাসপীড়িত বিশ্বায়নের আলো লাগা ভুবনগ্রামে আশ্রয় খোঁজেন, আশ্বাস পান ও আশ্বস্ত করেন কিংবা নিছক মানবমহিমা আর ‘কঠিন’ সত্য-কেই স্বীকার করেন ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে, তার-ই নির্মোহ অন্বেষণ। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন থেকে হকিং সবাই ঈশ্বর নিয়ে ভেবেছেন, যে-ঈশ্বর আসলে বিশ্বে পরিব্যাপ্ত নিয়মের শাসন, সত্যেরই নামান্তর – যার উল্টোপিঠে লেখা আছে আস্থা ও আশ্রয়। কবি বুদ্ধদেব বসুর একটি উজ্জ্বল উচ্চারণ স্মৃতিধার্য মনে হয় ইদানীং ‘হাজার ভয় সংশয়ের অন্ধ অজানাতে / আমি তোমায় রেখে এলাম ঈশ্বরের হাতে’ (সমর্পণ)। কবির ঈশ্বর এভাবেই সংশয়ের বৃন্তে বিশ্বাসের ফুল হয়ে ফুটে ওঠে।
অনুকথন
অতিমারীর মৃত্যুমিছিলের মধ্যে দাঁড়িয়ে হয়তো কখনো ধ্রুপদী জার্মান কবি হ্যোল্ডারলিনের মতো আমরা অভিমানে বলে উঠি : ‘দেবতারা যদিও জীবিত, / তবুও তারা মাথার উপরে, অন্যতর বিশ্বে এক। / নিরন্তর ক্রিয়ারত, আমাদের দিকে নেই ততটা নজর – ’ (রুটি আর মদ / নিয়তি ও দেবযান / অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অনূদিত) - তবু বিশ্বাস কি হারায়? আস্তিক্যে ভর করেই নতুন করে বাঁচার জন্য আমরা অনেকেই কোনো অজানা শক্তির কাছেই প্রার্থনা করে ফেলি। যখন ব্যর্থতায়, শোকে, বেদনায় মন বিষণ্ণতায় ডুব দেয়, তখনও আমাদের সঙ্গী হতে পারে এই সংশয়খচিত কবিতা : ‘কয়েকটা নিষ্ফল শাখা মাথার উপরে আছে ঝুঁকে / ঈশ্বরের শেষ রশ্মি এসে পড়ে সেই ভস্মমুখে।’ (ভস্মমুখ / শঙ্খ ঘোষ) ফিনিক্স পাখির মতো মানবতা সেই ভস্মশেষ থেকে পুনর্জীবিত হয় বারবার। তাই আত্মশক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রযুক্তি - সবকিছুকে ছাপিয়ে এই বিপন্ন প্রহরে এক সেক্যুলার ঈশ্বরের প্রতি আমাদের প্রশ্ন ও প্রণতির শেষ নেই কোনও।।
[চিত্র ১ঃ মাইকেল এঞ্জেলো creation of Adam
চিত্র ২ঃ গণেশ পাইনের Mahabharat
চিত্র ৩ঃ রদ্যাঁ Hand]